যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আজকের বিষয়, ঘরে কেউটে সাপ ঢুকছে, নজর রাখুন।
গ্রামের শিবমন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশের অধিকার দিতে হবে, এই দাবি ঘিরে দু’পক্ষের সংঘাত থেমেছে কিন্তু উত্তেজনা জারি পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার গীধগ্রামে। বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল সপ্তাহ দুয়েক আগে। প্রশাসন দু’পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসে বিষয়টি মিটমাট করেছিল বটে, কিন্তু শুক্রবার থেকে আবার উত্তেজনা তৈরি হয় গ্রামে। শনিবারও সংঘাতে জড়িয়েছে দু’পক্ষ। এখন চাপা টেনশন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এমনকী গ্রামে পুলিশ পিকেট বসানো হয়েছে। আসলে গীধগ্রামে প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরের পুরনো একটি শিবমন্দির রয়েছে। স্থানীয়েরা জানান, এই শিব ‘গীধেশ্বর’ নামে পরিচিত। শিবরাত্রি আর গাজন উৎসবে মহা ধুমধামের চল আজকের নয়। শিবরাত্রির দু’-তিন দিন আগে গীধগ্রামের দাসপাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন যে, গীধেশ্বরের মন্দিরে পুজো দিতে দেওয়া হয় না দাসপাড়ার শতাধিক পরিবারকে, তারা নাকি নিচু জাতের। স্থানীয় লোকজনেরা জানিয়েছেন, পূর্বপুরুষদের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী গীধেশ্বর শিবের পুজোয় মালাকার সম্প্রদায় মন্দিরের ভিতর পরিষ্কার করে। ঘোষ সম্প্রদায় ভোগের জন্য দুধ-ছানা দেয়। কুম্ভকার মাটির হাঁড়ি সরবরাহ করে। হাজরা সম্প্রদায় মশাল জ্বালানোর দায়িত্বে রয়েছে। নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে কোটাল এবং বাইন সম্প্রদায়েরও। কিন্তু ব্রাহ্মণ ব্যতীত গর্ভগৃহে কেউ প্রবেশ করতে পারেন না। তিন শতাব্দী ধরে চলে আসছে এই নিয়ম। তাই এই প্রথা যাতে না ভাঙা হয়, তা বলার পর থেকেই সমস্যার সূত্রপাত।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | যাদবপুর দখল করো
আচ্ছা এখন এই ব্যাপারটা সামনে আসছে কেন? এতদিন ধরে চলে আসা এক কুপ্রথার বিরোধিতার জন্যই কি এই উত্তেজনা? সাদা চোখে ব্যাপারটা তাই। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে এর একটা অন্য চেহারা দেখা যাবে। মাথায় রাখুন ক’দিন আগেই আরএসএস সরসংঘচালক ঘুরে গেছেন এই রাজ্য, গিয়েছিলেন ওই বর্ধমানেও। আমাদের কাছে খবর, কিছু মানুষ এই ঘটনা ঘটার আগেই ওই গ্রামের কয়েকজনের বাড়িতে ছিলেন, তাঁরা সন্ধেবেলায় বৈঠকও করেছেন এবং তারপর তাঁরা চলে যান। তাঁদের চলে যাওয়ার দিন দুই পর থেকেই এই ঘটনা সামনে আসে, উত্তেজনা ছড়ায়।
দু’ ধরনের মত সামনে আছে। এক, বহুদিনের প্রথা ভাঙা যাবে না, দুই, আজকের দিনেও কেন এই জাতিভেদ থাকবে। এবং তা নিয়ে হাতাহাতির উপক্রম হয়েছিল ক’দিন আগেই, কিন্তু সামাল দেওয়া গেছে। এটা খুব ছোট ব্যাপার নয়, এরকম আরও বেশ কিছু ঘটনা আমরা ২০২৬-এর নির্বাচনের আগে দেখতে পাব, আমি নিশ্চিত। আসলে এটাই সেই গ্র্যান্ড ওল্ড প্ল্যান, ধর্মকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে ভাগ করো। যতটুকু ভাগ হয় ততটুকুই লাভ। আগে এই গ্রামে একচ্ছত্র সিপিএমের রাজত্ব ছিল, তখনও ওই বাবা গীধেশ্বরের পুজো হয়েছে। পরে জমানা পাল্টাল, পুরো গ্রাম তৃণমূলের, পুজো চলছিল। এবারে এই ঘটনার পরে হঠাৎ জয় শ্রীরাম বলার লোকজন বেড়ে গেল। বাবা শিবের থেকে রাম কীভাবে হাজির হল কেউ জানে না। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে ওই গ্রামের এক অংশ আপাতত বিজেপি। ধর্মকে হাতিয়ার করে বিজেপির বেড়ে ওঠা তো নতুন কিছু নয়। তাদের বেড়ে ওঠা, বড় হয়ে ওঠার পেছনে এরকমই ষড়যন্ত্র ছিল। সেই কবে ২২ ডিসেম্বর ১৯৪৯, রাত ৩টের সময় আযোধ্যার আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল এবং বিদ্যুতের চেয়েও বেশি বেগে খবর পৌঁছে গেল “রামলালা নিজেই অবতীর্ণ হলেন তাঁর জন্মভূমীতে।” বাবরি মসজিদকে ঘিরে সেখানকার হিন্দু সাধুদের যে দাবি ছিল তা হয়ে উঠল আরএসএস হিন্দু মহাসভার দাবি। সেই থেকে শুরু মন্দির ওহি বনায়েঙ্গের আন্দোলন। আসল ঘটনা জানার পর পরেরদিনই অযোধ্যা থানার ওসি রামদেও দুবে এফআইআর করলেন যে অভিরাম দাস, রামসকল দাস আর সুদর্শন দাস এবং আরও কয়েকজন মিলে মসজিদে ঢূকে রামালালার মূর্তি বসায়, মসজিদের গায়ে কিছু আঁকিবুকিও কেটে আসে। সেই সময়ে অযোধ্যায় শহর হাকিম গুরু দত্ত সিং, জেলা হাকিম কে কে নায়ার, এস পি কৃপাল সিং এবং বিচারক ঠাকুর বীর সিং এঁরা বৈঠক করেন, রামলালা ভেতরেই থেকে যায়, গ্রেফতার হয় না, দর্শন চলতে থাকে। এই চারজনের প্রত্যক্ষ সাহায্যেই রামলালার মূর্তি থেকে যায়। পরে আদালতের আদেশে দর্শন বন্ধ হয়। তারপরে রাজীব গান্ধী সেই দরজার তালা খোলেন, এবং রামমন্দির আন্দোলন বেড়ে ওঠে যার দৌলতে আজ দেশের ক্ষমতায় বিজেপি। হ্যাঁ সেই একই কাজ এবারে এই বাংলাতেও শুরু হবে, তারা এরকম ছোট ছোট পকেটে দাঙ্গা লাগাতে চায়, এবারে ততটা হয়নি, কিন্তু একটু অসতর্ক হলেই বিষাক্ত সাপের দল বিষ ছড়ানোর সুযোগ পাবে। ঘরে কেউটে সাপ ঢুকছে, নজর রাখুন।