এটিকে মোহনবাগান–২ হায়দরাবাদ এফ সি–১
(লিস্টন কোলাসো, মনবীর সিং) (জোয়েল চাইনিস)
প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক নেভিল কার্ডাস একবার বলেছিলেন, স্কোরবোর্ড একটা গাধা। ক্রিকেটের স্কোরবোর্ড নিয়েই ছিল কথাটা। এবং একশো বছর পরেও কথাটা সত্যি। মঙ্গলবারের আই এস এল ম্যাচটা দেখতে দেখতে কার্ডাসের সেই অমোঘ কথাটা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল। স্কোরলাইন দেখে বোঝা যাবে না বিরতির পর কী দাপট নিয়ে খেলেছে মোহনবাগান। তাদের গোল দুটি হয়েছে ৫৬ আর ৫৯ মিনিটে। কিন্তু এর পরেও তারা অনেক গোল করতে পারত। ম্যাচের সেরা লিস্টন কোলাসৌ ৫৬ মিনিটে একটা চমৎকার গোল করলেন। ম্যাচের শেষ দশ মিনিটে দুটো সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট না করলে কিয়ান নাসিরির মতো তাঁর হ্যাটট্রিক হয়ে যেত। ৫৯ মিনিটের গোলটা মনবীরের। বেশ ভাল গোল। কিন্তু এর বাইরে মিস তো করেছেন তিনিও। ৩২ মিনিটে চোট পেয়ে বসে গেছেন হুগো বুমো। ফাঁকা গোলে বল রাখতে পারেননি তিনিও। সব মিলিয়ে যা দাঁড়াল তাতে একটা কথা বলাই যায়, টুর্নামেন্টের সেরা দলের বিরুদ্ধে সেরা ম্যাচ খেলল মোহনবাগান। প্রশংসা করতে হবে তাদের কোচ জুয়ান ফেরান্দোর। তাঁর আমলে সাতটা ম্যাচে অপরাজিত টিম। এর মধ্যে জয় চারটে। তেরো ম্যাচে ২৩ পয়েন্ট নিয়ে মোহনবাগান উঠে এল চার নম্বরে। এই রকম খেলে যেতে পারলে তাদের প্লে অফ খেলা তো আটকাবেই না। আরও বেশি দূর এগোতে পারে জুয়ানের টিম। সেই সামর্থ্য তাদের আছে।
৩২ মিনিটে হুগো বুমো আর তার পাঁচ মিনিট পরে কার্ল ম্যাকহিউ চোট পেয়ে বসে যাওয়ার পর জনি কাউকো আর কিয়ান নাসিরিকে নামালেন জুয়ান। টিমে এখন ফিট বিদেশি প্লেয়ার পাঁচজন। তাই ম্যাকহিউর পরিবর্তে কিয়ানকে নামাতে হল। তখন আশঙ্কা হচ্ছিল দুই সেরা বিদেশির অনুপস্থিতি কি মানিয়ে নিতে পারবে মোহনবাগান? আশঙ্কা অমূলক। মোহনবাগান শুধু পারলই না, শেষ ৪৫ মিনিট তারা ফালা ফালা করে দিল হায়দরাবাদকে। খুঁজেই পাওয়া গেল না তাদের ভয়ঙ্কর স্ট্রাইকার ওগবেচেকে, যিনি এবারের টুর্নামেন্টে ১৪টা গোল করে টপ স্কোরারের পুরস্কারটা প্রায় পেয়েই গেছেন। এদিন ছিল তাঁর আই এস এল-এ পঞ্চাশতম গোলের দিন। ৪৯ গোলের মালিককে সেই সুযোগ দিলে তো মোহনবাগান ডিফেন্স। এখন তো আর ম্যান মার্কিং ফুটবল হয় না। ওগবেচেকে তাই জোনাল মার্কিং করল বাগান ডিফেন্স। শূণ্যে কিংবা জমিতে তাঁকে কড়া প্রহড়ায় রাখলেন প্রীতম কোটাল আর তিরি। কত বার যে ওরা দুজন ওগবেচের পায়ের গ্রাস কেড়ে নিয়েছেন তা গুণে শেষ করা যাবে না। ওগবেচেকে নিষ্প্রভ করে দেওয়ায় হায়দরাবাদের আক্রমণ অনেক জোলো হয়ে যায়। তারা উইং ধরে চেষ্টা করেছিল আক্রমণের। বেশ কিছু উদ্বেগজনক মুহূর্ত তেঋই হয়েছিল বাগান বক্সের মধ্যে। কিন্তু এদিন যেন অমরিন্দর প্রতিজ্ঞা করে নেমেছিলেন তিন পয়েন্ট নিয়েই মাঠ ছাড়ব। একটা গোল তাঁকে খেতে হয়েছে। মাঠের সর্বকণিষ্ঠ প্লেয়ার রোহিত দানুর শট তাঁকে দাঁড় করিয়ে রেখে ক্রস পিসে লেগে ফিরে আসে। সবই ঠিক কথা। কিন্তু এর বাইরে অমরিন্দর অনেক গোলও বাঁচিয়েছেন। আসলে এ রকম একটা হেভিওয়েট টিমের বিরুদ্ধে জিততে হলে এগারোজনকেই তো নিজেদের উজাড় করে দিতে হয়। অমরিন্দরও সেই সেরাদের মধ্যে অবশ্যই থাকবেন।
মোহনবাগান টিমটা তো বেশ ভাল। জায়গায় জায়গায় ভাল প্লেয়ার। বুমো ও কার্ল ম্যাকহিউ বসে গেলে কী হবে কোচের চমৎকার কোচিং টিমের ব্যালান্স নষ্ট হতে দেয়নি। ডেভিড উইলিয়ামসকে মাঝ মাঠে নিয়ে এসে কিয়ান নাসিরিকে ফরোয়ার্ড করে দিলেন জুয়ান। আর কী পাসটাই না বাড়ালেন উইলিয়ামস। নিজেদের অর্দ্ধ থেকে ৪৯.৮ মিটারের একটা ওভারহেড লব করলেন উইলিয়ামস। ওই লবটাই গোটা হায়দরাবাদ ডিফেন্সকে টলিয়ে দিল। বাঁ দিক দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে বলটা ধরে খানিকটা এগিয়ে বক্সে ঢুকে লিস্টন কোলাসো ডান পায়ে ফিনিশ করলেন। হায়দরাবাদ গোলকিপার কাট্টিমণিও বেশ ভাল খেলেছেন। অনেক শটও বাঁচিয়েছেন। কিন্তু লিস্টনের শটটার সময় তাঁকে বেশ অসহায় লাগছিল। তিন মিনিট পরেই দ্বিতীয় গোল। এবার আক্রমণ ডান ডিক থেকে। বলটা বাড়ালেন জনি কাউকো। মনবীর বল ধরে ভেতরে ঢুকে ইন সাইড আউট সাইড করে দুই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে একদম ফাঁকায় পেয়ে গেলেন কাট্টিমণিকে। আলতো পুশ এবং ম্যাচ ২-০। এই জায়গা থেকে ম্যাচে ফিরে আসা মুশকিল। কিন্তু নাছোড়বান্দা হায়দরাবাদ একটা গোল শোধ করল। জোয়াও ভিক্টরের শট অমরিন্দর কোনও রকমে বাঁচালে বল চলে যায় জোয়েল চাইনিসের কাছে। এই অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ড বাঁ পায়ের জোরালো ভলিতে ১-২ করলেন। ম্যাচের তখন ৭৫ মিনিট। হায়দরাবাদ প্রবল শক্তিতে ঝাঁপাল। কিন্তু মোহনবাগান ডিফেন্সও তাদের জায়গা দেয়নি। উল্টে দ্রূত কাউন্টার আ্যাটাকে মোহনবাগান যতবার এগিয়েছে দুই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার জুয়ানন এবং চিঙ্গলসানা সিং অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। ফল? ফাঁকা গোল। কিন্তু লিস্টন-মনবীররা বল তিন কাঠির মধ্যে রাখতে পা পারলে কী হবে? লিস্টন তো একবার গোলকিপারকে কাটিয়েও বল বারের উপর দিয়ে তুলে দিলেন। আর এক বার ফাঁকা গোলে মারতে গিয়ে মারলেন পোস্টের বাইরে। এ সবই অবশ্য খেলার অঙ্গ। বলার যেটা তা হল মোহনবাগনকে ক্রমশ ভয়ঙ্কর লাগছে। আবার বলছি, এই ফর্ম ধরে রাখতে পারলে অনেক সম্মান অপেক্ষা করছে জুয়ান ফেরান্দোর টিমের।