Placeholder canvas

Placeholder canvas
HomeকলকাতাSasthipada Chattopadhyay: নিজের মধ্যে বাবলুর ছায়া দেখার অবসান

Sasthipada Chattopadhyay: নিজের মধ্যে বাবলুর ছায়া দেখার অবসান

Follow Us :

কলকাতা: আর তো কটা দিন।আরেকটু কি থেকে যাওয়া যেত না ষষ্ঠীকাকু? আলাপ বাড়ার পর থেকে ওই নামেই ডাকতাম।মাত্র ছদিন পর দুর্ধর্ষ দুশমনদের সঙ্গে আরও একবার মোকাবিলায় নামতাম।তা আর হতে দিলেন কই! 

বাবলুর ছায়া কেন সরিয়ে নিলেন মাথার ওপর থেকে? ১৯৮১-তে বাবলু যখন ময়দানে নামল, তখন আমার কতই বা বয়স! বাবলুর সঙ্গে পরিচয় অনেকটা পরে, স্কুলে পড়ার বয়সেই অবশ্য। পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা হাতে পেলে লুকিয়ে পড়া কে আটকায়। এত আনন্দ পাতার পর পাতায়। বিমল করের ম্যাজিশিয়ান কিকিরা, সুনীল গাঙ্গুলির কাকাবাবু ও সন্তু,  সমরেশ মজুমদারের অর্জুনের মাঝেও অস্বাভাবিক টানত পাণ্ডব গোয়েন্দা। কিকিরা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু সুনীল গাঙ্গুলির সন্তু চরিত্র কিংবা সমরেশ মজুমদারের অর্জুনের মধ্যে সাবেক শৈশবের আধুনিক রূপায়ণ তো ছিলই। তবুও বাবলুর মধ্যেই নিজের ছায়া দেখতাম। মিত্তিরদের বাগান আমার হয়ত ছিল না, তবে ফাঁকা মাঠ ছিল, স্কুল-মাঠে দস্যিপনা ছিল, কালীপুজোয় স্টিল কালারের ছোট্ট রিভলভার ছিল, হাফপ্যান্টের পকেটে কিংবা বেল্ট বাঁধার ঘরে সেই রিভলভার ঢুকিয়ে বাবলু বাবলু মনে হওয়া ছিল। বুক ফুলিয়ে মনে মনে মাস্তানির অদ্ভুত মাদকতা ছিল। হাওড়ার সাঁকরাইলে বাড়ির পাশে ছোট্ট বাগানে বসে দুপুরের আলসেমির পাটাতনে পা রেখে কখনও রাজস্থান, কখনও মধ্যপ্রদেশ, কখনও হাজারিবাগ ঘুরে আসাটাই যেন ছিল দস্তুর। বাবলুর সঙ্গে বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্চু থাকলেও আমার শৈশবে একটা কানা পঞ্চু ছিল, বাবলুর সাহসিপনা যখন নেশার মতো আমার শৈশব আচ্ছন্ন করে রাখত, তখন আমার পঞ্চু বেগতিক দেখলেই ডেকে উঠত, ভৌউউউউউউ…

কলেজে পড়ার সময়েই সাহসে ভর দিয়েছিলাম। আমার জেলারই একজন মানুষ আমার মনে এমন অবিশ্বাস্য মায়া তৈরি করে দিয়েছেন, তাঁকে কাছ থেকে না দেখলেই নয়, তাঁর সঙ্গে আলাপ না করলেই নয়। কলেজ কেটে ধারসার বাড়িতে পা টিপে টিপে ঢুকেছিলাম, আমার প্রিয় বাবলুর স্রষ্টার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলাম। আমার শৈশব কেমনভাবে বাবলুতে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল, বলেছিলাম ষষ্ঠীকাকুকে। তাঁর সৃষ্টি যে এক গুণমুগ্ধকে এমন বশ করতে পারে, জেনে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।ষষ্ঠীকাকুর (Sasthipada Chattopadhyay) কলমের অমন জাদু, অমন একটা চরিত্র, অমন দুঃসাহস, অমন নেতৃত্ব, অমন বরাভয়, অমন স্নেহ, শত্রুপক্ষের সামনেও সটান, অমন রণহুঙ্কার, বারবার  মনে হত, এমনই তো হতে চেয়েছি আমি।ঠিক এমনটাই, বাবলুর মতো অবিকল, বন্দুক হাতে শত্রুর খুলিতে ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই।

আমার আশৈশব রোমাঞ্চের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে জগাছা, ধারসা, খুরুট, রামরাজাতলা।আমার অবিন্যস্ত আর অপটু সাহিত্যচর্চায় আজন্ম মাখামাখি হয়ে থাকবে ষষ্ঠীকাকুর নির্ভেজাল স্নেহ। খুরুট ষষ্ঠীতলার ষষ্ঠীপদর হাতে যে এমন মোলায়েম গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি হতে পারে, তা অম্বর চ্যাটার্জি কিংবা কিশোর গোয়েন্দা তাতার না পড়লে জানাই যায় না। 

নিজেই কতবার বলেছেন তাঁর জীবনে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাবের কথা। তারাশঙ্করের স্নেহধন্য হয়ে নিজেকে অতি সৌভাগ্যবান বলে মনে করতেন ষষ্ঠীকাকু। হাওড়া শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ে ক্লাস ফোরে পড়ার সময় হাতে এসেছিল ‘রামধনু’। মোট সাতটি গল্প ছিল তাতে। লেখকের নাম তারাশঙ্কর। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ পড়তে পড়তে তারাশঙ্করের আবির্ভাব। যেন স্বর্গের দেবতা, বলতেন ষষ্ঠীকাকু। ‘ডাকহরকরা’, ‘কালাপাহাড়’, ‘নুটু মোক্তারের সওয়াল’ গল্পগুলো পড়ার রোমাঞ্চে অন্য জগতে চলে যেতেন। কিশোর বয়সেই পড়ে ফেলেছিলেন তাঁর আরাধ্য দেবতার ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘গণদেবতা’, ‘কবি’, ‘কালিন্দী’ ও ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’।তারাশঙ্করের টালা পার্কের বাড়িতে যাতায়াত ছিল ষষ্ঠীকাকুর। বোলপুর, সাঁইথিয়া হয়ে আমোদপুর। সেখান থেকে ছোট রেলে লাভপুর।লাভপুরে হাঁসুলি বাঁকে গিয়ে যেন ষষ্ঠীপদর পুনর্জন্ম হয়েছিল।তারাশঙ্করের টালা পার্কের বাড়িতে বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ আসতেন।প্রতি রবিবার ষষ্ঠীপদ চলে যেতেন তারাশঙ্কর দর্শনে। তারাশঙ্করবাবু তাঁর লেখার ঘরে বসে লেখালেখির কাজ করতেন।তারাশঙ্করবাবু সেই সময়‘গ্রামের চিঠি’ লিখতেন।সেগুলি পড়ে শোনাতেন।এর মধ্যে হঠাৎ করেই রেলে চাকরি পান ষষ্ঠীপদ।তিন বছর একটানা চাকরি করে রেলের পাস নিয়ে বেড়াতে চলে যান জ্বালামুখী-কাংড়া অঞ্চলে।কিন্তু ঘুরে এসে সে চাকরি ছেড়ে দেন। তারাশঙ্করবাবু প্রচণ্ড বকাবকি করেছিলেন।তারপরই একটা অস্থায়ী চাকরি পান ডালহৌসির টেলিফোন ভবনে।এক সপ্তাহ চাকরি করার পর সে চাকরিও ভাল লাগেনি। আবার চাকরি থেকে ইস্তফা, ফের তারাশঙ্করের বকুনি। এর পর তারাশঙ্করের চেষ্টাতেই সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিস কর্ডনিং অ্যান্ড ভিজিলেন্স সেলে চাকরি। সে চাকরি ষষ্ঠীপদর মনের মতো চাকরি। তারাশঙ্করের বকাবকিতেই প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দেন ষষ্ঠীপদ। পাশও করেন। 

ষষ্ঠীকাকুর পৈতৃক নিবাস বর্ধমান জেলার রামনার কাছে নাড়ুগ্রাম। তাঁর পরিবারের, বিশেষ করে দাদামশাই-দিদিমা, মা সবাই স্থির করেছিলেন, তিনি বারাণসী অর্থাৎ কাশীতে জন্মালে নাম রাখা হবে কাশীনাথ। কিন্তু তা হয়নি। খুরুট ষষ্ঠীতলায় বাংলা ১৩৪৭ (ইংরেজি ১৯৪১, 9 মার্চ) ২৫ ফাল্গুন রবিবার তাঁর জন্ম। বাবা নাম রাখলেন ষষ্ঠীচরণ। কাশীতে জন্মলাভ হয়নি বলে পরিবারের সকলের মনে একটু খেদ ছিল। তবে হাওড়ার শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত তিনকড়ি পাঠক ওঁদের বুঝিয়ে বলেছিলেন, তোমরা ভুল ভাবছ। এই হাওড়া শহর গঙ্গার পশ্চিম কূলে। এখানে আছে বেলুড় মঠ। তা ছাড়া গঙ্গার পশ্চিম কূল হল বারাণসী সমতুল। আর এই জায়গার নাম রামকৃষ্ণপুর। শ্রীরামকৃষ্ণই ওকে তাঁর খুব কাছে টেনে নিয়েছেন। এখান থেকে একটু এগোলেই সেই বিখ্যাত লালবাড়ি। শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্ত নবগোপাল ঘোষের বাড়ি। স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রীশ্রীমায়ের পদধূলিধন্য বাড়ি। এই বাড়ির পরিওয়ালা মাঠে আর কিছুদিন বাদে ও খেলা করবে। ওঁর কথায় সবারই মন শান্ত হয়েছিল। এর পর ওই বাড়ি থেকে কাছাকাছি অন্য এক বাড়িতে উঠে যান তাঁরা। বাড়ির কর্তা ভালবেসে একটা রুপোর পদক গড়িয়ে দেন। ওঁরা ছিলেন মণিকার। পদকে নাম খোদাই করলেন ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। সবাই বললেন, ‘চরণ’ থেকে ‘পদ’ হল কেন? মণিকারের যুক্তি, আমাদের বাড়িতে একজন কাজের লোক ছিল, তার নাম ছিল ষষ্ঠীচরণ। সুতরাং এই আদরের শিশুর নাম আমি কিছুতেই ষষ্ঠীচরণ রাখব না। ওঁর আবদারেই ষষ্ঠীপদ। 

একটু বড় হওয়ার পর, সাত বছর বয়সে মা ও দিদিমার সঙ্গে নবদ্বীপ-শান্তিপুরে রাস দেখতে যান। এর পর দশ বছর বয়সে গয়া-কাশী। গয়ায় গিয়ে জীবনে প্রথম পাহাড়ে ওঠেন, প্রেতশিলায়। সেখান থেকে কাশী। পাঁড়েঘাটের সেই বাড়িতে থেকে, ফিরে আসা। বছর বছর তীর্থভ্রমণ করতেন বাবা। হরিদ্বার, কুরুক্ষেত্র, বৃন্দাবন। ওদিকে দ্বারকা প্রভাস থেকে অজমের পুষ্কর। তারপর রামেশ্বরম, মাদুরাই, কন্যাকুমারী ও অন্যান্য। অর্থাৎ ওই সময়কালেই বালক ষষ্ঠীপদর মধ্যে ভ্রমণের নেশা ঢুকে গেল। পনেরো বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে কামাখ্যা দর্শন। অন্তর্যামী দেবী মা কামাখ্যার আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। কামাখ্যা ভ্রমণ নামে ভ্রমণ কাহিনি লিখলেন। দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় বৃহস্পতিবারের ছোটদের পাতায় ছাপা হল সেই লেখা। সাহিত্যিক বিশু মুখোপাধ্যায় ‘ডাকহরকরা’ ছদ্মনামে ওই বিভাগটি সম্পাদনা করতেন। সেদিনের সেই আনন্দের সীমা শেষদিন পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে ষষ্ঠীকাকুর রক্তে। 

আরও পড়ুন: Ales Bialiatski:পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার নোবেলজয়ী বিয়ালিয়াতস্কি  

কলেজ স্ট্রিটে মিত্র ও ঘোষের দোকানে গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও সুমথ ঘোষের সঙ্গে পরিচয়। শারদীয়া বসুমতীতে ষষ্ঠীপদর লেখা পড়ে দারুণ প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, এবার থেকে তুমি আমার কাগজেও লিখবে। আমি জনসেবক নামে একটি কাগজে ছোটদের বিভাগটা দেখি। নাম, ‘সপ্তডিঙা’।” বলে ঠিকানা দিয়ে দেন। তারপর থেকে নসেবক-এর ছোটদের পাতায় নিয়মিত লেখক হয়ে ওঠা। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ‘মহাকবি অশ্বঘোষ’ নামে একটি লেখা ডাকে পাঠিয়েছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকা-র রবিবাসরীয় আলোচনা বিভাগে। তখন রবিবাসরীয়র সম্পাদক ছিলেন রমাপদ চৌধুরী। তাঁর সহকারী ছিলেন কবি সুনীল বসু। কয়েকদিনের মধ্যেই এক রবিবারে সেই লেখা আলোচনার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। তারিখটা ছিল ৯ জুলাই, ১৯৬১। একদিকে ছিল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প ‘জিরাফ’। অপরদিকে ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যাযের ‘মহাকবি অশ্বঘোষ’। এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। অমন অল্পবয়সি একজন লেখকের লেখা রমাপদ চৌধুরী ছেপেছেন, এটা যে বিস্ময়ের ব্যাপার। নিমাইসাধন বসু, অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী এঁরা সবাই ছিলেন হাওড়ার মানুষ। ষষ্ঠীপদর লেখা আনন্দবাজার-এ দেখে নিমাইসাধন বসুও ছুটে এসেছিলেন বাড়িতে। এরপর বেরোয় ‘মহাকবি অমরু’। সেই লেখা নিয়ে চারদিকে তখন তোলপাড়। এই লেখা প্রকাশের পর সবাই খুব প্রশংসা করেছিলেন। ফলে রমাপদবাবুর নজরে পড়ে ঘনঘন লেখা প্রকাশের সুযোগ হয়ে গিয়েছিল। কত লেখা, ‘জৈন কবি রাজশেখর’, ‘মল্লীনাথ’, ‘মেয়েলি রামায়ণ’, ‘পাঁচালি সাহিত্য’, ‘ময়ূরপঙ্খির গান’, ‘ভাগ্যমণ্ডপুরের ঘাটমালিক’। ঘনঘন আনন্দবাজার-এ লেখার ফলে ওই বয়সে লেখক হিসেবে যথেষ্ট মর্যাদা পেয়েছিলেন, লেখক-জীবনের ভিতও শক্ত হয়েছিল। সাগরময় ঘোষ দেশ পত্রিকায় ছেপেছিলেন ‘রামায়ণের চিত্রকূট’। কবি সুনীল বসুর উত্সাহে দেশ পত্রিকায় নিয়মিত লেখক হয়ে যান। কম লেখেননি ভ্রমণ কাহিনি, ভূতের গল্প, বড়দের গল্প। কিন্তু ষষ্ঠীকাকুর ট্রেডমার্ক পাণ্ডব গোয়েন্দা। 

একবার বলেছিলাম, আপনি অন্য কোনও লেখা না লিখে যদি শুধু পাণ্ডব গোয়েন্দাই লিখতেন, তবুও আপনি আপামর সাহিত্যবিলাসীর মনে বিচরণ করতেন। বাচ্চা থেকে বুড়ো, বাবলু,, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্চু, পঞ্চুর অ্যাডভেঞ্চার নেশার মতো জাঁকিয়ে বসে আছে মনের মণিকোঠায়। ষষ্ঠীকাকু, হাত ছেড়ে দেবেন না প্লিজ, বাবলুর ছায়া আমার ওপর থেকে সরে যাক, চাই না। আজন্ম লালন করতে চাই এই সহবাসনা, এই সহরাগ, এই সহ-বাস। বাবলু, জেগে ওঠো, বেরিয়ে পড়ো আরেক দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার অভিযানে।

RELATED ARTICLES

Most Popular