কসবায় ধর্ষণ হয়েছে। কারও অস্বীকার করার কোনও জায়গাই নেই যে এই ধর্ষণ তৃণমূলের এক ছোটে নবাব করেছে। এটাও অস্বীকার করার অবকাশ নেই যে তৃণমূল দলের মধ্যে এইসব খাঞ্জা খাঁ বা বেশ কিছু চরম অশিক্ষিত মধ্যযুগের ধারণা নিয়ে চলাফেরা করা মদন মিত্র বা কল্যাণ ব্যানার্জির মতো নেতারা আছেন বলেই তলার সারিতে এই নবাবেরা জন্ম নেয়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ছাত্র সংসদের নির্বাচন করানোর কথা বলেও পিছিয়ে গেছেন, কলেজে কলেজে জন্ম নিচ্ছ এইসব দাদারা, পোটেনশিয়াল রেপিস্টরা। এবং এটাও ঘটনা যে এই ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কে প্রতিবাদ করবে? বিজেপি? কোন নৈতিক অধিকারে তারা এর প্রতিবাদ করবে? যারা গোধরাতে বিলকিস বানোর সাজা পাওয়া মানে অপরাধী হিসেবে ঘোষিত গণধর্ষকদের ফুল আর মিষ্টি দিয়ে সম্বর্ধনা জানায়, তারা প্রতিবাদ করবে ধর্ষণের? যারা হাথরসে ধর্ষণের পরে ধর্ষকদের নিয়ে দলের পতাকা সমেত মিছিল করে, তারা করবে ধর্ষণের বিরোধিতা? বিজেপির তথাকথিত ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’-এর সাফল্যের পোস্টারবয়। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ‘মডেল স্টেট’ হিসেবে উপস্থাপিত উত্তরপ্রদেশকে দেখিয়ে গোটা দেশজুড়ে প্রচার চালায় বিজেপি। আইনশৃঙ্খলা, উন্নয়ন, ধর্মীয় উৎসবের সফল আয়োজন— এসব নিয়েই গর্ব করে। সেই রাজ্য ধর্ষণের সংখ্যায় দেশে দু’ নম্বরে, বিজেপি শাসিত আরএসএস-এর পূণ্যভূমি মধ্যপ্রদেশ দেশের এক নম্বরে। সেই তারা করবে ধর্ষণের নিন্দা? যে রাজ্যে মানুষ মারা গেলে সংখ্যা লুকিয়ে রাখা হয়, তারা বলবে আইন শৃঙ্খলার কথা? যে বিজেপি শাসিত মণিপুরে থানা থেকে লুঠ হয়ে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্রের ৫০ শতাংশ আজকেও, এক বছর পরেও ফেরতই আসেনি, তারা বলছে আইন শৃঙ্খলার কথা? যে বিজেপি শাসিত রাজ্যে হাসপাতালে ঢুকে এক যুবক এক মহিলাকে সব্বার সামনে কুপিয়ে খুন করে সেই বিজেপি বলবে আইন শৃঙ্খলার কথা? সেটাই বিষয় আজকে, বিজেপির মুখে আইন শৃঙ্খলা নিয়ে প্রতিবাদ? হাসিও পায়, বমিও পায়।
২০২৫-এর উত্তরপ্রদেশের কুম্ভমেলার দুর্ঘটনার আসল বিবরণ সামনে। আমরা সেই দিনেই বলেছিলাম এক মৃত কুম্ভের সন্ধানে গিয়ে মানুষ দিশেহারা। আজ তার সত্যিটা আমাদের সামনে, সেদিনের ব্যর্থতা যে আরও অনেক বড়, তাও পরিষ্কার। সরকারি হিসেবে জানানো হয়েছিল, কুম্ভমেলার ভিড় সামলাতে না পেরে পদপিষ্ট হয়ে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বিবিসি-র অন্তর্তদন্ত রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে— মৃতের সংখ্যা আসলে ৮১। তাদের খোঁজে উঠে এসেছে এমন বহু পরিবার, যাঁরা মৃত আত্মীয়ের মরদেহ নিজেরাই বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন, কোনওভাবে সরকারি ক্ষতিপূরণও পাননি। এই মৃতদের তালিকায় রয়েছে বহু শিশু, বৃদ্ধ, নারী— যাঁরা গিয়েছিলেন ধর্মীয় শ্রদ্ধায়, কিন্তু ফিরেছেন লাশ হয়ে।
আরও পড়ুন: Aajke | আবার মমতা ম্যাজিক
এই রিপোর্ট উঠে আসতেই প্রশ্ন উঠছে— কেন এমন একটা বড়সড় মানবিক বিপর্যয়ের প্রকৃত তথ্য আড়াল করা হল? কেন নিহতের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশে এত গড়িমসি? কার স্বার্থে? এবং এর দায় কে নেবে? হিন্দুত্বের পোস্টার বয়? পাতাজোড়া যোগী–মোদির বিজ্ঞাপন, যেখানে বলা হয়েছিল পুণ্য চান তো কুম্ভে আসুন। মানুষ গিয়েছিলেন, দুর্ঘটনা হয়েছিল, এখন জানা যাচ্ছে তাঁদের লাশ গায়েব করা হয়েছে, তাদের ন্যূনতম কমপেনসেশন দেওয়া হয়নি। আজ স্পষ্ট যে এতবড় মেলার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বা ভিড় নিয়ন্ত্রণের কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। চিকিৎসা, উদ্ধার, পর্যাপ্ত জল বা বিশ্রামের বন্দোবস্তের মারাত্মক অভাব ছিল। এবং সেই ব্যর্থতার খেসারত দিয়েছে সাধারণ মানুষ। বিরোধীদের অভিযোগ, ভিড় সামলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রশাসন নিজের ব্যর্থতা চাপা দিতেই মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা লুকিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের একাংশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, যারা সরকারি তথ্যই চোখ বুজে প্রচার করেছে। কারণ সেই গোদি মিডিয়া জানত না বলে নয়, জানার পরেও সত্য লুকিয়ে জো-হুজুরি করে নিজেদের পে প্যাকেট সামলাচ্ছিলেন। যখন পশ্চিমবঙ্গে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, বা আইনশৃঙ্খলার সামান্য বিচ্যুতি হয়, তখন বিজেপির নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করুন— এই দাবিতে সোচ্চার হন। হওয়াই উচিত। বাংলার বিধানসভায়, লোকসভায়, এমনকী টিভি চ্যানেলে তাঁদের গলা ফাটে। ফাটুক। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে? এতজনের মর্মান্তিক মৃত্যুতে? মুখ্যমন্ত্রীর দায় নিয়ে তাঁদের কেউ কথা বলেননি। কোনও কেন্দ্রীয় তদন্ত বা পদত্যাগের দাবি হয়নি। কোনও মানবাধিকার কমিশন যায়নি, কোনও মহিলা কমিশন যায়নি। বিবিসির রিপোর্টে উঠে আসা তথ্য বলেই দিচ্ছে উত্তরপ্রদেশ সরকার শুধুমাত্র ব্যর্থই নয়, বরং প্রয়োজনীয় মানবিক সহানুভূতিও দেখাতে পারেনি। নিহতদের পরিবারগুলির কোনও ক্ষতিপূরণ নেই, কেউ কোনও তথ্য জানে না, কারও চোখে সেদিন কেবল জল ছিল— আবার কেউ প্রশ্ন করেছিলেন, “আমার ছেলেটা কীভাবে মরল, কেউ বলবে না?” না সেদিন উত্তর দেওয়ার কেউ ছিল না। তাই বলছি, হ্যাঁ এই রাজ্যে প্রতিবাদ হবে, আলবাত হবে, কিন্তু সেই প্রতিবাদ করার নৈতিক অধিকার বিজেপির নেই। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, যে বিজেপি শাসিত রাজ্যে কুম্ভমেলার দুর্ঘটনায় মৃতদের সংখ্যা লুকিয়ে লাশ গায়েব করে দেওয়া হয়, সেই বিজেপি নেতাদের কারও কি এই বাংলা বা কোথাও আইন শৃঙ্খলা নিয়ে একটা কথা বলারও নৈতিক অধিকার আছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
মাত্র গতকাল মণিপুরের চুরাচাঁদপুরে দু’ দলের মধ্যে মুখোমুখি লড়াইয়ে চারজন মারা গেছে—একজন বেসামরিক নারীসহ তিনজন কুখ্যাত বিদ্রোহী। প্রথম দলটির উপ-কমান্ডারও নিহত হয়েছেন এবং United Kuki National Army (UKNA) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। মানে ঠিক এই মুহূর্তেও মণিপুরের আগুন নেভেনি। এক বিজেপি শাসিত রাজ্যের হাল এমন যে সেখানে প্রধানমন্ত্রীও পা রাখার সাহস দেখাননি। উত্তরপ্রদেশে মারা গেলেন ৮১ জন, জানানো হল ৩৭ জন, জনা পনেরোর দেহই লোপাট হয়ে গেছে। এই হল সেই উত্তরপ্রদেশ, যা নাকি দেশের ‘মডেল’। এই হল সেই বিজেপি, সেই আরএসএস, সেই সরকার আর তাদের সেই প্রশাসন, যাদের সামনে দাঁড়িয়ে বাকিদের গণতন্ত্র শেখানোর স্পর্ধা দেখাচ্ছে রাজ্য বিজেপির নেতারা।