ছবিটা ভালো করে দেখুন, মধ্যে অচৈতন্য অবস্থায় তৃণমূল সাংসদ মিতালি বাগ, আদতে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, বাঁ-দিকে বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী, ডান দিকে সিপিআইএম-এর কেরালার সাংসদ জন ব্রিটাস। ক’দিন পরেই কেরালা, পশ্চিমবঙ্গে ভোট। এই বাংলাতে লড়াই তো অবশ্যই তৃণমূল বনাম বিজেপি, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া আর এলিট প্রচার তন্ত্রে সিপিএম তীব্র সমালোচনা আর বিরোধিতা করবে সিপিএম-এর, মাঝেমধ্যে মনে হবে তাঁরা তাঁদের প্রচারের ৮০ শতাংশ তৃণমূল আর ২০ শতাংশ বিজেপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করবেন। যা খুব স্বাভাবিকও, কারণ তাঁদের তো এই রাজ্যে লড়তে হচ্ছে তৃণমূলের সঙ্গেই, এই তৃণমূলই তো ৩৪ বছরের বাম জমানার পতন ডেকে এনেছিল। অন্যদিকে কেরালাতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে কংগ্রেস সিপিএম-এর, হিসেব বলছে এবারে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু সেই লড়াই তো রাজ্যে, সেই লড়াই তো বিধানসভাতে। দেশজুড়ে লড়াই তো বিজেপির সঙ্গে, সেই বিজেপি যারা আর কিছুদিন ক্ষমতায় থাকলে অন্য কোনও দলই আগামী ২৫-৩০ বছর ক্ষমতার ধারে কাছেও আসতে পারবে না, একে একে সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দখল নিচ্ছে তারা আর দেশজুড়ে ছড়াচ্ছে অবিশ্বাস্য ঘৃণা, তাল তাল মিথ্যে কথা দিয়ে তৈরি হাজার একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ দখল নিচ্ছে মানুষের মগজের। দেশজুড়ে হিন্দুদের এক বড় অংশ মনে করছেন হিন্দু খতরে মে হ্যায়। সাড়ে পাঁচশো বছরের মুঘল শাসনের সময়ে নয়, প্রায় দুশো বছরের ইংরেজ ক্যাথলিক খ্রিস্টান শাসনের সময়ে হিন্দু খতরে মে, মানে বিপদে ছিল না, মোদিজির এই ১১ বছরের রাজত্বকালে হিন্দু বিপন্ন হয়ে পড়ল? কিন্তু দেখুন শুনতে যতই আজগুবি লাগুক, এক বড় অংশের মানুষ কিন্তু এই কথায় বিশ্বাস করেছে, করছে। সেই জন্যই আজকের রাজনৈতিক লড়াইটা রাজনৈতিক দল আর তার প্রতীক চিহ্নের নয়, এটা এক আইডিয়ার, এক আদর্শের বিরুদ্ধে আর এক আদর্শের লড়াই। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, ইন্ডিয়া জোট। বাঁ-দিকে কংগ্রেস, ডানদিকে সিপিএম আর মধ্যে তৃণমূল।
ছবিগুলোকে একটু বোঝার চেষ্টা করুন, দলের মাঝারি কর্মী নয়, নতুন সাংসদও নয়, অখিলেশ যাদব নিজে পুলিশের ব্যারিকেড পেরিয়ে লাফ দিলেন। ওদিকে তৃণমূল কংগ্রেস ইন্ডিয়া মঞ্চ থেকে দলছুট আম আদমি পার্টির সঙ্গে সমন্বয়ের কাজ করল, দূত ছিলেন ডেরেক ও’ব্রায়েন। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র, মিতালি বাগ অসুস্থ হয়ে পড়ায় রাহুল গান্ধী শুশ্রুষায় নেমে পড়লেন, নিজে ধরে নিয়ে গেলেন বাসে। সংসদ ভবন থেকে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত বিরোধী সাংসদদের মিছিলে কংগ্রেস নেতৃত্ব দিল ঠিকই। তবে নিজের হাতে রাশ রাখার চেষ্টা করল না।
আরও পড়ুন: Aajke | ডাইনি, তুই নাম চেয়ার থেকে শালা: শ্রীলেখা মিত্র
বরঞ্চ রাহুল গান্ধী প্রতিটি পদক্ষেপে ইন্ডিয়া-র শরিক অখিলেশ যাদব, ডেরেক ও’ব্রায়েনদের কাছে জানতে চাইলেন, এর পরের পরিকল্পনা কী? তাঁদের সিদ্ধান্ত কী? হাঁটতে না পারলেও প্রবীণ শরদ পওয়ার কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গের সঙ্গে মিছিলে যোগ দিলেন। ‘ভোট চুরি’ স্লোগান তুলে ভোটার তালিকায় বিশেষ সমীক্ষার বিরুদ্ধে আজ বিরোধীদের ইন্ডিয়া মঞ্চ সংসদ ভবনের সামনে সাম্প্রতিক অতীতে সব থেকে বড় আকারে শক্তি প্রদর্শন আমরা দেখলাম। প্রমাণ মিলল, নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকায় বিশেষ পরিমার্জন এবং নির্বাচন কমিশন-বিজেপির বিরুদ্ধে ভোটার তালিকায় কারচুপির অভিযোগ ইন্ডিয়া মঞ্চকে ফের এককাট্টা করে দিয়েছে। কিছু দিন আগেও যে সাংবাদিকেরা, পলিটিক্যাল পণ্ডিতেরাই কেবল নয়, ইন্ডিয়া-র নেতারাই বলতে শুরু করেছিলেন, ওই মঞ্চ শুধু গত লোকসভা নির্বাচনের জন্যই ছিল, সেই ইন্ডিয়া জোট এক্কেবারে চাঙ্গা। ওদিকে ঘরের ভেতরের ইস্যু, পাকিস্তান, চীন আর আমেরিকার ট্যারিফ নিয়ে মোদি সরকার নাজেহাল। হ্যাঁ, এরকম এক সময়ে ঠাকুর সাব বলেছিলেন লোহা গরম হ্যায়, মার দো হাথৌড়া। একে তো বিজেপির একার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, তার ওপরে বিহারে নীতীশ কুমারের উপরে এতটুকুও ভরসা করতে পারছে না সেখানকার বিজেপি নেতারা, কাজেই বিহারে হারলে মূলত সেই রাজ্যের দল জেডিইউ-র নেতারা, সাংসদেরা কোন দিকে যাবেন কেউ জানে না, কাজেই এক ক্যাচ টোয়েন্টিটু সিচুয়েশনের মধ্যে আছে বিজেপি। ওদিকে ৭৫ তো এসেই গেল, মোদিজি তো বয়স আটকাতে পারবেন না। কাজেই রাজ্যের ভেতরের যাবতীয় ঝগড়া আর দোষারোপকে সরিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে এক শক্তিশালী বিরোধী শিবির গড়ে ওঠাটা খুব জরুরি ছিল, আমরা গতকাল তার ছবি দেখতে পেলাম। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের ভোটার লিস্ট সমীক্ষার বিরুদ্ধে বিরোধী দলের আন্দোলনে অনেকদিন পরে আবার একই সঙ্গে তৃণমূল, কংগ্রেস, সমাজবাদী দল, সিপিএম, আম আদমি পার্টি ইত্যাদিকে একসঙ্গে দেখা গেল। এই জোট যদি সত্যিই কি সত্যিই গড়ে উঠবে বলে মনে হয়? শুনুন মানুষজন কী মনে করছেন।
আগেও বলেছি আবারও বলছি, স্বৈরাচারী শাসক তার স্বৈরাচার দিয়েই তার বিরুদ্ধের শতধা বিভক্ত মানুষদের এক জায়গাতে এনে দেয়। ছোট ছোট নানান ভেদাভেদ পাশে সরিয়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তৈরি হয় এক প্রবল প্রতিপক্ষ। হ্যাঁ, সেই প্রতিপক্ষের চেহারা ধীরে ধীরে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। কংগ্রেস তার পুরনো জমিদারি মেজাজ ছেড়েছে, বাকি দলেরা বুঝেছে একজোট না হলে ক’দিন পরে অস্তিত্বও থাকবে না। কাজেই তাঁরা এক হচ্ছেন, সেই ছবিই আমরা দেখলাম দিল্লিতে, একদিকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, একদিকে সিপিএম সাংসদ জন ব্রিটাস, মধ্যে তৃণমূল সাংসদ মিতালি বাগ। হ্যাঁ, এই ছবিটা ঐতিহাসিক, যদি এই পথেই থাকে ইন্ডিয়া জোট তাহলে ইতিহাস অন্যরকম হবে, আর যদি এটা সাময়িক হয়, আবার জোটে ফাটল ধরে তাহলে ইতিহাস এদের কাউকেই ছেড়ে কথা বলবে না।