শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় গোয়ার জহওরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে এস সি ইস্ট বেঙ্গল যখন এটিকে মোহনবাগানের মুখোমুখি হবে তখন তাদের সঙ্গে না থাকবে অতীত, না বর্তমান। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত আই এস এল ডার্বিতে দু দলের লড়াই হয়েছে তিন বার। তিনবারই জিতেছে মোহনবাগান। এ বছরের এটি দ্বিতীয় ডার্বি। প্রথম ডার্বিতে মোহনবাগান জিতেছিল ৩-০ গোলে। তাই অতীত ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে নেই। আর বর্তমান? আই এস এল-এর শেষ ম্যাচে ইস্ট বেঙ্গল চার গোলে হেরে গেছে হায়দরাবাদ এফ সি-র কাছে।
এ রকম ছন্নছাড়া ইস্ট বেঙ্গলের বিরুদ্ধে শনিবারের ডার্বিতে তাই মোহনবাগানই ফেভারিট। তারা যদি না জিততে পারে সেটাই হবে বিরাট অঘটন। তবে যতই পিছিয়ে থাকুক ইস্ট বেঙ্গল, তাদের কোচ মারিও রিভেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন টিমটাকে চাগাবার। এই দলের বেশির ভাগ প্লেয়ারের কাছে কলকাতা ডার্বির মাহাত্ম্য অজানা। রিভেরা তাই ছেলেদের দেখাচ্ছেন সল্ট লেক স্টেডিয়ামের বেশ কিছু ডার্বির ভিডিও। মাঠ ভরা দর্শকের সামনে ডার্বিতে ইস্ট বেঙ্গল যখন মোহনবাগানকে হারাত তার ভিডিও দেখে এখনকার লাল হলুদ ফুটবলাররা উজ্জীবিত হন কি না তা সময়ই বলবে। কারণ আন্তোনিও পেরোসেভিচ, ফ্রানিও পার্সে, ড্যারেন সিডিওল কিংবা নতুন ব্রাজিলয়ান মার্সেলোরা এবারের লিগে যা হত কুৎসিত ফুটবল খেলছেন তাতে পুরনো ম্যাচের ভিডিও দেখে কতটা উজ্জীবিত হবেন তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। মারিওর কাছে ডার্বি অবশ্য নতুন নয়। কোয়েস ইস্ট বেঙ্গলের সহকারি কোচ হিসেবে তিনি ডার্বি ম্যাচে ডাগ আউটে বসেছেন। তবে নিজে যখন চিফ কোচ হলেন তখন করোনার কারণে ডার্বি হয়নি। সেই অর্থে টিমের হেড স্যর হিসেবে মারিওর এটা প্রথম ডার্বি।
সাংবাদিক সম্মেলনে মারিও খুব সততার সঙ্গে স্বীকার করে নিয়েছেন, “মোহনবাগানের আ্যাটাক খুবই শক্তিশালী। গোল করার প্রচুর লোক আছে ওদের। আমাদের ডিফেন্সকে খুবই ভাল খেলতে হবে।” পাশাপাশি তাঁর দাবি, “মোহনবাগান অ্যাটাককে রোখার ক্ষমতা আছে আমাদের টিমের। সেটা ওরা করে দেখাবার ব্যাপারে খুবই উদগ্রীব।” শেষ পর্যন্ত মোহনবাগানের অ্যাটাককে আটকাতে পারবে কি না ইস্ট বেঙ্গল ডিফেন্ডাররা সেটা সময়ই বলবে। কিন্তু মোহনবাগান আ্যাটাক যে খুবই ভাল তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। করোনার জন্য মোহনবাগানের তিনটে ম্যাচ বাতিল হওয়ার পর মাত্র একটা ম্যাচ হয়েছে। তাই ইস্ট বেঙ্গল যেখানে খেলে ফেলেছে তেরোটা ম্যাচ, মোহনবাগান সেখানে দশ। এবং তাদের পয়েন্ট এখন ১৬। তারা লিগ টেবলে আছে আট নম্বরে। ডার্বি জিততে পারলে মোহনবাগান পৌছে যাবে প্রথম চারের মধ্যে। তাদের দলে গোল করার লোক অনেক। হুগো বুমো, রয় কৃষ্ণ, ডেভিড উইলিয়ামস, লিস্টন কোলাসো এবং মনবীর সিং। এই পাঁচজনই নিয়মিত গোল করছেন। বুমোর গোল সংখ্যা পাঁচ, কোলাসোরও তাই। রয় কৃষ্ণর গোল চারটি, ডেভিড উইলিয়ামস এই বছর খুব বেশি খেলার সুযোগ পাননি। তাঁরও ১২ সেকেন্ডে গোল করার রেকর্ড আছে। মনবীরের গোল দুটি। এ রকম স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়ে কোনও টিম ম্যাচের পর ম্যাচ না জিতে ফিরতে পারে না। আর ইস্ট বেঙ্গলের অবস্থা তো খুবই খারাপ। তেরো ম্যাচে ২৫টা গোল খেয়ে বসে আছে। পয়েন্ট টেবলে সবার নীচে তারা। সেই টিমের বিরুদ্ধে মোহনবাগানের গোল না পাওয়াটাই অঘটন হবে।
ইস্ট বেঙ্গল ডিফেন্সের এক নম্বর লোক হলেন আদিল শেখ। প্রাক্তন কোচ ম্যানুয়েল দিয়াজ তাঁকে খেলাতেনই না। প্রথমে রেনেডি সিং এবং পরে মারিও রিভেরা তাঁকে প্রথম একাদশে জায়গা দিয়েছেন। আদিল খুব খারাপ খেলছেনও না। তবে তাঁর খেলায় ধারাবাহিকতার অভাব। দুঃখের হলেও একথা মানতে হবে, ইস্ট বেঙ্গলের মতো ঐতিহ্যশালী দলের এক নম্বর ডিফেন্ডার হিসেবে তাঁকে মানাচ্ছে না। কিন্তু এখন এ সব ভেবে লাভ নেই। আদিলকে নিয়েই চলতে হবে। তাঁর পাশে ফ্রানিও পার্সেকেও খুব বেশি নম্বর দেওয়া যাবে না। নির্ভরযোগ্য বলা মুশকিল। কখন যে বল গলিয়ে দেবেন কেউ জানে না। তবু মন্দের ভাল হীরা মণ্ডল। এখন পর্যন্ত যা খেলছেন তাঁর উপর নির্ভর করা যায়। লেফট ব্যাকে হীরার মতো না হলেও রাইট ব্যাক অমরজিৎ সিং যে খুব দরের বলা যাবে না। কাজ চালানোর মতো। এই ডিফেন্স এবং অরিন্দম ভট্টাচার্যের মতো খুবই বাজে ফর্মে থাকা গোলকিপার নিয়ে ইস্ট বেঙ্গল যদি গোল না খাওয়ার কথা ভাবে তাহলে তাদের নিজেদেরকেই ছাপিয়ে যেতে হবে।
মোহনবাগান কোচ জুয়ান ফেরান্দোর এটি প্রথম ডার্বি। এই ম্যাচের গুরুত্ব বুঝতে তিনি বিস্তর পড়াশোনা করেছেন। তবে তাঁর ফুটবলারদের সেই অসুবিধে নেই। তিন ক্যাপ্টেনে একজন প্রীতম কোটাল এই ম্যাচ অনেকবার খেলেছেন। রয় কৃষ্ণ, ডেভিড উইলিয়ামস কিংবা মনবীর সিংরাও তাই। তাদের গোলও আছে এই ম্যাচে। কিন্তু ফরাসি মিডফিল্ডার হুগো বুমো এই ম্যাচে গোল করতে মরিয়া। বার বার বলছেন, ” জিততেই হবে এই ম্যাচ। আমি গোল করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।” বুমো দীর্ঘ দিন মাঠের বাইরে। ম্যাচ খেলার জন্য তিনি তো মরিয়া হবেনই। আরেক জনের কথাও বলতে হবে। তিনি হলেন লিস্টন কোলাসো। এই গোয়ান এ বছর খুবই ভাল খেলছেন। পাঁচটা গোলও আছে। রয় কৃষ্ণ মোহনবাগানের এক নম্বর স্ট্রাইকার ছিলেন। তবে সেটা গত বছর পর্যন্ত। এখন তাঁর মতো গোল করার লোক মোহনবাগানে একাধিক আছে। এতে কৃষ্ণের উপর থেকে চাপটা অনেকটাই কমে গেছে। সেই সুবিধেটা তিনি নিতে পারেন কি তাই দেখার।
মোহনবাগানের সমস্যা হচ্ছে তাদের ডিফেন্স। গোলকিপার অমরিন্দর সিং খুবই বাজে ফর্মে। কখন গোল খাবেন কেউ জানে না। ডিপ ডিফেন্সে তিরি ছাড়া আর কারুর উপর ভরসা করা যায় না। প্রীতম কোটাল কিংবা শুভাশিস বসুরা তাদের সেরা খেলা এখনও খেলতে পারেননি। সন্দেশ ঝিঙ্গন সবে দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। তাঁকে শুরু থেকে নামানো হয় কি না তাই দেখার। কিন্তু মোহনবাগান ডিফেন্সের এই দুর্বলতা কাজে লাগানোর জন্য কি আন্তোনিও পেরোসেভিচরা যথেষ্ট? মনে হয় না। ব্রাজিলের স্ট্রাইকার মার্সেলো একেবারে অপরিচিত। তিনি কতটা কী করতে পারবেন অনুমানের বিষয়। তাই মহম্মদ রফিক, নাওরেম মহেশ, সৌরভ দাস কিংবা সেম্বই হাওকিপরা কি পারবেন গোল করতে? হয়তো পারবেন, হয়তো পারবেন না।
কিন্তু ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগে শনিবারের ডার্বিতে মোহনবাগানকেই এগিয়ে রাখতে হবে।