দুনিয়ার ইতিহাসে প্রায় সমস্ত শাসকের সিংহাসন ভেঙে পড়ে, গদি চলে যায়, এক নিরন্ধ্র নির্মম পতনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তারা। কোনও প্রতিপক্ষের জন্য নয়, কোনও বিরোধী শক্তির হঠাৎ উত্থানের জন্য নয়। বেশিরভাগ সময়েই তাদের নিজেদের বিরাট ভুলের মাসুল দেয় তারা, সুযোগ দেয় বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ হতে। হ্যাঁ, ইতিহাসে এমনটা বারবার দেখেছি আমরা। মস্কো থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ছিল হিটলারের ফৌজ, মস্কো দখল ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু হিটলার বললেন আগে স্তালিনগ্রাদ পরে মস্কো। ব্যস চাকা ঘুরে গেল, স্তালিনগ্রাদেও হারল, মস্কো দখল আর হল না বরং বার্লিনের পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল সেইদিনই। তারও আগে, হিটলার যদি রাশিয়াকে আক্রমণ না করে ব্রিটেন জয়ের পথে যেত, তাহলে হিটলারের জয় ছিল অবশ্যম্ভাবী, হ্যাঁ সমরবিদরা এরকমই বলেন, কিন্তু তিনি একই সঙ্গে হঠাৎ রাশিয়ায়কেও আক্রমণ করে বসলেন। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল মিত্রশক্তি, ব্রিটেন, রাশিয়া, আমেরিকা। সেদিনেই হিটলারের পরাজয় লেখা হয়ে গিয়েছিল। অত দূরে যাওয়ার দরকার কী? মনে আছে, এই তো মাত্র ক’বছর আগে, সিপিএম হঠাৎ ভারত-আমেরিকা পারমাণবিক চুক্তির বিরোধিতায় কংগ্রেসের সরকার ফেলে দেওয়ার কথা বলেছিল? প্রণববাবু বারবার বুঝিয়েছিলেন, কিন্তু তখন বুদ্ধবাবুর ভাষণ, ওরা উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে। এই বিভেদ কংগ্রেস আর তৃণমূলের ঐক্যকে হাতে করে গড়ে দিল, হ্যাঁ সেই দিনেই বাংলার রাজনীতিতে সিপিএমের বিদায় নিশ্চিত হয়েছিল। এরকম হয়। ঠিক সেরকম এক বাঁকে মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ভারতের রাজনীতি। গতকাল দিল্লিতে রাহুল গান্ধীর বাংলোতে ইন্ডিয়া জোটের নেতারা সব্বাই এক জায়গায়। অনেকদিন পরে হাজির অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সোশ্যাল মিডিয়াতে সেই ছবি ছড়িয়ে দিল তৃণমূলের কর্মীরা। হ্যাঁ জোট আবার চেহারা নিচ্ছে। সেটাই বিষয় আজকে, রাহুল, অভিষেক কাছাকাছি। বাংলার রাজনীতি বদলাবে?
বেশ কিছু মাস ধরে, বলা ভালো সেই ২০২৪-এর নির্বাচনের সময় থেকেই মনে হচ্ছিল যে ইন্ডিয়া জোটের ঘণ্টা বেজে গেছে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল আবার নতুন আশা জুগিয়েছিল, মনে হয়েছিল যে ২৪০-এ দাঁড়িয়ে থাকা বিজেপিকে ইন্ডিয়া জোট এবারে চেপে ধরবে। কিন্তু কংগ্রেস মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, দিল্লিতে যেভাবে জোট বিষয়টাকে একপাশে সরিয়ে রেখে চলা শুরু করেছিল, তাতে করে মনে হচ্ছিল কংগ্রেস আর ইন্ডিয়া জোট চায় না, কেবল সংসদে সামান্য বোঝাপড়া ছাড়া ইন্ডিয়া জোট মোটামুটি উবে গিয়েছিল। কিন্তু ওই যে আগেই বলেছি, শাসক বা শাসকদল বিরোধীদের এক জায়গাতে এনে দাঁড় করায়। মোদিজি সেটাই করেছেন, প্রথমে অপারেশন সিঁদুরকে এক রাজনৈতিক চাল হিসেবে ব্যবহার করে আর তারপরে নির্বাচন কমিশনের এই চূড়ান্ত কাঠপুতলি ব্যবহার বিরোধীদের কাছে দুটো পরিষ্কার মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: Aajke | ভোটার তালিকার সমীক্ষা ইত্যাদিতে তৃণমূলের একটা ভোটও কাটা যাবে না
১) মোদি অ্যান্ড কোম্পানি এক এক করে সমস্ত নির্বাচন কমিশন সমেত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দখল নিচ্ছে। ২) এই দখলদারির কাজটা শেষ হলে এই দেশে বিরোধিতার সামান্যতম কোনও জায়গা থাকবে না। হ্যাঁ, প্রত্যেক বিরোধী দল কিন্তু এটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। এ রাজ্যে উচ্চিংড়ের মতো সেটিং সেটিং বোলনেওয়ালারাও দিল্লিতে তা নিয়ে একটা শব্দও খরচ করে না, কারণ তাঁরাও জানেন এই সত্যিগুলো। ঠিক সেই কারণেই কাল দিল্লিতে ইন্ডিয়া জোটের ছবি দেখা গেল তা অনেকদিন পরে সত্যিই আলাদা। রাহুল গান্ধী নিজে ফোন করেছেন অভিষেককে, হ্যাঁ দুটো সদন মিলিয়ে ৪২ জন সাংসদের দলকে তো গুরুত্ব দিতেই হবে, আবার ফারুক আবদুল্লাকে নিজে এনে বসিয়েছেন সামনের আসনে। সোনিয়া গান্ধী নিজে প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। কেবল তাই নয় পাটনাতে মহাগঠবন্ধনের জমায়েতে আসার জন্য মমতা অভিষেককে আলাদা করে অনুরোধ করেছেন সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী। হ্যাঁ স্বৈরতন্ত্র এভাবেই বিরোধীদের এক মঞ্চে এনে দাঁড় করায় সেই ছবি আমরা দেখছি। এমনিতে মোদিজি কি খুব স্বস্তিতে আছেন? এক্কেবারেই নয়। একদিকে দেশের মধ্যে বিরোধীদের সরব হওয়া, অন্যদিকে অপারেশন সিঁদুরের আবেগ না জাগাতে পারা, আর আমেরিকার ট্রাম্প ট্যারিফ তো আছেই। তাই সেরকম একটা মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী এক নতুন বার্তা আনছে বইকী। কিন্তু সেই ঐক্যবদ্ধ কংগ্রেস তৃণমূল কংগ্রেস কি আগামী ২৬-এর নির্বাচনের সমীকরণ পাল্টে দেবে। এখনও বেশ কিছু পকেটে কংগ্রেসের সংখ্যালঘু ভোট আছে, সেই ভোট যোগ হলে গোটা ১৪ আসনে ফলাফল বদলে যাবে। এখনই ততটা নিশ্চিত না হলেও একটা কথা তো বলাই যায় যে রাজ্য রাজনীতির সমীকরণও এক বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে। হ্যাঁ অভিষেক–রাহুলের দোস্তি সেই কথা বলছে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে রাহুল গান্ধী, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাছাকাছি দেখা গেল। কংগ্রেস এমনিতেই এ রাজ্যে আগের উটকো বিরোধিতার জায়গা থেকে সরে এসেছে। যদি তৃণমূল কংগ্রেস আর কংগ্রেস জোট হয় তা আগামী ২৬-এর নির্বাচনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হবে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
অনেকদিন আগে পিকে একটা কথা বলেছিলেন, বিজেপি তার সামর্থ্যের চূড়ায় পৌঁছে গেছে। এবার নীচে নামার পালা, এবারে দেশজুড়েই যেখানে বিজেপি শক্তিশালী সেখান থেকেই তার পতন শুরু হবে। বিজেপির পক্ষে কেরালা ছাড়া নতুন কোনও অঞ্চলে আর বেড়ে ওঠা সম্ভব নয়। হ্যাঁ, সেই নীচে নামার পালা শুরু হয়েছে, একদিকে যেমন মোদি অ্যান্ড কোম্পানির প্রতিটা কাজ এখন তাদের জন্য নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করছে, অন্যদিকে বিরোধী দলগুলোকে এক মঞ্চে এনে দাঁড় করাচ্ছে। সামনের দিনগুলো ভারতীয় রাজনীতির নতুন সমীকরণ এনে হাজির করবে, আজ বলছি মিলিয়ে নেবেন।