কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক: গত বছর রাজ্য বিধানসভা ভোটে (Assembly Election) তৃণমূল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতা দখলের পর রাজ্য রাজনীতি বইছিল নিস্তরঙ্গ খাতেই। রাজ্যের ক্ষমতা দখলের খোয়াব দেখা বিজেপি (BJP) ৭৭টি আসন পেয়েই থমকে গেল। বামেরা এবং কংগ্রেস একেবারে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল। বিধানসভায় বিরোধী বলতে শিবরাত্রির সলতের মতো রইলেন শুধু আইএসএফ (ISF)-এর এক প্রতিনিধি। ভোটের পর তবু যেটুকু উত্তেজনা ছিল তা হল, ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে সিবিআই তদন্তকে ঘিরে। তাও সেটা ছিল বিজেপির অভিযোগের ভিত্তিতে।
এই আবহে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না বিরোধী বাম এবং কংগ্রেসকে। যদিও সাম্প্রতিক পুর নির্বাচনে ভোট শতাংশের বিচারে বামেরা কিছুটা হলেও স্বস্তিজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। অনেক পুরসভার ক্ষেত্রেই বিজেপিকে পিছনে ফেলে বামেরা দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে।
বঙ্গ রাজনীতির এই নিস্তরঙ্গ পরিস্থিতি গত চারদিন ধরে রীতিমতো উত্তপ্ত হয়ে উঠল আমতার ছাত্রনেতা আনিস খানের মৃত্যুরহস্যকে কেন্দ্র করে। যে বাম কংগ্রেস একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছিল বঙ্গ রাজনীতিতে, তাদের খোঁজ মিলল ময়দানে। আনিসের মৃত্যুরহস্যের যথাযথ তদন্তের দাবিতে এই মুহূর্তে উত্তাল প্রায় গোটা বাংলা। এই পরিস্থিতি আজ থেকে ১৫ বছর আগে রিজওয়ানুর রহমানের রহস্যজনক মৃত্যুর পরবর্তী স্মৃতিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। তখন বাংলার নাগরিক সমাজ পথে নেমেছিল বাম সরকারের বিরুদ্ধে। ২০১১ সালে বাংলার পালাবদলের পিছনে রিজওয়ানুর কাণ্ড অনেকটাই অনুঘটকের কাজ করেছিল। তৎকালীন বাম জমানায় যে নাগরিক সমাজকে রাস্তায় মিছিল করতে দেখা গিয়েছিল, তার অধিকাংশ মুখ এখন তৃণমূল শিবিরে। সেই মুখগুলিকে অবশ্য আনিস কাণ্ডের প্রতিবাদে পথে নামতে দেখা যায়নি।
তাতে অবশ্য ক্ষোভ-বিক্ষোভ-আন্দোলনে কোনও ঘাটতি পড়েনি। বিভিন্ন বাম ছাত্র সংগঠনের পাশাপাশি কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদে আনিসের মৃত্যুর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। শুধু তাই নয়, রাজনীতির বাইরে থাকা বহু সাধারণ ছাত্রছাত্রীও সামিল হয়েছেন এই প্রতিবাদে। ঘোলাজলে মাছ ধরতে নেমেছে অনেক বিরোধী দলও। যা দেখে কিছুটা চিন্তিত নবান্ন। গত তিনদিন ধরে কলকাতা-সহ বাংলার বিভিন্ন জেলায় আনিসের মৃত্যু ঘিরে যে উত্তাল আন্দোলন চলছে তাকে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: Anis Khan Murder Probe: আনিস রহস্য উন্মোচন ১৫ দিনেই, ডিজি বোঝালেন পুলিসের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে
বুধবারই নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রী তোপ দেগেছেন বিরোধীদের। তাঁর কথায়, ‘একটা ঘটনা ঘটেছে। সরকার তার নিরপেক্ষ তদন্ত করছে। দুই পুলিসকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পাবে।’ তিনি বলেন, ‘তাই বলে আন্দোলন করে সব স্তব্ধ করে দিতে হবে? রাস্তা অবরোধ করে হাজার হাজার মানুষকে বিপাকে ফেলতে হবে? আন্দোলন করে আমি আজ এই জায়গায় উঠে এসেছি। দয়া করে আমাকে কেউ আন্দোলন শেখাতে আসবেন না।’
এই প্রসঙ্গেই তাঁর আরও অভিযোগ, ‘কোনও কোনও রাজনৈতিক দল এই মৃত্যুকে ঘিরে রাজনীতি করছে। পুলিসের নিরপেক্ষ তদন্ত প্রক্রিয়াকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, তদন্তে বাধা দেওয়াও কিন্তু ক্রিমিনাল অফেন্স। এটা মাথায় রাখবেন।’
আনিসের পরিবার রাজ্য সরকারের গড়ে দেওয়া বিশেষ তদন্তকারী দলের (SIT) উপর আদৌ ভরসা রাখতে পারছে না। তারা সিবিআই তদন্তের দাবিতে অনড়। বিরোধীরাও কেউ চাইছে সিবিআই তদন্ত, কেউ চাইছে কর্মরত বিচারপতির তত্ত্বাবধানে বিচারবিভাগীয় তদন্ত। সিপিএম নেতা বিকাশ ভট্টাচার্য, সুজন চক্রবর্তী, কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী, আব্দুল মান্নান থেকে শুরু করে তাবড় বিরোধী নেতারা বলছেন, ক্ষমতায় আসার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা ঘটনায় কথায় কথায় সিবিআই তদন্ত দাবি করতেন। এখন সিবিআই তদন্তে তাঁর আপত্তি কেন? বিরোধী নেতাদের আরও অভিযোগ, যে পুলিসের বিরুদ্ধে আনিসকে খুন করার অভিযোগ উঠেছে, সেই পুলিসই কী করে নিরপেক্ষ তদন্ত করবে? তাঁদের দাবি, আসলে গোটা ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের আড়াল করার জন্যই পুলিসকে দিয়ে সিট গঠন করা হয়েছে। বিরোধী দলগুলি পুলিসমন্ত্রী হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করেছে। ঠিক একইভাবে ১৫ বছর আগে রিজওয়ানুর কাণ্ডে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন তখনকার বিরোধী দলনেত্রী এবং বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: Anis Khan: আনিস মৃত্যু রহস্যের জট প্রায় খুলে ফেলেছে পুলিস, পিছনে কারা দু-একদিনে জানাবে সিট
মমতা অবশ্য বিরোধীদের অভিযোগের জবাব দিতে এক মুহূর্ত দেরি করেননি। বুধবার তিনি বলেন, যাঁরা এখন বড় বড় কথা বলছেন, তাঁরা নিজেদের আমলে কত ব্যবস্থা নিয়েছিলেন? সিঙ্গুরে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? উত্তরপ্রদেশের হাথরস, উন্নাও-এর ধর্ষণ কাণ্ডে কতজনের শাস্তি হয়েছে? আজ পর্যন্ত সিবিআই বিশ্বভারতী থেকে চুরি যাওয়া নোবেল প্রাইজ উদ্ধার করতে পেরেছে? খালি সন্ধ্যাবেলায় টেলিভিশনে বড় বড় ভাষণ।
কাকতালীয় ঘটনা হল, ২০০৭ সালে রিজওয়ানুর কাণ্ডে নাম জড়িয়েছিল যে আইপিএস অফিসার জ্ঞানবন্ত সিংয়ের, সেই পুলিস অফিসারকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আনিস কাণ্ডের তদন্তভার দিয়েছেন। বিরোধীরা তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। আনিস কাণ্ডের জট হয়ত অনেকটাই খুলে ফেলেছে সিট তদন্তে নেমে। রাজ্য পুলিসের ডিজি মনোজ মালব্যের দাবি, দু-এক দিনের মধ্যে রহস্যের পর্দা আরও অনেকটাই উন্মোচিত হবে। তবু পুলিসি তদন্তে সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিরোধীদের।