এই বাংলাতে হিন্দু মহাসভার প্রথম অধিবেশনের সভাপতি মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দি জন্মেছিলেন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার এই কলকাতাতেই পড়াশুনো করেছিলেন, এই বাংলাতেই জন্ম কর্ম জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের, এই বাংলা ভক্তি আন্দোলনের দেশ, এই বাংলাতে হিন্দু ধর্ম পুনরুথ্বানের প্রথম মানুষ বিবেকানন্দের জন্ম কর্মভূমি। কিন্তু এতকিছুর পরে এই বাংলাতে সেই কোনকাল থেকেই এক চুড়ান্ত অসাম্প্রদায়িক সমাজ বেড়ে উঠেছে, তাঁরা এক সঙ্গে বসবাস করেছে, একে অন্যের উৎসবে আনন্দে মেতেছে, একে অন্যের পাশে থেকেছে, ব্যতিক্রম ছিল না? ছিল বৈকি, কিন্তু তা তো ব্যতিক্রম, নিয়ম তো নয়। তার কারণ কী? তার কারণ হল এখানকার ধর্ম প্রকৃত অর্থেই হিন্দু ধর্ম হয়ে উঠতে পেরেছিল।
কোনও মন্ত্রোচ্চারণ নেই, কোনও উপাচার নেই, কোনও পুরুত মৌলবী নেই, কেবল নাম গান করেও ধর্ম পালন করেছে এই বাংলার মানুষ। আর সেই মানুষজনের পাশেই, অদূরে এক দেবীকে কারণবারি, মদ মাংস দিয়ে পুজো করেছে আরেকজন, অন্যজন গান ধরেছে কালী নামে দাওরে বেড়া ফসলে তছরুপ হবে না, তো অন্যজন গলা মিলিয়েছে ছুন্যৎ করলে হয় মুসলমান, নারীর তবে কী হয় বিধান, বামন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি কেমনে? সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে? এক কবি লিখছেন মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, তো অন্যজন লিখছেন শক, হুণ, দল, পাঠান, মোগল এক দেহে হলো লীন। শৈশবে সন্ন্যাসী হতে চাওয়া সুভাষচন্দ্র বলছেন ‘‘সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠিয়েছে। ত্রিশূল ও গৈরিক বসন দেখলে হিন্দু মাত্রই শির নত করে। ধর্মের সুযোগ নিয়ে ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। হিন্দু মাত্রেরই তার নিন্দা করা উচিত।’’ সেই বাংলায় আজ শুভেন্দু, সুকান্ত, দিলু ঘোষের দল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ছড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন। কিন্তু মানুষের সমর্থন পাচ্ছেন না। সেটাই বিষয় আজকে বাংলায় মোদি–শাহ, আরএসএস–বিজেপির ঠাঁই নেই।
আরও পড়ুন: Aajke | শুভেন্দু অধিকারী এখন গোয়েন্দা দীপক কুমার
সেই বাংলাতে নতুন আপদের পুনরাগমন। সময়ের ব্যবধানে যেমন ব্যাকটিরিয়া জন্ম নেয়, পাপ ঘুরে ফিরে আসে, আবর্জনা ভেসে আসে জোয়ারের জলে ঠিক তেমনিই এ বাংলায় এসে হাজির হয়েছে সেই বিষান্ত চিন্তা ভাবনা ফেরি করনেওয়ালা লোকজন। মিথ্যে, ঘৃণা আর কুসংস্কার এই তিনটেকে হাতিয়ার করে এক লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপির নেতারা। রাজনৈতিক সামাজিক জীবনে বামেদের ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়া বিরোধী স্পেশ, সেই জনসমর্থনকে কাজে লাগিয়ে হঠাৎই ১৪/১৬ থেকে ৪০% ভোট পেয়ে যাবার পরে তাঁরা মনে করেছেন তাঁদের হাতে মুঠোয় এসে গিয়েছে বাংলা। কেবল যদি আদর্শের বিষয় হতো, কেবল যদি ঘৃণা, মিথ্যে আর কুসংস্কার দিয়েই তাঁরা এ বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতার দখল নিতে চাইতেন, তাহলে এত কথা বলার কোনও প্রয়োজনই হতো না। কিন্তু সেই অবিরাম মিথ্যে ঘৃণা আর কুসংস্কার ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আজ তাদের হাতে আছে রাষ্ট্র ক্ষমতা, যা দিয়ে তারা শাসক দলকে ভাঙতে পারে, দলের নেতাদের জেলে পুরতে পারে, টাকা দিয়ে পেটোয়া প্রচার মাধ্যম চালাতে পারে, এবং সমস্যাটা এই জায়গাতেই। এই বিপদকে চিহ্নিত করাটা খুব জরুরি। কাজেই তাঁরা যখন প্রচার করে এ রাজ্যে, এই বাংলাতে সরস্বতী পুজো করতে দেওয়া হয় না, দুর্গাপুজোতে বাধা দেওয়া হয়, তখন অবাক হয়ে আমরা দেখি মেইন স্ট্রিম মিডিয়া চুপ করে বসে থাকে। যখন তাঁরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে মুসলিম মৌলবাদী জঙ্গি বলে, তখন আমরা চুপ করে বসে থাকি। শুভেন্দু, সুকান্ত, দিলীপ ঘোষের দল এসব বুঝেই করছেন, এক বিরাট পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবেই এই চুড়ান্ত মিথ্যেগুলো ছড়ানো হচ্ছে। সেদিন সুভাষচন্দ্র বসু বুঝেছিলেন এই চক্রান্তের কথা, কেবল মুখে প্রচার করেন নি, যেখানে এই প্রচার করার চেষ্টা হয়েছে সেখানে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ সেই রুখে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেষ করেছিলাম, রাজ্যের নির্বাচিত মূখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের নেতা উগ্রপন্থী জঙ্গি বলছেন, অয়ানায়াসে এই প্রচার চলছে, এই মিথ্যে ঘৃণা প্রচার কে বন্ধ করতে হলে কী করা উচিত বলে আপনারা মনে করেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
সুভাষচন্দ্র বসু ধর্ম আর জাত-পাত নিয়ে ভণ্ডামি নিজের চোখে দেখেছিলেন। তিনি মাত্র সতেরো বছর বয়সে গ্রীষ্মের ছুটিতে হৃষিকেশ, হরিদ্বার, মথুরা, বৃন্দাবন, কাশী, গয়া প্রভৃতি স্থান বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানকার ধর্মীয় স্থানগুলিতে তিনি জাত বৈষম্য ও আচার-অনুষ্ঠানে জাতপাতের বিচার লক্ষ করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র দেখেছিলেন জল পিপাসা পেলে ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য জাতের মানুষকে কুয়ো থেকে জল তুলতে দেওয়া হয় না। বাঙালিরা মাছ খায় বলে বাঙালিদের অন্যত্র খেতে দেওয়া হত। এসব দেখে নেতাজি বলেছিলেন, “এঁরা অদৈতবাদের কথা বলেন, আবার কাজের সময় জাতপাতের বিরোধিতা করছেন – এ এক আশ্চর্য স্ববিরোধিতা।” গোবলয়ের সেই রাজনীতি বাংলাকে গ্রাস করতে চায়, তাদের দোসর এই বাংলারই কিছু বিশ্বাসঘাতক, তাদের চিহ্নিত করুন, তাদের জনবিচ্ছিন্ন করুন।