যে চিকিৎসা ছিল বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার মতো, সেই ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিখরচায় হচ্ছে শহরের সরকারি হাসপাতালে৷উদ্বিগ্ন মা-বাবা হঠাৎ একদিন দেখছেন, তাঁদের মূক ও বধির সন্তান খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে৷হাসির সঙ্গে মুক্তোর মতো ছিটকে আসছে দু’একটা শব্দ৷ যে শব্দের জন্য তাঁরা বহু বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন৷ কীভাবে সম্ভব হচ্ছে এটা? কলকাতা টিভির প্রতিনিধি নিমাই পান্ডার সঙ্গে কথা বললেন এসএসকেএম-এর চিকিৎসক অরুণাভ সেনগুপ্ত।
যতদিন যাচ্ছে, বিশ্বে তত বৃদ্ধি পাচ্ছে মূক ও বধিরের সংখা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৪৩ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক ও ৩৪ কোটি শিশু বধির। শিশুদের মধ্যে অধিকাংশই জন্মবধির। তাই শিশুর কথা বলার বয়স হলে মায়েদের আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সময় থাকতে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের(Cochlear implant) মাধ্যমে বধির বাচ্চার মুখেও কথা ফোটানো সম্ভব৷ তবে এই চিকিৎসা ও ইমপ্ল্যান্ট করতে খরচ পড়ে প্রায় সাড়ে চোদ্দো লাখ টাকা।এই অঙ্ক অনেকের সাধ্যের বাইরে। তাই এই বধির শিশুদের পরিবারের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এসএসকেএমের ইএনটি বিভাগ। ইতিমধ্যেই জন্মবধির ৮০ জন শিশুর মুখে কথা ফুটেছে এই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের মাধ্যমে।
(প্রফেসর অরুণাভ সেনগুপ্ত. বিভাগীয় প্রধান,ইএনটি, এসএসকেএম)
ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট (Cochlear implant) কী?
জন্মগত বধির শিশুদের শ্রবণশক্তি ও বাকশক্তি ফিরিয়ে দিতে পারে এই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট। তবে এই ইমপ্ল্যান্টের জন্য প্রয়োজন চিকিৎসকের সঙ্গে ঠিক সময়ে যোগাযোগ করা। জন্মের এক বছরের পরেও যদি দেখা যায় শিশুটি কোনও আওয়াজে সাড়া দিচ্ছে না, কোনও কথা বলছে না, তা হলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। এটা করলে চিকিৎসা তাড়াতাড়ি শুরু করা যায়। ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের আগে ধাপে ধাপে শিশুর চিকিৎসা চলে। একদম শেষ ধাপে থাকে এই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট।
ককলিয়ার যন্ত্রটি
প্রথমে বেশ কয়েকটি টেস্টের মাধ্যমে দেখে নেওয়া হয় শিশুটি সত্যি জন্মবধির কি না।
শিশুদের ১ থেকে ১.৫ বছর বয়সের মধ্যে যদি দেখা যায় কেউ জন্মবধির, তখন শিশুটির কানে শ্রবণযন্ত্র দিয়ে শিশুটিকে ফের পরীক্ষা করা হয়।
কিন্তু মেশিন ব্যবহারের তিন-চার মাস পরেও যদি দেখা যায় শিশুটি কানে শুনতে পাচ্ছে না, তখন ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করা হয়।
কতটা ব্যয়বহুল এই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট (Cochlear implant)
ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টে যে যন্ত্রটি ব্যবহার হয় তার দাম হচ্ছে সাড়ে ছ’লাখ টাকা। এ ছাড়া এই ইমপ্ল্যান্টের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পদ্ধতি ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে এই একটি ইমপ্ল্যান্টে খরচ পড়ে যায় প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টাকা। বলা বাহুল্য, অনেকেরই সাধ্যের বাইরে এই খরচ। অন্য দিকে, সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের হাতছানি দোটানায় ফেলে দেয় বাবা মা-কে। এই অবস্থায় এসএসকেএম-এর ইনস্টিটিউট অফ অটোরাইনোল্যারিঙ্গোলজি অ্যান হেড অ্যান্ড নেক সার্জারি সেন্টার অফ এক্সিলেন্স (Institute of Otorhinolaryngology and Head & Neck Surgery Center of excellence) ৮০জন বধির শিশুর উপর এই ধরনের অস্ত্রোপচার করেছে৷ একেবারে নিখরচায়৷ এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় ককলিয়ার ডিভাইস দিয়ে সাহায্য করেছে কেন্দ্র ও রাজ্য।
ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের পর কী হয়?
এই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের পর পরই যে শিশু কথা বলতে শুরু করবে তেমনটা নয়। এই মেশিন কানে লাগানোর পর স্পিচ থেরাপি চলে। এই থেরাপি নিয়মিত চলার প্রায় এক বছরেরর মাথায় কথা শুনতে ও বলতে শুরু করে শিশু। কারণ, সবসময় শিশুরা মূক ও বধির হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে ওরা শুনতে পায় না, তাই কথা বলাও শেখে না। তাই ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট ও স্পিচ থেরাপির এক বছরের মাথায় তাদের শ্রবণ ইন্দ্রিয় অন্যদের মতোই কাজ করে।
ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টের কি কোনও বিশেষ বয়স আছে?
পাঁচ বছরের মধ্যে শিশুদের কথা বলার ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়। তাই পাঁচ বছর বয়সের পর ককলিয়ার ইমপ্লান্টের কারণে শ্রবণশক্তি ফিরলেও কথা বলার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। তাই পাঁচ বছরের মধ্যেই এই ককলিয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করিয়ে ফেলতে পারলে ফল হয় সব থেকে ভাল।