২০১৯-এর নির্বাচনের আগে এবং পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখলেই বিজেপি কর্মীরা জয় শ্রীরাম বলে হাঁক দিত, মমতা ধৈর্য হারাতেন, সোজা বাংলায় খেপে যেতেন। বার দুই গাড়ি থেকে নেমে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন, যেসব ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল বা ভাইরাল করা হয়েছিল আর সেসবের সঙ্গেই বিজেপির প্রচার ছিল দেখেছেন মমতা হিন্দু বিরোধী। ঘটনার পরে বা এই প্রচার চলাকালীন তৃণমূল বা তৃণমূল নেত্রীর তরফে এর ক্লারিফিকেশন, এর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, আমরা তো সীতারাম বলি, ওইভাবে কেউ জয় শ্রীরাম বলে নাকি? এ তো এক যুদ্ধ হুঙ্কার ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এটা ঘটনা যে এক বিরাট সংখ্যক মানুষ এটাকে মেনে নেয়নি, অনেকেই বলেছিল যে এই ধরনের আচরণ কাম্য নয় ইত্যাদি। কিন্তু আমরা দেখেছিলাম খুব তাড়াতাড়িই এই ভুল শুধরে নিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর গাড়ি যাচ্ছে, ওই বিজেপি কর্মীরা জয় শ্রীরাম বলে হুঙ্কার দিচ্ছে বটে কিন্তু মমতা কর্ণপাত করছেন না। হ্যাঁ, এটাই হল এক প্রকৃত রাজনৈতিক নেতা যিনি কিছু করেন, আবার সেটাকে শুধরে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। মমতা এটা আরও সহজেই পেরেছিলেন কারণ তিনি তো সত্যিই হিন্দু বিদ্বেষী নন, বরং হিন্দু দেবদেবী পুজোয় সর্বত্রই তাঁকে একটু বেশিই দেখা যায়। অন্তত ৩৪ বছরের জ্যোতি–বুদ্ধ শাসনের পরে তো এই বিপরীত ছবিটা বেশ চোখে পড়ে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেরকমই একটা ভাইরাল স্লোগানের ফাঁদে পা দিয়েছেন বিজেপি নেতারা, বিশেষ করে শুভেন্দু অধিকারী আর সেটাই বিষয় আজকে, বিজেপি নেতারা জয় বাংলা শুনলে খেপে যাচ্ছেন কেন?
ক্রিকেটে স্লেজিং কথাটা খুব প্রচলিত। বিষয়টা হল ব্যাটসম্যানকে উত্তেজিত করা, উত্যক্ত করা। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের এই ব্যাপারে এক অসম্ভব দক্ষতার কথা অনেকেই জানেন। এরকম এক ঘটনা মনে পড়ছে, ইংল্যান্ডের অ্যান্ড্রিউ ফ্রেডি ফ্লিনটফ সমানে বাজে কথা বলেই যাচ্ছিলেন, উত্যক্ত করার চেষ্টা করছিলেন যুবরাজ সিংকে। যুবরাজ জবাবে বলেন, “I’ll hit you out of the ground.” ফ্লিনটফ উত্তরে বলেন: “Come on then, show me what you’ve got.” তারপর যুবরাজ ব্রডকে এক ওভারে ৬টা ছক্কা মারেন। হ্যাঁ এইটা হল স্লেজিং এর আসল জবাব।
আরও পড়ুন: Aajke | বঙ্গ বিজেপি পড়েছে চরম বিপদে, ভুল বকছেন নেতারা
রাজনীতিতেও এই স্লেজিং চলে, ট্রোলিং চলে সোশ্যাল মিডিয়াতে। আসলে আপনাকে উত্যক্ত করার জন্য, ফাঁদে পা দিয়েছেন কি মরেছেন। একটা ভিডিও তো ভাইরাল হয়ে গেছে, যেখানে শুভেন্দু অধিকারীর গাড়ি যাচ্ছে এবং কোনও পরিচিত নেতা নন, খুব সাধারণ তৃণমূল সমর্থক পাশ থেকে ক্রমাগত জয় বাংলা জয় বাংলা বলে চেঁচিয়েই যাচ্ছিল। জানি না কেন এসি গাড়ির দরজা খুলে কনভয় থামিয়ে শুভেন্দু অধিকারী নেমে এলেন তারপর প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে নিজেকেই হিন্দুর বাচ্চা বললেন, এর আগে মোদির বাচ্চা বলেছিলেন, এবার স্প্রেকটামটা একটু বড় হল, এই যা। একবার নয় পাঁচ ছ’বার তাঁর দেহরক্ষীকে বললেন ভাগাও উসকো। কেন? কারণ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে সেই তিনি জয় বাংলা বলছিলেন। তারপর যা বললেন তা হাস্যকর এবং ভয়ঙ্কর। শুভেন্দুবাবু ওনাকে রোহিঙ্গা বললেন। হ্যাঁ, এইখানেই আর এক কেলো, হঠাৎ কী দেখে উনি রোহিঙ্গা চিনলেন? আমাদের জানা নেই কিন্তু রোহিঙ্গা শব্দটাও তিনি বার পাঁচেক বলেছেন। না সেরকম কিছু হয়নি, হতেই পারত, আরও বেশি লোক জড়ো হয়ে আরও জোরে জয় বাংলা বলতেই পারত, আর তার ফলে হাতাহাতি হতেই পারত, সেই হাতাহাতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াত তা তো কারও জানা নেই। কিন্তু যেটা হয়ে গেল সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ, মিলিয়ে নেবেন। এরপরে আমাদের ওই কাঁথির মেজো খোকাবাবু যেখানেই যাবেন সেখানেই জয় বাংলা স্লোগান উঠবে, উঠবেই। আর সমস্যা হল উনি এই জয় বাংলা কথাটাকে খুব সহজে মেনে নিতে পারবেনও না। পারবেন না কারণ ওনার মাথায় জয় বাংলা মানে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানেই মুসলমান আর এখন মুসলমানের নতুন প্রতিশব্দ হল রোহিঙ্গা। আর এই গোটা তত্ত্ব শুভেন্দু অধিকারী বিশ্বাস করেন, কাজেই এই পিছনে লাগা বন্ধ হবে না এবং আমরা এই হঠাৎ হঠাৎ খেপে যাওয়া ভিডিও হাতে পাব। আবার একটা ঘটনা নিশ্চিতভাবেই অন্য আর একটা ঘটনাকে উসকে দেবে। গোবিন্দপুরের ঘনা পেরেছে কাজেই নিশ্চিন্দিপুরের ভোলাও সেটা ট্রাই করবে। হ্যাঁ, যে মানুষ খেপে যায়, তাকে খ্যাপানোর লোক এমনিতেই জুটে যায় আর এ তো রাজনীতি। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইদানিং বিজেপির নেতারা জয় বাংলা বললে খেপে যাচ্ছেন কেন? গাড়ি থেকে নেমে তাড়া করছেন কেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
এই বছরের ২১ জুলাই মঞ্চে দাঁড়িয়েই অভিষেক একটা কথা বলেছেন, জয় শ্রীরাম থেকে জয় মা কালী, জয় দুর্গা বলিয়েছি, ২০২৬-এর পরে জয় বাংলা বলিয়ে ছাড়ব। হ্যাঁ, এটা একটা রাজনৈতিক পরিকল্পনাও বটে। বাংলা বাঙালি নিয়ে সারা দেশে যা হচ্ছে তাতে করে মানুষ আরও আরও বেশি করে এই জয় বাংলাকে আত্মস্থ করবেন, বিজেপি তার বিরোধিতা করতে থাকলে এ এক নতুন মেরুকরণ গড়ে তুলবে। এই মাত্র গতকাল শুনলাম পুরুলিয়া শহরে নাকি এক শ্মশানে মারোয়াড়িদের এতটাই আধিপত্য যে সেখানে বাঙালিদের ঢুকতেই দেওয়া হয় না। এখন কিন্তু এই ছোট ছোট ইস্যুগুলোই উঠে আসবে আর লোকাল লেভেলে নতুন করে রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করবে। মমতা পেরেছিলেন ওই জয় শ্রীরাম হুঙ্কারকে অবজ্ঞা করতে, বিজেপি নেতারা কি পারবেন জয় বাংলা স্লোগানের পাল্টা কোনও ন্যারেটিভ গড়ে তুলতে?