কলকাতা: সাইবার প্রতারণায় কলকাতা এখন স্বর্গরাজ্য? শহরে ভুয়ো কল সেন্টার খুলে বিদেশি নাগরিকদের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রতারণা করছে সাইবার অপরাধীরা, এমনটাই অভিযোগ। একটি সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের দাবি, শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কল সেন্টার থেকে প্রতিদিন তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি প্রতারণা করা হচ্ছে। সাইবার প্রতারণায় কলকাতা এখন ছাপিয়ে গিয়েছে ঝাড়খণ্ডের জামতারা গ্যাংকেও। কলকাতা পুলিস অবশ্য ৩ হাজার কোটি টাকার প্রতারণার দাবিকে নস্যাৎ করেছে। পুলিস কমিশনার বিনীত গোয়েল জানিয়েছেন, এটি একেবারেই ভিত্তিহীন দাবি। এভাবে প্রতারণার অঙ্ক নির্ণয় করা যায় না। কলকাতা পুলিস সাইবার অপরাধ ঠেকাতে যথেষ্ট সক্রিয়।
সাইবার প্রতারণায় ঝাড়খণ্ডের জামতারা গ্যাংকে অনেক অনেক গুনে ছাপিয়ে গিয়েছে কলকাতা, এমনটাই অভিযোগ । কলকাতার সাইবার অপরাধীদের টার্গেট মূলত আমেরিকার প্রবীণেরা। এর সঙ্গে রয়েছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, জার্মানির নাগরিকেরাও। প্রতারকেরা বিপিও কর্মীদের কাছ থেকে বিদেশি নাগরিকদের কম্পিউটার আইপি অ্যাড্রেস সংগ্রহ করে। কল সেন্টার থেকে ভয়েস ইন্টারনেট প্রোটোকল মারফত বিদেশি নাগরিকদের ফোন করে। প্রতিটি ভুয়ো কল সেন্টারেই রয়েছে প্রযুক্তিতে পারদর্শী কর্মী এবং হ্যাকার। নিজেদের মাইক্রোসফটের কর্মী বলে পরিচয় দিয়ে প্রবীণ নাগরিকদের কম্পিউটারের তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। কারও কারও কম্পিউটারে ম্যালওয়ার পাঠিয়ে কম্পিউটার ব্লক করে রাখে প্রতারকেরা।
সেগুলি ঠিক করে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে যাতে এই সমস্যা না হয়, তার জন্য বিদেশি নাগরিকদের প্রযুক্তি সাহায্যের প্রস্তাব দেয় সাইবার প্রতারকেরা। প্রতারকদের কথায় ওই নাগরিকেরা তাতে রাজি হলে সেই সব নাগরিকদের তারা লিঙ্ক পাঠায়। কেউ প্রতারকদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে লিঙ্কে ক্লিক করলেই তাঁর কম্পিউটার প্রতারকদের কব্জায় চলে যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে টিম ভিউয়ার-এর মারফত কম্পিউটার কব্জায় নেয় প্রতারকেরা। প্রযুক্তি চুক্তির টাকার অঙ্ক বিদেশি নাগরিকেরা যাই বসান না কে, প্রতারকেরা সেই অঙ্কে গরমিল করে হাজার হাজার ডলার অ্যাকাউন্ট থেকে গায়েব করে দেয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রতারকেরা নিজেদের অ্যামাজনের মতো বিভিন্ন ই-কমার্স সংস্থার কর্মী পরিচয় দিয়ে পরিষেবা দেওয়ার নাম করেও প্রতারণা করে।
আমেরিকার নাগরিকদের এহেন সাইবার অপরাধের শিকারের ঘটনা দেখার পর সেখানকার বিশিষ্ট ইউটিউবার মার্ক রবার কলকাতার কল সেন্টার থেকে সাইবার প্রতারণা নিয়ে একটি ভিডিয়ো তৈরি করেছিলেন। বিবরণ দিয়েছিলেন, কীভাবে ওই কল সেন্টারগুলি বন্ধ করেছিলেন তিনি। মার্ক রবার তার কয়েকজন সহযোগী নিয়ে চারটি কল সেন্টারে পরিচয় গোপন করে হানা দেন। কল সেন্টারে কাজের ছুতোয় তারা সেখানকার সিসিটিভি কব্জায় নেন। কল সেন্টারের কর্মীদের ‘কাবু’ করতে ইঁদুর, আড়শোলা এমনকি রাসায়নিকের সাহায্যও নিয়েছিলেন। সিসিটিভি কব্জায় নেওয়ার পর আস্তে আস্তে কল সেন্টারের প্রতারণার কারবার ফাঁস করেন তাঁরা। ওই ভিডিয়ো তিনি ইউটিউবে আপলোডও করেছিলেন। মার্ক রবারের দাবি, ২০২১ সালে আমেরিকার নাগরিকদের সাইবার প্রতারণার অঙ্ক প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার।
বিদেশের পুলিসের কাছ থেকে অভিযোগ এলে কলকাতা পুলিস ও বিধাননগর কমিশনারেট মাঝে মধ্যে কল সেন্টারে তল্লাশি চালিয়ে কাউকে কাউকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হয়ে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর ঠিকানা বদলে প্রতারকেরা ফের নতুন কল সেন্টার খুলে আবার শুরু করে প্রতারণার কারবার। কলকাতা পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগ থানা ও থানা এবিষয়ে ওয়াকিবহাল। সম্প্রতি কলকাতা পুলিশের গুন্ডাদমন শাখা ও গোয়েন্দা বিভাগের অন্য কর্মীরা ১৫টি কল সেন্টারে তল্লাশি চালিয়ে ৮০ জনকে গ্রেফতার করেছে। বিধাননগর কমিশনারেট বেশ কিছু কল সেন্টারে তল্লাশি চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। সেক্টর ফাইভের ভুযো কল সেন্টার নিয়ে প্রচুর অভিযোগ আছে সেখানকার পুলিসের কাছে। কলকাতা পুলিসের যুগ্ম কমিশনার মুরলিধর শর্মা জানিয়েছেন, সাইবার অপরাধের ধরন বদলাচ্ছে। তবে সাইবার অপরাধের প্রতারণার অঙ্ক এভাবে নির্ধারণ করা যায় না।
ভুয়ো কল সেন্টারের পৃষ্ঠপোষক কে, এনিয়ে কলকাতা পুলিসের থানা ও গোয়েন্দা বিভাগের মধ্যে দীর্ঘদিনের চাপান-উতোর অব্যাহত। লালবাজারের বড়কর্তারা বিষয়টি বিলক্ষণ জানেন। তাই নাম কা ওয়াস্তে তল্লাশি, ধরপাকড় চললেও সাইবার প্রতারণার শিকার হয়ে মানুষের সর্বস্বান্ত হওয়া থামে না।