বিজেপির কাছ থেকে পাওয়া ভিক্ষা অন্নে যাঁদের সংসার চলে বা যাঁদেরকে জেলের বাইরে থাকার শর্তেই শেষমেশ বিজেপিকেই সমর্থন করতে হয়, সেই তেনাদের বাদ দিলে পঞ্চায়েত ভোটের আবহে ২০১৮-র ছবি এখনও কারও চোখে পড়ছে না। তৃণমূল দলের যুবরাজ বড় গলায় বলেছিলেন বিরোধীরা নমিনেশন ফাইল করবে, কেউ কোনও বাধা দেবে না। দলের অন্যতম নেতা অরূপ বিশ্বাস বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে টুইট করে জানিয়েছেন নমিনেশন জমা দিতে কোথাও সমস্যা হলেই যেন তাঁকে জানানো হয়, তিনি বিরোধী নমিনেশন পেপার জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। এদিকে আরেক কাঠি এগিয়ে লাভপুরের বিধায়ক রানা সিং গাড়িতে চড়ে প্রচারে নেমেছেন, না ভোট চাইতে নয়, এটা জানাতে যে বিরোধী কোনও দলের নেতা নমিনেশন জমা দিতে গিয়ে কোনও বিরোধিতার সম্মুখীন হলেই তাঁকে জানালে, তিনি ব্যবস্থা নেবেন, কোথায়? বীরভূমে, যেখানে উন্নয়ন মাঝরাস্তায় লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকত। এসব তাঁরা বলছেন, মানে একটা কথা তো স্বীকার করেই নিচ্ছেন যে ২০১৮তে নির্বাচনটা ঠিকঠাক হয়নি। এসব প্রচারের জন্যই হোক বা সাধারণভাবেই বিরোধীদের খানিক শক্তিবৃদ্ধির কারণেই হোক, দু’ একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নমিনেশন জমা দেওয়া চলছে।
আপাতত নমিনেশন জমা দেওয়ার ব্যাপারে বিজেপি এগিয়ে, তারপরে বাম, তারপরে তৃণমূল, কংগ্রেস শেষে। ও হ্যাঁ, আপাতত বাম-কং জোটের দফা রফা, তেনারা আলাদা আলাদাই লড়ছেন, আদর্শগত সেই জোট আবার বিধানসভা ভোটের আগে দেখা যাবে, যদি না তার আগেই জোটের অন্য সমীকরণ সামনে এসে যায়। তৃণমূল তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ীই একটু ধীরে চলো নীতি নিয়েছে। প্রথমে জনজোয়ারের ঘোষণা বিরোধী দল এবং সংবাদমাধ্যমকে ভোট জুলাইয়ের শেষে অগাস্টে হবে এমন ধারণা তৈরি করানোর পরে ভোটকে জুনেই নিয়ে আসাটাও তাদের পরিকল্পনাই ছিল। একটু হলেও হতচকিত বিরোধীরা হাতে সময় কম পেলেন, আদালত থেকেও খুব সুরাহা মিলবে তাও নয়। প্রথম মনস্তাত্ত্বিক খেলা শেষ হবে নমিনেশন জমা হওয়ার পরে। প্রায় বাধাহীন নমিনেশন পর্বের শেষেও যদি ৪০ শতাংশ আসন বিরোধীহীন ভাবেই জিতে যায়, তাহলেও অনেকটাই এগিয়ে থাকবে তৃণমূল, বলবে আমরা তো বাধাও দিইনি, ওদের সঙ্গে মানুষ নেই ইত্যাদি। এবং তারপরে ফলাফল। নির্দ্বিধায় বলাই যায় তৃণমূল বেশিরভাগ গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদ জিতবে। কিন্তু প্রশ্ন হল দ্বিতীয় স্থানে কারা? বিজেপি না বাম? হ্যাঁ, বিষয় আজকে সেটাই, পঞ্চায়েতে দু’ নম্বরে কারা বিজেপি না বাম?
আরও পড়ুন: Aajke | দিদিকে বলো থেকে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী, কী বলব?
উত্তরবঙ্গে বিজেপির সংগঠন না থাকলে এ প্রশ্নই উঠত না, বলেই দেওয়া যেত বামেরাই দু’ নম্বরে থাকছে। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের মতো ছিন্নবিচ্ছিন্ন সাংগঠনিক অবস্থার ঠিক বিপরীতে উত্তরবঙ্গে বিজেপির নেতা আছে, ক্যাডারও আছে, জেতার ইচ্ছে আছে, ইস্যুও আছে। অন্যদিকে তৃণমূলের গোষ্ঠীদন্দ্ব আছে, সবমিলিয়ে উত্তরবঙ্গে বিজেপি বামেদের থেকে ভাল ফল করবে। দক্ষিণবঙ্গে বিজেপি কাগুজে বাঘ, টেলিভিশনের পর্দা আর খবরের কাগজের পাতাতেই তাঁদের আনাগোনা, মাটিতে নয়, তার প্রমাণ মেদিনীপুরেই পাওয়া যাবে। দিলু ঘোষ আর শুভেন্দু অধিকারীর মাটিতে বামেরাই হয়তো দু’ নম্বরে থাকবে। দক্ষিণবঙ্গে একমাত্র বীরভূম ছাড়া প্রত্যেক জেলাতেই দু’ নম্বর জায়গাটা বামেদের দখলে থাকবে। বীরভূম কিন্তু অন্য কথা বলছে, এখানে বামেদের যে ভোট বিজেপির দিকে গিয়েছিল, গ্রামে গ্রামে বামেদের যে কর্মীরা বিজেপিতে গিয়েছিলেন, তাঁরা এখনও বামে ফেরেননি, বিজেপিতেই আছেন, কাজেই কেষ্টবিহীন বীরভূমে তৃণমূলই ক্ষমতা ধরে রাখবে, একথা বলার পরেও দু’ নম্বর জায়গাটা বিজেপির কাছেই থেকে যাবে। মালদা, মুর্শিদাবাদ আর নদিয়ার কিছু অংশে অধীর কংগ্রেস আছে, তারাই দ্বিতীয় স্থানে থাকবে। পুরুলিয়ার দিকে নজর থাকবে সবার, কুড়মি ভোট বিজেপির দিকে যাবে? হ্যাঁ যাবে, কিন্তু সেখানে বাকি আদিবাসী ভোট কোনদিকে? তা যদি তৃণমূলের দিকে যায় তাহলে পুরুলিয়ার মাটিতে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ দেখব আমরা। এই দক্ষিণবঙ্গ আর উত্তরবঙ্গ মেলালে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদে বিজেপিই দ্বিতীয় স্থানে থাকবে। ঘাড়ের ওপরেই নিশ্বাস ফেলবে বামেরা, কংগ্রেস অনেকটা দূরে। বামেদের সমস্যা এখনও গ্রামস্তরে সংগঠন গড়ে না তুলতে পারা, যে সংগঠন ক্ষমতা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙেছিল, তা এখনও ফেরত আসেনি। গ্রামের কিছু সমর্থক কর্মীরা জেলা বা মহকুমার জমায়েতে জড়ো হচ্ছেন, কিন্তু নিজেদের গ্রামে কাজ করছেন না, বা করতে চাইছেন না। অন্যদিকে বিজেপির সমস্যা হল, তাঁদের সংগঠন কিছু কিছু পকেটেই বৃদ্ধি পেয়েছে, সামগ্রিকভাবে জেলায় সংগঠন বাড়ানোর মতো কোনও পরিকল্পনা বিজেপির ছিলও না। সব মিলিয়ে বিজেপির দ্বিতীয় নম্বরে থাকা এবং বামেদের অনেকটা শক্তিবৃদ্ধিই এবারের পঞ্চায়েতের রাজনৈতিক ছবি। আমরা মানুষের কাছে প্রশ্ন নিয়ে গিয়েছিলাম, পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাংলায় দু’ নম্বরে কারা থাকবেন, বাম না বিজেপি? যাঁরা মনে করেন বাম বা বিজেপি এক নম্বরে থাকবে, তাঁদেরকে আমরা এই প্রশ্ন থেকে বাদই দিয়েছি। শুনুন মানুষ কী বলছেন।
রাজনীতি এক অপার সম্ভাবনার খেলা, কখন যে কী হয়ে যায়, কোন ছিদ্র দিয়ে বা সদর দরজা দিয়ে কালনাগিনী ঢুকে দংশন করে তা ওই বেহুলার কান্নার আগে টেরই পাওয়া যায় না। কাজেই রাজনীতির সেরা আঙিনা সংসদীয় গণতন্ত্রে, নির্বাচন নিয়ে নিদান হেঁকে দেওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়। তবুও তো বাজার গরম হয় বিভিন্ন সম্ভাবনায়, আমরাও তেমন কিছু সম্ভাবনার কথাই বললাম মাত্র, আপনারা আপনাদের মতামত জানান।