প্রাচীন ভারতের রাজ্য পরিচালনায় একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ছিল, সেই শব্দটা হল গূঢ়পুরুষ। গূঢ়পুরুষের কাজ ছিল নিজেকে গূঢ় অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন বা লুকিয়ে রেখে রাজত্বের কোথায় কী হচ্ছে, সেই সব খবর সংগ্রহ করা এবং রাজাকে সেই সব খবর জানানো। বুঝতেই পারছেন, গূঢ়পুরুষের আরেক নামই হল গুপ্তচর।
গুপ্তচর ছাড়া রাজার চলে না। খবর না পেলে রাজত্ব চলবে কী করে? আর গুপ্তচর ছাড়া খবর দেবেই বা কে? নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পেশা। তবুও এই গুপ্তচর বৃত্তিকে এক সময় ঘৃণ্য বলে মনে করা হত। গুপ্তচরের শাস্তি ছিল মৃত্যু। ছিলই বা বলছি কেন বহু দেশেই হয়তো এখনও তাই আছে। সেখানেও গুপ্তচরদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। রাজশেখর বসুর ভাষায় বললে, ‘হয় হয়, জানতি পারো না’।
শুধু রাজরাজড়াই নয়, স্বৈরাচারীরও কিন্তু গুপ্তচর লাগে। হিটলারের কথা মনে করুন। জার্মানিতে ছিল বিখ্যাত গেস্টাপো বাহিনী। এরা দু’টো কাজ একসঙ্গে করত – গুপ্তচরবৃত্তি ও জল্লাদের কাজ। অর্থাৎ নাৎসিবিরোধী কাজ কেউ করছে কী না তার খবর রাখত, এবং সময়মতো তাঁকে তুলে নিয়ে এসে হাপিস করে দিত। এরকম উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যায়।
হলিউড সিনেমা কিন্তু গুপ্তচরদের মান একটু ফিরিয়ে দিল। গুপ্তচরের ভূমিকায় দেখা দিলেন টম ক্রুজ, যিনি মিশন ইম্পসিবল-কে পসিবল করেন। মার্বেলের ব্ল্যাক উইডোও নামকরা মহিলা গুপ্তচর। বাস্তবে দুনিয়ায় কিন্তু সত্যিই একজন বিখ্যাত মহিলা গুপ্তচর ছিলেন, দুনিয়াটাকে মাতাহারি নামেই চেনে।
এখন কথা হচ্ছে, এত গুপ্তচরের খবর আপনাদের দিচ্ছি কেন? তার কারণ এই, কেউ কেউ সন্দেহ করছেন, মোদি সরকার আমার আপনার জীবনে এবার গুপ্তচর লাগাচ্ছে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। সেই গুপ্তচরের নাম হল ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ। এই অ্যাপ বাজারে আনতে চলেছে মোদি সরকার। এই নিয়ে ইতিমধ্যেই নানাভাবে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। বলব তার কথা। কিন্তু তার আগে বলতে হবে, নিয়ে সরকার কী বলছে? অর্থাৎ এই অ্যাপ ঠিক কী কী সুবিধা দিতে পারে? সরকার তরফের বক্তব্য, এবার আপনার ফোন হারিয়ে গেলে বা চুরি হলে চিন্তার কিছু নেই। আপনার ব্যক্তিগত তথ্য চলে যাবে না জালিয়াতদের হাতে। গ্রাহকদের স্বার্থে এই সমস্যার সমাধানে ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ এনেছে কেন্দ্র। প্রতিটি ব্যবহারকারীর ফোন সুরক্ষিত রাখতে ও চুরি বন্ধ করতে এই অ্যাপ আনা হয়েছে। এই অ্যাপটি কেবল ফোন ব্লক করতে সাহায্য করে না, বরং চোরদের চিন্তা বাড়ায়।
‘সঞ্চার সাথী’র সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, এক ক্লিকে ফোন ব্লক করা। এই অ্যাপে আপনার ফোন ‘Lost বা Stolen’ হিসাবে চিহ্নিত করার সঙ্গে সঙ্গে ফোনের IMEI নম্বরটি সারা দেশের সব টেলিকম কোম্পানি ব্লক করে দেয়। এর অর্থ হল অন্য কোনও সিম কার্ড ঢুকিয়ে কেউ ফোনটি ব্যবহার করতে পারবে না। চোরের কাছে, ফোনটি ইটের ঢেলার মতো হয়ে যায়। কিন্তু এসবের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, এই অ্যাপ দিয়ে আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ ট্র্যাক করা যাবে, আর আপত্তি উঠছে এখানেই।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | সোনালি ঘরে ফিরবেন কবে? তাঁদের এই ৫ মাসের ভোগান্তির জবাব শুভেন্দু অধিকারী দেবেন?
রাজনৈতিক মহলের একাংশের ধারণা এই ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ দিয়ে মোদি সরকার আসলে জনগণের প্রতিটি খবর জানতে চাইছে, নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে দেশের মানুষের প্রত্যেকদিনের জীবন। ঠিক যেমনটা হয়ে থাকে রাশিয়া বা উত্তর কোরিয়ায়। উত্তর কোরিয়া সরকারের একটা বিশেষ অ্যাপ আছে, যে অ্যাপ ফোনের মালিকের অনুমতি ছাড়াই কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর স্ক্রিনশট নিতে থাকে। এবং সেই তথ্য একমাত্র সরকারি জানতে পারে, আর কারও পক্ষে টেকনিক্যালি জানা অসম্ভব। স্বাভাবিকভাবেই এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কেন না সরকারের নির্দেশ হচ্ছে, প্রতিটি ফোনে বাধ্যতামূলকভাবে এই অ্যাপ ইন্সটল করতে হবে।
সরকারি এই নির্দেশ নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার পরে কিন্তু বিজেপি পিছু হটেছে। সরকারের তরফে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া জানিয়েছেন, ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক নয়। যার ইচ্ছে হবে ইন্সটল করবেন, যার ইচ্ছে হবে না করবেন না। কিন্তু তাই বলে বিতর্ক থামেনি।
ভারতে বিক্রি হওয়া সব স্মার্টফোনে ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপটি প্রি-ইনস্টল করা থাকতে হবে বলে গত ২৮ নভেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ফোন প্রস্তুতকারী সব সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অ্যাপেল ও স্যামসাং ওই নির্দেশ কার্যকরী করতে আপত্তি জানিয়েছে। এই নিয়ে সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসবে তারা, মাঝামাঝি কোন পথ বার করবার জন্য।
ভেবে দেখুন, গন্ডগোলটা ঠিক কোথায়। সরকার বলছে ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিটি ফোনে প্রি-ইন্সটল করতে হবে। অন্যদিকে সিন্ধিয়াজি বলছেন, যার ইচ্ছে হবে ‘সঞ্চার সাথী’ ব্যবহার করবেন, যার ইচ্ছা হবে করবেন না। এর মানে কী?
আরেকটা মত হচ্ছে, ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ ফোনে থাকলেই, সরকার সেখান থেকে আপনার প্রতিটি পদক্ষেপের খবর পেতে থাকবে। কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী এই সঞ্চার সাথীকে ‘স্নুপিং অ্যাপ’ বলে চিহ্নিত করে অভিযোগ করে বলেছেন, এই অ্যাপ ব্যবহার করলে গ্রাহকের গোপনীয়তার সুরক্ষা লঙ্ঘিত হবে।
সরকার এখন বলছে এই অ্যাপ ব্যবহার বাধ্যতামূলক নয়। যার ইচ্ছে হবে করবে, যার ইচ্ছে হবে না করবে না। কিন্তু এই ঘুরিয়ে নাক দেখানোর কী দরকার ছিল? প্রশ্ন হচ্ছে এই, সরকার কেন প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ প্রি-ইনস্টল করাটা বাধ্যতামূলক? ভারতে জেন-জি ঠিক কত শতাংশ? যে বিপুল পরিমাণ বয়স্ক মানুষেরা এদেশে রয়েছেন, তাঁদের কত শতাংশ অ্যাপ ডাউনলোড করতে বা তাকে বাতিল করতে জানেন? বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে মহিলাদের কত পারসেন্ট এখনও পর্যন্ত স্বাক্ষর হয়েছে? অ্যাপ ব্যবহারের কী জানেন তাঁরা? মানে তো তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে, সরকারের কোন একটা অভিসন্ধি নিশ্চয়ই ছিল। অ্যাপেল বা স্যামসাং-এর মতো কোম্পানিগুলো বিরোধিতা করার পর, রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হওয়ার পর, এখন তো পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে যে, সরকার পিছু হটছে। ভারতে একাধিক দল এর আগে দিল্লির মসনদ দখল করেছে। কিন্তু বিজেপি ছাড়া এরকম রহস্যময় কাজকারবার আর কেউ করেছে বলে তো মনে হয় না।
এরপরও চোখ বুজে বলা যায়, ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ অনেকেই ব্যবহার করবেন। এর সুবিধা নিয়ে প্রচারও শুরু হয়েছে রীতিমতো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কী চায়? বিজেপি কী চায়? এক দেশ এক দল? অর্থাৎ এমন এক দেশ যেখানে বিজেপি ছাড়া আর কোনও দল থাকবে না। যেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা। আর সেই সব রাষ্ট্রদ্রোহীদের চিহ্নিত করতে বিজেপিকে সাহায্য করবে এরকম সব অ্যাপ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কী চান?
দেখুন ভিডিও:







