বামপন্থীরা শূন্য, কংগ্রেসের কিছু হবে না, আইএসএফ-এর একজন এমএলএ, তিনিও কিছুই করে উঠতে পারবেন না। এটাই চলতি আলোচনা। কিন্তু বামেরা রাজ্য জুড়েই কম হলেও আছেন। মিছিল করছেন, মিটিং করছেন, রাস্তায় নামছেন, ঘেরাও করছেন। কংগ্রেস অবশ্য সেই কবে থেকেই মুর্শিদাবাদ, রায়গঞ্জ আর মালদার মধ্যে আটকে আছে। আর আইএসএফ ভাঙড়ের বাইরেও বহু পকেটে সক্রিয়। কিন্তু চলতি আলোচনাটা বদলাচ্ছে না। আজকেই নির্বাচন হলে ২৯৪টা বিধানসভা আসনের ২৫০টাতেই লড়াই হবে তৃণমূল-বিজেপির। এই বাইনারিটা, মানে এই হয় তৃণমূল, না হলে বিজেপি এই ন্যারেটিভটা বদলাচ্ছে না কেন? এই ন্যারেটিভটা জন্ম নিল কী করে? ২০১১-তে তো সিপিএম বা বামফ্রন্টকে হারিয়েই তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছিল। হেরেছিল বামেরা, হেরেছিল সিপিএম, কিন্তু তারাই তো ছিল ৯০ শতাংশ আসনে বিরোধী। কী এমন হল যে গোটা ন্যারেটিভটা বদলে এখন বাংলার রাজনীতিতে মূল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠল বিজেপি। এই আলোচনাটা করলেই এই ইদানিং সিপিএম-এর সেটিং তত্ত্বটা বোঝা যাবে। বোঝা যাবে কেন প্রতি বক্তব্যে প্রতি আলোচনায় তৃণমূলই তাদের টার্গেট, তাদের আক্রমণের লক্ষ্য। খুব ক্যাজুয়ালি আপনার ফেসবুকে চিহ্নিত সিপিএম-এর যে কারও পোস্ট উল্টে দেখুন। ১০০টা পোস্টের ৮০ থেকে ৮৫টা পোস্ট তৃণমূল, মমতা, অভিষেকের বিরুদ্ধে, কী তারও বেশি। স্বাভাবিক প্রশ্ন, তাঁরা এটা করছেন কেন? বিজেপি আরএসএস ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি বলার পরে একটা আঞ্চলিক দলের বিরুদ্ধে এই তীব্র আক্রমণের কারণ হল ওনারা বাইনারিটা বদলাতে চান। ওনারা বাইনারিটা বদলে তৃণমূল বনাম সিপিএম করতে চান। অন্যদিকে বিজেপিও স্বাভাবিকভাবেই এই লড়াইয়ের মেরুকরণটা বিজেপি বনাম তৃণমূলই রাখতে চায়। কংগ্রেস আইএসএফ কী চায় তাতে বাংলার রাজনীতিতে কিচ্ছু যায় আসে না কাজেই এবার আলোচ্য বিষয় তৃণমূল কী চায়? যেহেতু বিজেপি দিল্লিতে ক্ষমতায়, তাদের ১০ বছরের রাজত্বে বেকারি, বৈষম্য, মূল্যবৃদ্ধি, বাংলার প্রতি বঞ্চনা, ভিজিলেন্স এজেন্সি, ইডি, সিবিআই ইত্যাদিদের হুমকি ধমকি ইত্যাদি ইস্যু অনেক বড়, মানুষের কাছে সহজবোধ্য। তাই তৃণমূলেরও লক্ষ্য লড়াইটা ওই বিজেপি তৃণমূলের মধ্যেই থাকুক, কিন্তু সিপিএম কংগ্রেস খানিক ভোট কাটলে কাটুক। তাদের মাঝে মধ্যে খেপিয়ে দেওয়ার জন্য যা করার করা হোক, ওরা খানিক ভোট কাটলে সেটাও তৃণমূলের লাভ। আর সেই বাইনারিটা সেট করার কাজটাই হাতে নিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটাই বিষয় আজকে, অভিষেক বাংলার রাজনৈতিক লড়াইটাকে তৃণমূল বনাম বিজেপি করে তুলছেন।
প্রথম আলোচনাটা আগে সারি, তৃণমূল হারাল বামেদের, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বিজেপি কী করে বামেদের জায়গাটা নিয়ে দু’ নম্বর দল হয়ে উঠল? তার কারণ হল সিপিএম-এর দ্বিতীয় সারির নেতারা বাম জমানাতেই জন্মেছেন। মাঠে নেমে আন্দোলন করা, মার খাওয়া, জেলে যাওয়া, এসবের পাঠ তাঁদের ছিল না, পুরোটাই সরকার নির্ভর একটা দল হয়ে উঠেছিল। ক্ষমতা হারাতেই তাদের র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
আরও পড়ুন: Aajke | টেনে হিঁচড়ে তুলে তো দিল পুলিশ, কিন্তু তারপর?
উপর থেকে যাকে এক বিরাট শক্তপোক্ত সংগঠন মনে হত, বোঝা গেল তা ফোঁপরা। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। আমি আর রাজনীতিই করব না বলে বসে গেলেন কিছু কর্মী। মাথাদের দেখা গেল প্রচুর অসুখ। দু’ বছরের মধ্যে মাথাদের অনেকেই বিছানায় শয্যাশায়ী। আর চিহ্নিত যারা, কথায় কথায় মারধর করেছেন, এলসি অফিস, ব্র্যাঞ্চ অফিসে ডেকে অপমান করেছেন, তাঁদের একাংশ বিজেপির কাছে আশ্রয় নিলেন, কারণ? কারণ বিজেপি ক্ষমতায়, খুব দ্রুত বামেদের, বিশেষ করে সিপিএম আর সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্যই বিজেপি উঠে আসতে থাকল। আর এক বিরাট বাম বা সিপিএম ভোটার তৃণমূলকে হারাতে বিজেপিকে ভোট দিল, স্থানীয়, কোথাও কোথাও মাঝারি নেতাদের সায়ও ছিল। ঘর একবার ধসে গেলে তাকে দাঁড় করানো বড্ড শক্ত, সিপিএম এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। তার ঘুরে দাঁড়ানোর এক এবং এক মাত্র শর্ত হল বিজেপির চূড়ান্ত হার, একমাত্র তারপরেই সিপিএম বা বাম আবার ঘুরে দাঁড়ানোর জায়গা পেতে পারে। প্রশ্ন করতেই পারেন, তৃণমূল হারলে কী হবে? তৃণমূল হারলে কংগ্রেসের আবার একটা উত্থানের রাস্তা খুলে যেতে পারে, একমাত্র বিজেপির চূড়ান্ত হারই বামেদের আবার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রাক শর্ত। তৃণমূলের পক্ষে সবথেকে সুবিধেজনক অবস্থাটা কী? সামনে প্রবলভাবে বিজেপির অবস্থান, এবং রাজ্যের রাজনীতি বিজেপি বনাম তৃণমূল এই বাইনারিতে আটকে যাওয়া। বিজেপি বিরোধী ভোট, মুসলমান ভোট, সেকুলার ভোট, এবং তৃণমূলের নিজস্ব ভোট সবটা মিলে ৪৭-৪৮ শতাংশের বেশি হলে তৃণমূল হাসতে হাসতে ৪২-এ ৩৮-৪০টা আর ২৯৪-এ ২০০-২২০টা আসন পাবে। এটাই হিসেব তৃণমূলের আর সেটাই চেষ্টা করে যাচ্ছেন মমতা, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূল দল। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমাদের রাজ্যে রাজনৈতিক লড়াইটা কাদের সঙ্গে কাদের? সেটা কি বিজেপি বনাম তৃণমূল? নাকি বাম-কংগ্রেস বনাম তৃণমূল? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
অভিষেক তাঁর দলকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যা করার তাই করছেন, তাঁর প্রাইমারি লক্ষ্য বিজেপি, মোদি–শাহের সরকার, শুভেন্দু, সুকান্ত। তিনি লাগাতার তাঁদের বিরুদ্ধে, দিল্লি থেকে পাঠানো রাজ্যপালের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়ে বিজেপি বনাম তৃণমূল বাইনারিটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। বিজেপিও এক্কেবারে সেই খেলাটাই খেলছে, কমিউনিস্টদের পরে দেখা যাবে আপাতত লক্ষ্য তৃণমূল। ইডি, সিবিআই, মিছিল, সভা, মন্ত্রী সান্ত্রী এমনকী রাজ্যের পাওনা টাকা আটকে দিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। আর সিপিএম? তারা বিজেপির স্লোগানটাই আঁকড়ে ধরে চিৎকার করেই চলেছে, আর সেটিংয়ের গপ্পো শোনাচ্ছে। সেটিংয়ের গপ্পো লোকে শুনছে না কারণ তা বিশ্বাসযোগ্য নয় আর মমতা বিরোধিতা? তার জন্য তো ৭০-৭৭ এমএলএ-র দল বিজেপিই রয়েছে, সেটার জন্য সিপিএম-এর কী দরকার। কাজেই এ রাজ্যে আপাতত লড়াইটাকে বিজেপি বনাম তৃণমূল করে রাখতে অনেকটাই সফল অভিষেক, মন দিয়ে সেই কাজটাই করে চলেছেন।