সে এক দিন ছিল মাইরি, দেশের প্রধানমন্ত্রী না অলিম্পিকের বডি বিল্ডার বোঝাই যাচ্ছিল না, আমি বুঝতে পারিনি, দেশের মানুষও বোঝার চেষ্টা করছিল। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসে ইস্তক সমানে বলে যাচ্ছিলেন মেরা সিনা ৫৬ ইঞ্চ কা হ্যায়। আমার ছাতির মাপ ৫৬ ইঞ্চি। কমেও না বাড়েও না সিনা ৫৬ ইঞ্চির। তারপর বলতে শুরু করলেন ঘর মে ঘুসকর মারেঙ্গে, এই ল্যাঙ্গোয়েজে ইউপির বাহুবলীরা কথা বলেন, তিনিও সেই ভাষায় ওনার সিনা আর আগামী পেটানোর কর্মসূচির কথা বলে যাচ্ছিলেন। এর আগে আমরা আমাদের কোনও প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন ভাষা শুনিনি। এমনকী অটল বিহারী বাজপেয়ী নির্বিঘ্নে কাটিয়েছেন ৫টা বছর, পরমাণু বোমাও ফাটিয়েছেন, কিন্তু ওই ৫৬ ইঞ্চ কা সিনা ইত্যাদি বাওয়াল দেননি। তো সেসব দিন কবেই গেছে, ৫৬ ইঞ্চ কা সিনা-কে এখন পড়শিরাই পাত্তা দেয় না। মালদ্বীপ সাফ জানিয়ে দিল সেনাবাহিনী তুলে নিতে হবে, ভারত তুলে নিয়েছে, আজ নয় গত ৫০ বছর ধরে মালদ্বীপে ভারতের সেনাবাহিনীর একটা ঘাঁটি ছিল, হেলিকপ্টার ছিল, শেষ হেলিকপ্টারটাকেও তুলে নিয়ে আসতে হয়েছে। নেপাল যে নেপাল সেও লিপুলেখের ম্যাপ নিয়ে আলাদা মত পোষণ করে, কেবল তাই নয় সে আলাদা ম্যাপ ছাপিয়ে দিয়েছে, জানিয়েছে আলোচনায় বসুন আলোচনা করব কিন্তু ম্যাপে যা দেখানো হয়েছে সেই জায়গা আমার, হ্যাঁ কালী নদীর ধারের জায়গা নিয়ে নেপালের দাবি আজও আছে, জায়গাও তাদেরই দখলে।
ভুটানের কথায় আসা যাক, তাদের দেশে গাড়ি নিয়ে ঢুকলে ৪৫০০ টাকার রেজিস্ট্রেশন ফিজ নিচ্ছে আর প্রতি পর্যটকের জন্য প্রতিদিন ১২০০ টাকা ধার্য করেছে, মানে আপনি সাতদিনের জন্য স্বামী-স্ত্রী ভুটানে গেলে ১৬৮০০ টাকা কেবল ভুটান সরকারকে দিতে হবে, তারপর বাকি খরচ। বেশ ক’বার আমাদের দেশের ট্যুর অপারেটর আসোসিয়েশনের তরফে কথা বলার চেষ্টা হয়েছে, তাঁরা পাত্তাও দেননি, কারণ তাঁদের দেশে এখন মেলা বিদেশি ট্যুরিস্ট, ভারতের ট্যুরিস্ট তাঁদের না হলেও চলবে। শ্রীলঙ্কা কিছুদিন আগেও বিরাট অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, ২০২২ সালে ভারত ৪ বিলিয়ন ডলার সাহায্যও করেছে। কিন্তু একটা বিরাট সময় পর্যন্ত প্রায় ভারতের উপর নির্ভরশীল শ্রীলঙ্কা এখন চীনের বিরাট সাহায্য পাচ্ছে, তারা আদানির সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করেছে, বন্দরে চীনা নৌ বাহিনীর জাহাজ না ঢুকতে দেওয়ার ভারতীয় অনুরোধকে তোয়াক্কা না করেই চীনা জাহাজ ভিড়েছে শ্রীলঙ্কার বন্দরে, নতুন বন্দর গড়ে তোলার জন্য চীনের সঙ্গে কথাও চলছে। বাংলাদেশের কথা তো বাদই দিলাম, ৫৬ ইঞ্চ কা সিনা আজ এতদিন পরেও বলেই উঠতে পারছেন না যে ওই শেখ হাসিনাকে কোন কারণে দেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, তাঁকে কোন মর্যাদায় রাখা হয়েছে? না এসব নিয়ে মুখ খোলার সাহসও দেখাচ্ছেন না ৫৬ ইঞ্চ কা ছাতির প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তান নিয়ে কথা বলে লাভ নেই, চীন নিয়ে অস্বস্তি তো সব্বাই জানে। তাহলে বাকি রইল অব কি বার ট্রাম্প সরকার। তো তিনি পাশে বসেই জানিয়েছেন ওই টারিফের কথা, তাঁর দ্বিতীয় সরকারের শুরুতেই হাতকড়া পরিয়ে ভারতীয়দের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। যে কাজ ছোট দেশ কলম্বিয়া করতে পারে, এমনকী নেপাল করতে পারে সেই কাজ আমাদের দেশের ৫৬ ইঞ্চি ছাতির মোদিজি করে উঠতে পারলেন না। উলটে একবার নয় বহুবার সাফ জানিয়ে দিলেন যে আমেরিকা শুল্ক বাড়াবে। ২ এপ্রিল থেকে শুল্ক বাড়বে। একা ভারতের? না, বহু দেশ আছে। চীন, মেক্সিকো, কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, টার্কি, অনেক দেশ আছে এই তালিকায়। আসুন সেগুলোও দেখে নেওয়া যাক।
১) চীন: চীন ট্রাম্পের ট্যারিফ ঘোষণায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হতে পারে তেমন দেশগুলোর মধ্যে একটা। মার্কিন পণ্যের উপর চীন সমান ট্যারিফ আরোপ করার কথা বলেছে, যার মধ্যে সয়াবিন, অটোমোবাইল এবং রাসায়নিক পণ্য অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ উল্লেখযোগ্যভাবেই বিরাট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতিও বিরাট, এই অবস্থায় যদি দুই দেশই একে অপরের পণ্যের উপর একাধিক রাউন্ডের ট্যারিফ আরোপ করে, তাহলে আমেরিকায় প্রথমে বিপদে পড়বে। চীন জানিয়ে দিয়েছে তারা রাজি, বাণিজ্য যুদ্ধ বা এমনি যুদ্ধ, দুটোর জন্যই তারা তৈরি আছে। চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রক বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) এর নিয়ম লঙ্ঘন করেছে বলেও অভিযোগ করেছে।
২) ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU): ইইউ স্টিল এবং অ্যালুমিনিয়ামের উপর ট্রাম্পের ট্যারিফ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে, যা ১৯৬২ সালের ট্রেড এক্সপেনশন অ্যাক্টের সেকশন ২৩২ এর অধীনে জাতীয় নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্যই আরোপ করা হয়েছিল। বলে তাদের তরফে জানানো হয়েছে। ইইউতে মার্কিন পণ্য হিসেবে যা যায় তা হল মোটরসাইকেল, বারবান হুইস্কি, জিন্স এবং কৃষি পণ্য। এগুলোর শুল্ক বাড়লে একমাত্র কৃষিপণ্য ছাড়া প্রত্যেকতা ক্ষেত্রেই আমেরিকার ক্ষতি, কারণ বিক্রি কমবে। এদিকে ইইউ ডব্লিউটিও-তে একটি অভিযোগ দায়ের করেছে, তাদের বক্তব্য মার্কিন ট্যারিফ অযৌক্তিক এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ম লঙ্ঘন করেছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে নির্বাচন হলে বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসবেন কারা?
৩) কানাডা: কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, ট্রাম্পের স্টিল এবং অ্যালুমিনিয়াম ট্যারিফ বাড়ানোর ঘোষণায় উদ্বিগ্ন কানাডা জানিয়েছে এবার তারাও তাদের পণ্যের শুল্ক বাড়াবে। কানাডা প্রায় ১২.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন পণ্যের উপর বেশি শুল্ক চাপাচ্ছে, যার মধ্যে স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, কফি, কেচাপ এবং হুইস্কি আছে। কানাডীয় বাণিজ্য দফতর হতাশ, তারা বলেছে এই বাড়তে থাকা ট্যারিফ দুই দেশের অর্থনীতি এবং উত্তর আমেরিকান সরবরাহ শৃঙ্খলের ডিস্ট্রিবিউশন চেনের ক্ষতি করবে। ইউএস প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ক্রমশ ক্ষোভ বাড়ছে কানাডায়। ক্যানাডাবাসীদের ক্ষোভের কারণে ইউএস–এর বহু পণ্যের বিক্রি সে দেশে মার খাবে বলে রীতিমতো উদ্বিগ্ন অনেক মার্কিন সংস্থা। কানাডার উপর রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ চাপানোর সিদ্ধান্ত ২ এপ্রিল পর্যন্ত সাময়িক স্থগিত রেখেছেন ট্রাম্প। কিন্তু, তাতে কী! কানাডার বহু বিপণিতে ইউএস–এর একগুচ্ছ লিকার, ওয়াইন ও স্পিরিট ব্র্যান্ডের বিক্রি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জ্যাক ড্যানিয়েলস–এর মালিক সংস্থা ব্রাউন–ফরম্যান–এর সিইও লসন হুইটিং জানিয়েছেন, কানাডার বহু বিপণির তাক থেকে তাঁদের সংস্থার হুইস্কি সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা ‘শুল্ক চাপানোর থেকে বেশি খারাপ’। সম্প্রতি এক আর্নিংস কলে তিনি বলেছেন, ‘এটা আসলে বিক্রি একেবারে বন্ধ করে দেওয়া এবং ২৫ শতাংশ শুল্কের প্রতিবাদে যা একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া।’ ইউএস ওয়াইনের জন্য ক্যানাডা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ রফতানি বাজার, যা কানাডায় বছরে ১.১ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বেশি খুচরো বিক্রি হয়। শুল্ক এবং শুল্কের হুমকি এমন কঠিন সময়ে এসেছে যখন অ্যালকোহল শিল্প নজিরবিহীন ভাবে একগুচ্ছ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।’
৪) মেক্সিকো: মেক্সিকো আমেরিকার আর একটা প্রধান বাণিজ্য অংশীদার, মার্কিন স্টিল এবং অ্যালুমিনিয়াম মেক্সিকোতে আসে। তার শুল্ক বৃদ্ধি মেক্সিকোর কাছে চিন্তার বিষয় কিন্তু তারা জানিয়েছে, মার্কিন পণ্য, যেমন শুয়োরের মাংস, পনির, আপেল এবং স্টিলের উপর শুল্ক বসানোর কথা তারা ভাবছে। মেক্সিকান কর্মকর্তারা এই ট্যারিফ বৃদ্ধির হুমকিকে উত্তর আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (NAFTA) এবং দুটি দেশের মধ্যে বিস্তৃত বাণিজ্য সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকারক বলে এক বিবৃতি দিয়ে তুমুল সমালোচনা করেছেন।
৫) জাপান: জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্টিল এবং অ্যালুমিনিয়ামের প্রধান রফতানিকারক দেশ, ট্রাম্পের ট্যারিফ বাড়ানোর প্রস্তাবে তাদের চিন্তা বেড়েছে, বেড়েছে হতাশা এবং উদ্বেগ। তারা বলেছে এটা বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং মার্কিন-জাপান অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষতি করবে। জাপান ছাড়ের জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তা বিফল হলে তারাও সমান শুল্ক বসানোর কথা বলে রেখেছে।
৬) দক্ষিণ কোরিয়া: দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্টিলের আর একটা উল্লেখযোগ্য রফতানিকারক দেশ, কিছুদিন আগেই দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা চুক্তি করে স্টিল ট্যারিফ থেকে আংশিক ছাড় পেয়েছিল, এখন তা বাড়বে কি না তা নিয়ে আলোচনা চলছেম দক্ষিণ কোরিয়ান কর্মকর্তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিশালী বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্বের উপর জোর দিচ্ছে, পাশাপাশি অন্য দেশেও তাদের রফতানি বাড়ানোর কাজ শুরু করেছে।
৭) তুরস্ক। তুরস্কও মার্কিন দেশে স্টিল এবং অ্যালুমিনিয়াম রফতানি করে। শুল্ক বৃদ্ধি নিয়ে তাদেরও চিন্তা আছে।এদিকে তুরস্ক কয়লা, কাগজ, আখরোট এবং তামাকের মতো মার্কিন পণ্যের উপর নতুন করে শুল্ক বাড়ানোর কথা বলে রেখেছে, তুর্কি কর্মকর্তারা ট্রাম্পের এই ট্যারিফ বাড়ানোর ঘোষণাকে অন্যায্য এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকারক বলে সমালোচনা করেছেন।
সবথেকে মজার ব্যাপার হল বৃহস্পতিবারই ট্রাম্প কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করার করার সিদ্ধান্ত আগামী ২ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত রেখেছেন। মানে ছোট দেশগুলোর হুমকি কাজ করছে। আর আমাদের ৫৬ ইঞ্চ কা সিনা কী করছেন? আমাদের দেশের বাণিজ্য দফতরর হই হই করে শুল্ক কমাচ্ছেন আর কমানোর পরেই জানাচ্ছেন হুজুর আমরা এই এই বিষয়ে, এই এই প্রডাক্টে শুল্ক কমালাম। হ্যাঁ এটাই হল তফাৎ, মোদিজির চিন্তা দেশকে নিয়ে নয়, দেশের অর্থনীতি, দেশের মানুষ তাঁর কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি নয়, প্রথম চিন্তা হল আদানির কী হইবে? আর সেই চিন্তা থেকেই ৫৬ ইঞ্চ কা সিনা এখন কুঁকড়ে সাড়ে ৫ ইঞ্চির হয়ে গেছে, যাকে সিনা না বলে অন্য কিছু বলা উচিত, কী বলা উচিত তা আপনারাই বলুন।