নয়াদিল্লি: আবার ১৩ বছর পরে তার সাথে দেখা হয় যদি…। লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে বিপুল ভোটে পাশ হয়ে যাওয়ার পর মহিলা সংরক্ষণ বিল (Women Reservation Bill) রাজ্যসভায় (Rajya Sabha) পাশ হওয়া সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু, ১৩ বছর আগে এই রাজ্যসভাতেই মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ করানোর সময় ধুন্ধুমার বেধেছিল।
যাঁরা সেদিন সেই কাণ্ড বাধিয়েছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে। আজ তাঁরাই নৌকার পাল ঘুরিয়ে দিয়েছেন। সেদিনের হাতাহাতি, ধস্তাধস্তি, ভাঙাভাঙি, মার্শাল ডেকে সাংসদদের চ্যাংদোলা করে বের করে দেওয়া, সভা থেকে সাসপেন্ড করে দেওয়ার ঘটনা হয়তো দেখা যাবে না। কিন্তু, ইতিহাস ১৩ বছর আগে ২০১০ সালে এই বিল নিয়েই কীরকম যুদ্ধ বেধেছিল রাজ্যসভায়। কারণ ইন্ডিয়া জোটে অন্যতম শরিক সমাজবাদী পার্টিই একমাত্র এই বিলের ঘোরতর বিরোধী ছিল। এখন তারাই বিলের সমর্থনে হাত মিলিয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে।
এই বিলের প্রতি লোকসভায় সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টি শর্তসাপেক্ষ সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে যে কংগ্রেস মহিলা সংরক্ষণ বিলের মধ্যেই আলাদা করে মুসলিম সহ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ দাবি করেছে, তাদের ভূমিকা কী ছিল? সেদিনও এই বিলের প্রতি বিরোধী দল বিজেপি ছাড়াও বামপন্থীরা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু, আইনি বাস্তব হচ্ছে, ৩৩ শতাংশ মহিলা সংরক্ষণের ভিতর ওবিসিদের আনতে হলে জাতিভিত্তিক জনগণনা এবং নির্বাচনী কেন্দ্রগুলির পুনর্বিন্যাস জরুরি। তা না হলে কীসের ভিত্তিতে ওবিসি মহিলাদের সংরক্ষণের হিসাব কষা হবে!
লোকসভায় সমর্থন জানিয়ে সপা সদস্য এসটি হাসান বলেন, আমরা বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছি। কিন্তু আমরা চাই ওবিসি কোটা, সংখ্যালঘু কোটাও থাকুক এবং এই মুহূর্ত থেকে চালু হোক মহিলা সংরক্ষণ আইন। অথচ ১৩ বছর আগে এই সমাজবাদী পার্টিই ব্যাগড়া দিয়েছিল রাজ্যসভায়। সপা এমপি নন্দকিশোর যাদব এবং কামাল আখতার রাজ্যসভার চেয়ারম্যান তথা উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির টেবিলের উপর উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। যাদব আরও এককাটি এগিয়ে চেয়ারম্যানের মাইক উপড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। সপার আরেক এমপি বীরপাল সিং যাদব সহ তিনজনকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।
এর মধ্যে রাজ্যসভায় দলগত অবস্থানের আড়ে-বহরে অনেক বদল ঘটে গিয়েছে। বিজেপি এই বিলকে চিরকাল সমর্থন জানিয়ে এসেছে। প্রয়াত অরুণ জেটলি বিতর্কে অংশ নিয়ে মর্মস্পর্শী ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আজ সভায় আসার সময় শুধু একটা কথাই ভাবতে ভাবতে এসেছি যে, আজ আমি একটা ইতিহাসের শরিক হতে চলেছি। কংগ্রেসের পক্ষে জয়ন্তী নটরাজন এবং সিপিএমের হয়ে বৃন্দা কারাত বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন। সেদিনও কেন্দ্রীয় আইন ও বিচার মন্ত্রী বীরাপ্পা মৈলি জানিয়েছিলেন যে, বিলে ওবিসিদের জন্য উপ-সংরক্ষণ রাখা অসম্ভব। কারণ ওবিসি জনসংখ্যা নিয়ে কোনও তথ্য সরকারের কাছে নেই। ১৯৩১ সাল থেকে দেশে কোনও জাতিভিত্তিক জনগণনা হয়নি। এখন কংগ্রেসও সেই বক্তব্য থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে উপ-সংরক্ষণের দাবিকে জোরাল করে তুলছে।
আরও পড়ুন: আজ রাজ্যসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিল
রাজ্যসভায় ২০১০ সালের সেই ঘটনা স্মরণ করে এক বিজেপি এমপি বলেন, মনে পড়ে আরজেডির এক সাংসদ কাচের গ্লাস আছাড় মেরে ভেঙেছিলেন। প্রায় ৬ জন মার্শাল এসে তাঁদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল। চেয়ারম্যান হামিদ আনসারি কয়েক মিনিট দাঁড়িয়েছিলেন। সপা, আরজেডি এবং এলজেপি-র ৭ জন এমপিকে সভাকক্ষ থেকে বিতাড়িত করতে হয়েছিল।
এই বিলকে কেন্দ্র করেই জেডিইউয়ের ভিতর নীতীশ কুমার এবং শারদ যাদবের মধ্যে ফাটল ধরে। ভোটাভুটির কয়েক মুহূর্ত আগে পর্যন্ত সাংসদরা বিভ্রান্ত ছিলেন দুই শীর্ষ নেতার মতবিরোধে। শেষপর্যন্ত নীতীশ কুমারের দিকে এগিয়ে গিয়ে জেডিইউ এমপিরা বিলের পক্ষেই ভোট দিয়েছিলেন। রাজ্যসভায় বিল পাশ হওয়ার পর প্রয়াত বিজেপি এমপি সুষমা স্বরাজ, কংগ্রেসের নাজমা হেপতুল্লা এবং সিপিএমের বৃন্দা কারাত পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ছবি তোলেন।
লালুপ্রসাদ যাদব, মুলায়ম সিং এবং শারদ যাদব গান্ধী মূর্তির সামনে প্রেস কনফারেন্স করে বিলের বিরোধিতা করেন। তাঁরা বলেন, এর ফলে ওবিসি মহিলারা বঞ্চিত থেকে যাবেন। তাই তাঁদের এই বিলের উপর সমর্থন নেই। সেদিন আর নেই। রাজ্যসভায় শক্তি ভারসাম্যেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। ২০১০ সালে কংগ্রেস ৭১ সদস্য নিয়ে রাজ্যসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ছিল। বিজেপির ছিল ৫১। এখন বিজেপি রাজ্যসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। তাদের সদস্য সংখ্যা ৯৪। কংগ্রেসের ৩০।
তৃণমূল কংগ্রেসের তখন ছিল মাত্র ২ জন, এখন ১৩। আম আদমি পার্টির তখন অস্তিত্ব ছিল না, এখন তাদের ১০ জন রাজ্যসভা সদস্য রয়েছেন। বিএসপির ছিল ১৮, এখন শূন্য। ওয়াইএসআরসিপি তখন ছিল না, এখন তাদের ৯ জন এমপি। সিপিএমের ছিল ১৩, এখন মাত্র ৫ জন।
মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে বিরোধীদের এই স্ববিরোধিতার কথাই বুধবার লোকসভায় তুলে ধরেন ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার বিতর্কিত বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে সমাজবাদী পার্টির এক সাংসদের কলার চেপে ধরার অভিযোগ তোলেন তিনি। বিল নিয়ে আলোচনার সময় নিশিকান্ত অভিযোগ করেন, ২০১২-র ডিসেম্বরে লোকসভায় ১১৭তম সংবিধান সংশোধনী বিল (সরকারি চাকরিতে তফসিলি জাতি-উপজাতিদের পদোন্নতি সংক্রান্ত) নিয়ে বিতর্কের সময় হট্টগোল বেধেছিল। সে সময় ক্ষমতাসীন ইউপিএর চেয়ারপার্সন সোনিয়া সমাজবাদী সাংসদ যশবীর সিংয়ের কলার চেপে ধরেছিলেন। নিশিকান্ত বলেন, সেদিন যশবীর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নারায়ণস্বামীর হাত থেকে বিলের কপি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই সোনিয়া তাঁর কলার চেপে ধরেছিলেন। তাঁর দলের আরও কয়েক জন সাংসদ যশবীরকে শারীরিক ভাবে হেনস্তা করেন।
সোনিয়ার ওই আচরণের বিরুদ্ধে তিনি সেদিন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন দাবি করে বলেন, আমি সোনিয়াকে বলেছিলাম, আপনি স্বেচ্ছাচারী শাসক নন, এখানকার রানি নন। পরে সমাজবাদী পার্টির প্রধান প্রয়াত মুলায়ম সিং আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিজেপি সাংসদরা পাশে না দাঁড়ালে যশবীর রক্ষা পেত না। সোনিয়া এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে সমাজবাদী সাংসদকে খুনের চেষ্টার অভিযোগ তুলেছিলেন।