ওদিকে অমিত শাহ থেকে জে পি নাড্ডা সাহাবরা আসছেন মাঝেমধ্যেই। হোম টাস্ক দিয়ে যাচ্ছেন, কড়া কড়া হোম টাস্ক, এতগুলো জনসভা করতে হবে, এতগুলো মিছিল। ফিরে এসে দেখছেন কোথায় কী, অর্ধেক হোম টাস্কও শেষ হয়নি। ২০২১-এর পরে ৮টা উপনির্বাচন হয়েছে, প্রত্যেকটাতে হার, জেতা আসন চলে গেছে, হারা আসন উদ্ধারের তো প্রশ্নই নেই। এদিকে নেতারা এসে টার্গেট হেঁকে যাচ্ছেন ২০টা লোকসভার আসন চাই, চালতা ফল নাকি যে গোড়ায় চাপ দিলে পুটুস করে খুলে আসবে? এক সমীক্ষা হয়েছে, যাকে বলে অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা। তো বাংলার সেই অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা যা নাকি বিজেপিই করিয়েছে তাতে বলা হচ্ছে দল ৯টা আসন পেলেও পাইতে পারে। সে কী কাণ্ড, অর্ধেক ঘ্যাচাং ফু? এটা তো ওঁদের সমীক্ষা, যাঁরা বিধানসভায় কম করেও ১৮৫টা পাওয়ার ফল জানিয়েছিলেন এইরকম এক সমীক্ষায়। তাহলে আসল হালাতটা বুঝুন একবার। যাঁরা নির্বাচন, আসন, ভোটের হিসেব, প্রবণতা ইত্যাদি নিয়ে নাড়াঘাঁটা করেন, তাঁদের মতে এ রাজ্যে ২০২৪-এ বিজেপি ৩টে পেলে হয়। সেটা কি একটু বাড়াবাড়ি হল? না এক্কেবারেই না, আমিও এই মতের সপক্ষে, পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল সেরকম ইঙ্গিত দিচ্ছে। কেউ কেউ বলবেন, পঞ্চায়েত ভোটে ভোট লুঠ হয়েছে, খেয়াল করে দেখুন বিজেপি শক্তিশালী এলাকায় তেমন ভোট লুটের কোনও অভিযোগও আসেনি। ধূপগুড়ির ফলাফল বা উপনির্বাচনের ফলাফলগুলো বলে দিচ্ছে বিজেপির গ্রাফ ক্রমশ নামছে। এবং ঠিক সেই কারণেই বিজেপির র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইলে তেমন জোশ আর নেই, কেন নেই? সেটাই বিষয় আজকে, এ রাজ্যে বিজেপির সমস্যা বেড়েই চলেছে।
রাজ্যজুড়ে বিজেপির দিকে তাকান, দেশের বিজেপির সঙ্গে কোনও মিল খুঁজে পাবেন না। সুকান্তের ডাকা অনুষ্ঠানে কাঁথির খোকাবাবু থাকবেন না, কাঁথির খোকাবাবু আছে জানলে দিলু ঘোষ সে পাড়া মাড়াবেন না। এই তো সেদিন সাংসদ তায় মন্ত্রী সুভাষ সরকার নিজের কনস্টিটুয়েন্সিতে গিয়ে হেনস্থার মুখোমুখি হলেন কেবল নয়, তাঁকে দলের অফিসে তালা দিয়ে রাখা হল, থানা থেকে পুলিশ গিয়ে ছাড়িয়ে আনল। রাজ্যে শেষ মিছিলে অবরোধে লকেট চট্টোপাধ্যায়কে কে দেখেছেন? রুদ্রবাবুর কাজ ছিল না, এখন সম্ভবত কাজ পাওয়ার কড়ারেই চেপে গেছেন। সব মিলিয়ে ছন্নছাড়া অবস্থা। কিন্তু কেন? কারণ হল বিজেপির সংগঠন কোনও লড়াই, ধরনা, মানুষের সঙ্গে লাগাতার ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি। হঠাৎ এক রব উঠল, ৪২টা আসনে ১৮টা লোকসভা আসন পেয়ে গেল বিজেপি। কিন্তু তখনও নেতা কোথায়? তাই তৃণমূলকে ভাঙতে হবে, নির্বিচারে তৃণমূল থেকে লোকজন নেওয়া হল, এরা কারা?
এরা অত্যন্ত ক্ষমতালোভী, ধরুন এক সাংবাদিক, বাপের জন্মে কাউন্সিলরও হওয়ার যোগ্যতা ছিল না, হয়েছিলেন বিধায়ক, কিন্তু ভাবলেন, আমি শিক্ষামন্ত্রী নই কেন? একজন অভিনেতা, অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া নীল বা লাল বাতি লাগানো গাড়িতে চড়ার কোনও স্বপ্নই যাঁর ছিল না তিনি এক লপ্তে দেড় লক্ষ টাকা মাইনে আর নীল গাড়ি পেলেন। ব্যস, এবার তাঁর তথ্য সংস্কৃতি দফতর চাই। গুষ্টিসুদ্ধু তৃণমূলের মন্ত্রী সাংসদ, এটা সেটা, কিন্তু খোকাবাবু মুখ্যমন্ত্রী হবেন। এইসব চরম উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের দল ভাঙিয়ে বিজেপিতে আনা হল। এঁদের সঙ্গে আরও একঝাঁক উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা দলে ভিড়লেন, টালিগঞ্জে হিড়িক লাগল। কী বলা হয়েছিল, মিনিমাম ১৮৫, সরকার আমাদের, অমিত শাহ বলেছিলেন, অবকি বার ২০০ পার।
তো কী হল? হার। বহু লোক সরে যাচ্ছে, টালিগঞ্জে তো রিট্রিট। তখন বলা হল, অপেক্ষা করো গোটা দলকে পোরা হবে জেলে, মাথা থেকে লেজ অবধি। প্রতিধ্বনিত হল সে কথা, অনেকেই বললেন, মাথাকেও ঢোকাব। সময় বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের ন্যায়। কিছু লোক ধরা পড়ল, এখনও তেমন কিছু বের হল না, আর মাথা দূরস্থান, মাথার তলাতেই আটকে যাচ্ছে বার বার। কাজেই চরম ফ্রাস্টেশন। কতটা ফ্রাস্টেশন? রাজ্যের অন্যতম নেতা শমীক ভট্টাচার্য মাত্র গতকাল বলেছেন, আর কতবার দেখব যে ওঁকে ডাকা হবে, জেরা করা হবে, তারপর ছেড়ে দেওয়া হবে, আমরা হতাশ হয়ে যাচ্ছি। এর মানে খুব পরিষ্কার, বলা হয়েছিল জেলে পুরে দেওয়া হবে, নেতারা সব্বাই জেলে গেলে ফাঁকা মাঠে গোল দেবেন বিজেপি নেতারা, কিন্তু সেটা হচ্ছে না। এদিকে ফাইনাল পরীক্ষা এগিয়ে আসছে, যেখানে দলের এক মাঝারি স্তরের নেতা সেদিন কথা বলতে বলতে বলেই ফেললেন, ২০, ১৮, ৯ বাদ দিন, সভাপতি নিজের আসনটা বাঁচাতে পারবেন তো? হ্যাঁ সেইখানেই সমস্যা, বিজেপি খুব ভালো করে জানে, এ বাংলায় লোকসভায় কী হতে চলেছে, তাই সমস্যা আরও বাড়ছে, তিন থেকে চারজন নেতা রেগুলার তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, আরও সমস্যা বাড়বে। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, তৃণমূল শীর্ষনেতাদের জেলে পুরে একটা ফাঁকা খেলার মাঠ দেওয়া হবে রাজ্য বিজেপি নেতাদের, সেটা হচ্ছে না দেখেই কি রাজ্য বিজেপি নেতারা এতটা হতাশ? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
বাংলা বড় কঠিন জায়গা, এখানে এক দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল। বামেরা এক দীর্ঘতর সংগ্রাম আন্দোলনের সঙ্গে থেকে কংগ্রেসকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসে, অন্য রাজ্যের মতো ঝপাং করে জনতা সরকার তৈরি হয়নি। তারপর ৩৪ বছর, তৃণমূলের লড়াই, এক বড় পরিসরে সিভিল সোসাইটি মুভমেন্ট-এর ফলে বামেদের পতন তৃণমূলের ক্ষমতায় আসা, এটা যদি বদলায় তাহলে এভাবেই বদলাবে। ওই ইডি, সিবিআই ডেকে জেলে পুরে দিয়ে সরকার বদলে ফেলব গোছের মুড়ির মোয়া যাঁরা দেখিয়েছেন তাঁরা মূর্খ, বাংলার ইতিহাস জানেন না আর যাঁরা দেখছেন, তাঁরা আবাল, শিশু, তাঁরা বোঝেন না। বাংলার মাটিতে যত্ন করে ফসল ফলাতে হয়, অনেক পরিশ্রম আর ধৈর্য লাগে।