Sunday, August 3, 2025
HomeScrollFourth Pillar | ভারতকে এক হিন্দুরাষ্ট্র করে তোলার প্ল্যান কিন্তু রেডি
Fourth Pillar

Fourth Pillar | ভারতকে এক হিন্দুরাষ্ট্র করে তোলার প্ল্যান কিন্তু রেডি

তারা আজ সংবিধান বদলে দেশের আত্মাকেই আঘাত করছে

Follow Us :

সমাজ এগিয়ে চলে তখনই, যখন তার চালিকাশক্তি হয় যুক্তিবাদ, সমতা, ন্যায়। ধর্ম, জাতি, বর্ণ, ভাষার উপরে উঠে একজন মানুষ তার কাজ, তার মানবিকতা ও মেধার ভিত্তিতে সমাজে স্থান পায়, এটাই আধুনিক সভ্যতার মূল শর্ত। আজকের দুনিয়া, যেখানে ধর্মীয় মেরুকরণ, জাতিগত বিভাজন আর ঘৃণার রাজনীতি নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে, সেখানে জোরাম মামদানির মতো মানুষদের উঠে আসা এক নতুন দিশা। কে এই জোরাম মামদানি? জোরাম মামদানি, একজন মুসলমান প্রার্থী হিসেবে নিউইয়র্কের মেয়র পদের জন্য ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে তার এই মনোনয়ন তার ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য নয়, এই মনোনয়ন এক সুস্পষ্ট বার্তা দেয়— তিনি একজন মুসলমান হয়েও নির্বাচিত হয়েছেন, অর্থাৎ তার যোগ্যতা, রাজনৈতিক কর্মদক্ষতা, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, এবং সমাজকল্যাণে তার ভূমিকা তাঁকে এই মনোনয়নের উপযুক্ত করেছে, এটাই এক আধুনিক সেকুলার সমাজ। ধর্মীয় পরিচয় সমাজে অবদান রাখার বা রাজনৈতিক যোগ্যতা প্রমাণের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। এই নীতিই এক প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক এবং মানবিক সমাজ গঠনের মোদ্দা কথা।

এবারে আমাদের দেশের কথায় আসা যাক। আজও দেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় পরিচয়, জাতপাত, ভাষাগত ভেদাভেদ এক বড় ভূমিকা নেয়। বা বলাই যায় যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটাই আসল ইস্যু হয়ে ওঠে। একজন মুসলমান বা দলিত প্রার্থী যোগ্য হলেও বহুবার তাঁকে শুধুমাত্র তাঁর পরিচয়ের জন্যই ব্যবহার করা হয়। আবার বহু অযোগ্য মানুষ শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম বা জাতির প্রতিনিধি বলেই এমএলএ, এমপি, মন্ত্রী হন। এর স্বাভাবিক ফল— অযোগ্য নেতৃত্ব, দুর্নীতি, বৈষম্য এবং সমাজে ঘৃণার আগুন। অথচ আমাদের দেশের স্বাধীনতার লড়াই যাঁরা লড়েছিলেন, তাঁরা তো এক নতুন স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে স্বপ্নে ছিল এমন একটা পৃথিবী যেখানে মানুষ মানুষের জন্য দাঁড়াবে, যেখানে ভোট বা নেতৃত্বে ধর্মের ভূমিকা থাকবে না, যাতে ভবিষ্যতের প্রজন্ম জানে— এই দুনিয়ায় ধর্ম নয়, যোগ্যতাই চূড়ান্ত পরিচয়। তাই জোরাম মামদানির মনোনয়ন আমাদের মনে আশা জাগায়, যদিও ঠিক এই সময়েই, একেবারে অন্য একটি প্রান্তে, ভারত নামক এক বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশে, ঠিক এর উল্টো দৃশ্য ফুটে বের হচ্ছে। সেই দেশ, যার সংবিধান ‘সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরলেও শাসকদলের নকড়া ছকড়ারা নয়, গুরুত্বপূর্ণ নেতারাওঁ এই ধর্মনিরপেক্ষতাকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন।

আরএসএস-এর বড় নেতা দত্তাত্রেয় হোসাবলে, বিজেপি নেতা শিবরাজ সিং চৌহান প্রকাশ্যেই বলেছেন— ভারতের সংবিধান থেকে ‘সেকুলার’ (ধর্মনিরপেক্ষতা) ও ‘সোশালিস্ট’ (সমাজতান্ত্রিক) শব্দদুটি তুলে দেওয়া উচিত। তাঁদের মতে, এগুলো ‘বিদেশি ধারণা’, এবং ‘ভারতের প্রকৃত ঐতিহ্যের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়’। এটা কিন্তু নিছক মতামত নয়— বরং এক রাজনৈতিক দর্শন, যার লক্ষ্য ভারতকে এক হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা। হ্যাঁ, এখানেই প্রশ্নটা উঠবে, উঠছে— যখন বিশ্বের প্রগতিশীল সমাজগুলো ধর্ম ও জাতি পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে একজন ব্যক্তিকে বিচার করতে শিখছে, তখন ভারতের মতো এক বহু-ধর্ম, বহু-জাতি, বহু-ভাষার দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল করার এই দাবি কেন? ভারতের সংবিধানে ‘সেকুলার’ শব্দটা তো শুধু এক সাজসজ্জা নয়, এক পোশাক নয়, এটা ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র্যকে রক্ষা করার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এখানে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি— সব মতের পথের সমান অধিকার নিশ্চিত করাই হল এই ধর্মনিরপেক্ষতা। এই নীতি আছে বলেই একজন মুসলমান মেয়ে স্কুলে হিজাব পরে যেতে পারে, একজন হিন্দু মন্দিরে যেতে পারে, আর একজন খ্রিস্টান নিজের বিশ্বাস নিয়ে উৎসব করতে পারে। ‘সেকুলার’ মানে অবশ্যই ধর্মহীনতা নয়, বরং সব ধর্ম থেকে রাষ্ট্রের সমান দূরত্ব বজায় রাখা। আরএসএস ও বিজেপি নেতৃত্ব এই ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করে যে যুক্তি দেয়, তা হল —এই শব্দগুলোর উৎস নাকি পাশ্চাত্য। কিন্তু বাস্তব সত্য হল— ভারতবর্ষের হাজার বছরের ইতিহাসেই ধর্মীয় সহনশীলতার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। অশোক থেকে আকবর, বা গান্ধী থেকে আম্বেদকর— ভারতের ইতিহাস এই বহুত্ববাদ, সহিষ্ণুতা এবং ধর্মীয় সহাবস্থানের কথাই বলে গেছেন।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদি রাজত্বের ১১ বছর: এক ধারাবাহিক পিছনের দিকে হাঁটা

কিন্তু বিজেপি ও আরএসএস যে ভারত গড়তে চায়, সেখানে একজন নাগরিকের পরিচয় হবে প্রথমে তার ধর্ম দিয়ে, পরে তার কাজ দিয়ে। সেখানে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) ধর্মের ভিত্তিতে বানানো হয়, মুসলমানদের বাদ দিয়ে। সেখানে এনআরসি চালু করা হয় এমনভাবে, যাতে সংখ্যালঘুরা প্রমাণ করতে না পারলে ‘বিদেশি’ হয়ে যায়। সেখানে হিজাব পরে স্কুলে যাওয়া ‘অপরাধ’ হয়ে ওঠে, লাভ জিহাদ নামে কাল্পনিক তত্ত্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হয়, এবং বিজেপি নেতারা অনায়াসে অনর্গল সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই ঘৃণা ছড়াবেন, বিষ ছড়াবেন। আর তাই, এখন, যখন ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটাকেই সংবিধান থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়, তখন বোঝা যায়— এটি নিছক শব্দ বদলের প্রশ্ন নয়, বরং এক গভীর আদর্শগত সংঘাত। এ্টা এক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে আরেক দৃষ্টিভঙ্গির যুদ্ধ— যেখানে একদিকে আছে মানবতা, সাম্য, এবং সমান অধিকারের সমাজ কল্পনা; আর অন্যদিকে আছে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ, ধর্মীয় জাতীয়তা, এবং বৈষম্য-নির্ভর রাষ্ট্রগঠনের প্রচেষ্টা। এবং মাথায় রাখুন আজ যখন শাসকদল বিজেপি এবং তার দর্শনের উৎস আরএসএস থেকে শুরু করে হিন্দু মহাসভা ঘনিষ্ঠ নেতা্রা পর্যন্ত একের পর এক দাবি তোলেন— সংবিধান থেকে ‘সেকুলার’ ও ‘সোশালিস্ট’ শব্দদুটোকে বাদ দিতে হবে, তখন প্রশ্ন তো উঠবেই—এই দাবিদারেরা আদৌ কি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন? আর সেই ইতিহাস স্পষ্টভাবে বলে দেয়— আজ যারা সংবিধান বদলাতে চাইছে, তারা এই সংবিধান গঠনের সময় পাশে ছিল না। বরং তারা তখন ব্রিটিশদের দালালি করছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বহু সংগঠনের, বহু মতাদর্শের সম্মিলিত লড়াই। কেউ গান্ধীবাদে, কেউ বিপ্লবী আদর্শে, কেউ সমাজতান্ত্রিক চেতনায় দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন। কিন্তু এই দীর্ঘ সংগ্রামের প্রধান ধারার বাইরে থেকেছে একটি সংগঠন— আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ) এবং তার মতাদর্শগত সহচর হিন্দু মহাসভা।

আরএসএস ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও, তাদের কোনও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা স্বাধীনতা আন্দোলনে ছিলই না। তারা না অসহযোগ আন্দোলনে ছিল, না লবণ সত্যাগ্রহে, না ভারত ছাড়ো আন্দোলনে। স্বাধীনতা, উপনিবেশ বিরোধিতা বা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি ছিলই না তাদের মূল এজেন্ডায়। হিন্দু মহাসভা তো আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের (১৯৪২) বিরোধিতা করেছিল। সুভাষচন্দ্র বসু যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন, তখনও তারা তার বিরোধিতা করে। সেই হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ব্রিটিশদের চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে ৪২-এর আন্দোলনকারীদের দমন করার জন্য যা যা করার তাঁর সরকার সেটা করবে। তিনি সেই সময়ে বাংলাতে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার দু’ নম্বর মন্ত্রী। হিন্দু মহাসভার নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকার— যাঁকে আজ বিজেপি সরকার ভারতরত্ন দিয়েছে— তিনি নিজেই ব্রিটিশদের কাছে একবার নয় সাত বার মুচলেকা দিয়ে ক্ষমা চান এবং শেষপর্যন্ত কারামুক্ত হন। তার সেই লেখা চিঠিগুলি আজও সংরক্ষিত আছে— যেখানে তিনি ব্রিটিশ রাজের প্রতি আনুগত্য জানিয়েছেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি আর কখনও ব্রিটিশ-বিরোধী কোনও কাজকর্মে যুক্ত হবেন না। যারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নেমেছেন, তাদেরকে সেই পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা দালালি করেছিল, যারা বিশ্বাসঘাতক, তারাই আজ সংবিধান বদলের কথা বলে!

আজ যাঁরা সংবিধান বদলের কথা বলছে, তাঁরা ভারতের ইতিহাসকেই বদলাতে চাইছেন। কেন? কারণ তাঁরা এক অন্য ভারত গড়তে চান— যেখানে শুধু হিন্দুদের প্রাধান্য থাকবে, সংখ্যালঘুদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানানো হবে, নারী-দলিত-বঞ্চিতদের অধিকার থাকবে না, ভিন্নমত থাকবে না, ধর্মের নামে শাসন চলবে। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে সংবিধানকেই আক্রমণ করে। কারণ, সংবিধান যতদিন আছে, ততদিন তারা ইচ্ছেমতো হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে পারবে না। তাই প্রথমে শব্দ বাদ দেওয়ার নাম করে তারা আসলে সংবিধানের আত্মাকেই হত্যা করতে চাইছে। এই সাভারকর, হিন্দু মহাসভার কর্মী নাথুরাম গডসে, নারায়ণ দত্রাত্রেয় আপ্তে জাতির পিতাকে খুন করেছিলেন, খুনের ষড়যন্ত্রের মাথায় ছিলেন আজকের ভারতরত্ন বিনায়ক দামোদর সাভারকর। গান্ধী হত্যাকারীরা আজ স্বাধীন দেশের সংবিধান পাল্টাতে চান, তাঁরাই যদি সফল হন, তাহলে ভবিষ্যতের ভার তুলে দেওয়া হবে সেইসব মানুষের হাতে, যারা অতীতের কোনও দায় নেয়নি। যারা স্বাধীনতার সময় পাশে ছিল না, তারা আজ সংবিধান বদলে দেশের আত্মাকেই আঘাত করছে। সেই ভুল আর একবার হতে দেওয়া যাবে না।

RELATED ARTICLES

Most Popular

Video thumbnail
Calcutta High Court | দিঘায় রো/হি/ঙ্গা বিরোধী মিছিলের অনুমতি শুভেন্দুকে, মানতে হবে কোন কোন শর্ত?
00:00
Video thumbnail
Rahul Gandhi | রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক অ্যা/টম বো/ম, 'দেশ চালাচ্ছে অ/বৈ/ধ সরকার'
00:00
Video thumbnail
Durgapur Incident | দুর্গাপুর কাণ্ডে ধৃ/তদের আদালতে পেশ, কী নির্দেশ?
00:00
Video thumbnail
Tejashwi Yadav | বিহারের খসড়া ভোটার তালিকা থেকে তেজস্বীর নাম বাদ? দেখুন সত্যি ভিডিও
00:00
Video thumbnail
Donald Trump | 'ভারত মৃ/ত অর্থনীতির দেশ' বি/স্ফো/রক ট্রাম্প, ট্রাম্পের মন্তব্যে কড়া সমালোচনা
00:00
Video thumbnail
জনতা যা জানতে চায় | Shishir vs Jayprakash | আধার কার্ড নিয়ে তুমুল বাগবিতণ্ডা শিশির vs জয়প্রকাশ
05:53
Video thumbnail
INDIA | Donald Trump | ট্রাম্পের ২৫% শুল্ক বড় সিদ্ধান্ত ভারতের কী কী পদক্ষেপ দিল্লির? দেখুন
11:48:05
Video thumbnail
জনতা যা জানতে চায় | বিহার বাহানা, বাংলা নিশানা?
02:31:28
Video thumbnail
জনতা যা জানতে চায় | Shishir vs Jayprakash |নির্বাচনী বন্ড নিয়ে শিশির বাজোরিয়া vs জয়প্রকাশ মজুমদার
03:59
Video thumbnail
Tejashwi Yadav | বিহারের খসড়া ভোটার তালিকা থেকে তেজস্বীর নাম বাদ? দেখুন সত্যি ভিডিও
04:05:06

Deprecated: Automatic conversion of false to array is deprecated in /var/www/ktv/wp-content/themes/techinfer-child/functions.php on line 39