তাঁর অগণিত ভক্তদের মধ্যে কয়েকজন মহিলা ফুলের তোড়া নিয়ে গল্ফগ্রীনে বাড়ির বাইরে সকাল থেকে অপেক্ষা করে আজ ফিরে গেলেন। মৃত্যুর পর অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আজ দ্বিতীয় জন্মবার্ষিকী। কিন্তু করোনা সংক্রমনের জন্য বাড়িতে কোনো কিছুরই ব্যবস্থা করতে পারেননি বলে সৌমিত্র-কন্যা পৌলমী জানালেন। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী অসুস্থ সৌমিত্র-নাতি রনোজয় দুবার কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন। যে কারণে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন পৌলমী।শুনশান তাঁর বাড়ি। অবশ্য সৌমিত্র স্মরণে বিভিন্ন ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সারাদিনই অংশগ্রহণ করবেন সৌমিত্র-পুত্র সৌগত এবং পৌলমি। বেঁচে থাকলে আজ ৮৭ তে পা দিতেন বর্ষীয়ান অভিনেতা। বর্ষীয়ান অভিনেতাকে জন্মবার্ষিকী শ্রদ্ধা জানিয়েছেন টালিউড নায়ক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি লিখেছেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তার সৃষ্টির মধ্যেই চিরদিন বেঁচে থাকবেন। তিনি অবিস্মরনীয়। তাঁর মৃত্যু টলি ইন্ডাস্ট্রিকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। এক অপূরণীয় ক্ষতি। সৌমিত্রবাবুর একটি তরুণ বয়সের সাদাকালো ছবি এবং বেশি বয়সের একটি রঙিন ছবি পাশাপাশি পোস্ট করে ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন,’ভালো আছো তো সৌমিত্র কাকু? আমি নিশ্চিত ওখানে সবাইকে তোমার ফাইটিং স্পিরিট শিখিয়ে দিয়েছো। প্রণাম নিও’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ৩৯ টি ছবিতে অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ। দুই সুপারস্টারের সম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত।

এই আইকনিক অভিনেতার চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না আপামর বাঙালি।অভিনেতার মৃত্যুর পরপরই মারা গিয়েছিলেন স্ত্রী দীপা। জন্মদিন পালন করাটা এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতার কাছে ‘আদিখ্যেতা’ ছাড়া কিছু মনে হত না। জীবিতকালে অনুরাগীরা তাঁর বাড়িতে অনেকেই পুষ্পস্তবক নিয়ে উপস্থিত হতো। ফুলের তোড়া হাতে গ্রহণ করে পাশে সরিয়ে দিতেন তিনি। কাছে টেনে নিতেন উপহার পাওয়া বই। একবার এক অনুরাগী তাকে জন্মদিনে লন্ডনের মিউজিয়াম থেকে আনা ফ্রেমবন্দি ভ্যান গগের আঁকা একটি বড় ছবির প্রিন্ট কপি উপহার দিয়েছিলেন। প্রিয় চিত্রশিল্পীর সেই ছবি পেয়ে তিনি বলেছিলেন, “জন্মদিনের আদিখ্যেতায় মন ভালো করা উপহারও পাওয়া যায়”। আসলে বাঙালির কাছে তিনি একজন শুধু অভিনেতা নন। একজন কবি,নাট্যকার, লেখক, পরিচালক,বাচিক শিল্পী এমনকি চিত্রকরও বটে। তাঁর প্রিয় শহর কলকাতায় তিনি ছিলেন একজন আদ্যোপান্ত বাঙালি। দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার বিজয়ী অভিনেতা সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার ছবি দিয়ে শুরু করেছিলেন নিজের কেরিয়ার। বিশ্ববরেণ্য পরিচালকের সঙ্গে অনেক ছবি করেছিলেন তিনি। বাঙালির মনে আজও গেঁথে বসে আছে ফেলুদা।
জন্মদিনের স্মৃতিচারণ করে সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায় বলেছেন ‘বাবার কাছ থেকে যখনই তিনি স্ক্রিপ্ট পেতেন তারপর থেকে শুরু হয়ে যেত সৌমিত্রকাকুর হোমওয়ার্ক। তাছাড়াও বাবার স্ক্রিপ্ট রিডিং অত্যন্ত মন দিয়ে তিনি শুনতেন। আর তাতেই নাকি অভিনেতার কাছে ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে যেতো। অভিনয়ের ক্ষেত্রে বাবা সৌমিত্রকাকুকে অনেকটাই স্বাধীনতা দিতেন।’ একটি মজার ঘটনা শেয়ার করে সন্দীপ জানালেন, ‘অশনি সংকেত’ ছবির আউটডোর শুটিং চলছে। সেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখা গিয়েছিল অন্যান্য টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে তিনি ট্রলি ঠেলছেন। যা দেখে স্বয়ং পরিচালক আঁতকে উঠেছিলেন।
বাবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মত কবিতা লেখায় আগ্রহ তৈরি হয়েছিল ছেলে সৌগতর। বাবার জন্মদিনে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেছেন কবিতা ছাড়াও আন্তর্জাতিক নাটকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল বাবার মারফত। অনেক নাট্যকারের বই পেয়েছিলেন সৌগত বাবার কাছ থেকেই। অন্যদিকে পৌলমী ছোট বয়স থেকে নৃত্য শিক্ষা নিলেও পরবর্তীকালে বাবার সঙ্গে মঞ্চের কাজেই পুরোপুরি মনোনিবেশ করেছিলেন বলে স্মৃতিচারণে জানালেন। বললেন,’বাপি আমাদের বলেছিলেন নিজের দেশকে আগে ভালো করে জানো। উনি আমাদের সবাইকে বিভিন্ন চিত্র প্রদর্শনীতে নিয়ে যেতেন। একসঙ্গে থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম মঞ্চ-অভিনয় ছিল তাঁর আসল আকর্ষণ। আমরা বাবা-মা দু’জনকেই স্টেজে অভিনয় করতে দেখেছি। আমার নিজেরও স্টেজ থিয়েটারে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। থিয়েটারে বাবার ডেডিকেশন দেখে আমি অবাক হয়ে যেতাম। শোয়ের দিন সবার আগে বাপি স্টেজে পৌঁছতেন। থিয়েটারই ছিল তার প্রথম প্রেম।’