যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আজকের বিষয়, যাদবপুর দখল করো।
সভ্যতার ইতিহাসে দখলদারি কথাটা সম্ভবত খিদে, যৌনতার পরেই সবথেকে প্রবল ইচ্ছে। অকুপাই, রি-অকুপাই, ক্লেম, রিক্লেইম, গ্র্যাব, কনকোয়্যার ইত্যাকার শব্দের বাংলায় একটাই জবাব দখল করো। একটা ভালো গুহা, একটা ভালো গাছের কোটর, একটা সুন্দর গাছপালা ঘেরা নদীর তীর, দখল করো। সেই দখলদারির যুদ্ধই মানব সভ্যতার ইতিহাস, পিছনের কারণ হয় খাদ্য, না হলে নারী। এবং সে সবের অফুরন্ত জোগানের পরে কেবল দখলদারিও চলে এল সামনের সারিতে। বিশাল গ্রিক সাম্রাজ্য হাতেই আছে তবুও আলেকজান্ডার রওনা দিলেন কহা কহা মুল্লুকে, একই ভাবে চেঙ্গিজ থেকে কুবলাই খান থেকে তৈমুর লং, উত্তর থেকে দক্ষিণে গুপ্ত রাজারা, দক্ষিণ থেকে উত্তরে চোল রাজারা। অর্থাৎ সভ্যতা যত বেড়ে উঠল তত গৌণ হয়ে গেল সেই নারী বা খাদ্যের চাহিদা, দখলদারিই হয়ে উঠল এক নেশা। যেমনভাবে দুর্যোধন কেড়ে নিতে চেয়েছিল পাণ্ডবদের রাজত্ব, আমেরিকা ভিয়েতনাম বা হিটলার অস্ট্রিয়া। এরই ছোট সংস্করণ হল তলার সারিতে বিধানসভা দখল, লোকসভা দখল। বিপ্লবীরা দখল চায় রাষ্ট্রের, পুঁজিপতিরা দখল চায় সব সম্পদের, মৌলবাদীরা দখল নিতে চায় মস্তিষ্কের, উদারবাদীরা হৃদয়ের। মোদ্দা কথা কিন্তু সেই একটাই, দখল নাও, দখল করো, দখলে রাখো। সেই দখলের লড়াই আজও চলেছে, তার কাছে সব কিছু গৌণ। একটা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই এ কত মিথ্যে, কত শত ভুয়ো, ফেক তথ্য, প্রত্যেকের হাতে সেই মিথ্যে আর ভুয়ো তথ্যের ঝুড়ি, লক্ষ্য আসলে দখলদারি। আপনি যদি ভাবেন আপনার উন্নতির জন্য, আপনার বিকাশের জন্য, দেশের জন্য, ভাবুন, ভাবতে থাকুন, তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন প্রতিটা পদক্ষেপে কী সরকারি, কী বিরোধী, সবার লক্ষ্য সেই ক্ষমতা দখল, সমবায় নির্বাচন থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন থেকে বিধানসভা লোকসভা প্রত্যেক লড়াই, প্রত্যেক সংগ্রাম আসলে সেই দখলদারির গপ্পো।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | ভোটার লিস্টের ভূত
চলিয়ে অব আইনে কে উস পার সে ভি দেখা যায়, অন্যদিক থেকেও দেখে নেওয়া যাক। যাদবপুর দখল করো। যা হচ্ছে মোদ্দা কথা কিন্তু এটাই। ছাত্র সংগঠন সাফ জানিয়ে দিয়েছে বহিরাগতদের নিয়ে ঢোকা যাবে না। ভাইটি আমার কে ঠিক করবে, কে অন্তর্গত আর কে বহিরাগত?
আসলে তাঁরা মনে করছেন এ তাঁদের দখলদারি এলাকা, এখানে তাঁরা যাঁদেরকে মনে করবেন তাঁরাই বহিরাগত। অতএব রাজ্যের শাসকদলের ছাত্র নেতারা বা রাজ্যের সরকারের মন্ত্রী সান্ত্রীরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত। তারা ঢুকলেই হানো আঘাত। এই করতে গিয়ে কখন জানাই নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও বহিরাগতের তালিকাতে ঢুকে পড়েছেন, অতএব ওনার পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফর্দাফাই। উপাচার্যই যদি ছাড় না পান তো মন্ত্রী কেমনে পাবেন ছাড়, ধর শালাকে। এ তো গেল একদিকের কথা। এসব হওয়ার পরেই বাকিরা হাজির ওই চত্বরে, মানে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী নেতা-কর্মীরা। অরূপ বিশ্বাস থেকে মদন মিত্র জানিয়ে দিলেন যাদবপুর দখল করতে এক মিনিটও লাগবে না, আর এলাকার এমপি সায়নী ঘোষ জানিয়ে দিলেন সামলে যাও সোন্টা মন্টারা না হলে কপালে বিপদ আছে, পুরা মিট্টি মে মিলা দেগা, মাটিতেই মিশিয়ে দেব। বাম, অতিবাম, তৃণমূলের এ হেন দখলদারির লড়াইয়ে বাদ যাবে কেন বিজেপি, নন্দীগ্রাম থেকে নন্দী-ভৃঙ্গিদের ফৌজ নিয়ে হাজির আমাদের কাঁথির খোকাবাবু, আম্মো আছি ধরনের একটা জুলুস বার করলেন, হ্যাঁ ওনারা মিছিল বলেন না, হয় মহার্যালি না হলে জুলুস বলেন এবং সেখানে বাঁকুড়ার ওন্দা বিধানসভার বিজেপি এমএলএ অমরনাথ শাখা এলেন, তিনি জানিয়ে দিলেন গোটা দায়টা বিজেপি আর তাদের ছাত্র সংগঠন এবিভিপির উপরে ছেড়ে দিলে আধ ঘণ্টার মধ্যেই সব সাফ করে দেবেন। আমরা শিহরিত, এ বলছে তিন মিনিট, ও বলছে দেড় মিনিট, আর একজন বলছে আধ ঘণ্টা লাগবে যাদবপুরের দখল নিতে। অথচ সেই কোন আদিকাল থেকে যাদবপুরের এমএলএ এককালে ছিল সিপিএম-এর, সেদিনও সিপিএম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল নিতে পারেনি, পরবর্তীতে লাগাতার এমএলএ-এমপি জিতেছেন তৃণমূলের কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল নেওয়া সম্ভব হয়নি। দখলদারি বজায় রেখেছেন বাম অতিবামেরা, তাঁরা সিসিটিভি লাগাতে দেবেন না, তাঁরা র্যাগিং করে ছাত্র মারবেন, তাঁরা বহিরাগত নিজেরাই চিহ্নিত করবেন তারপর তাঁকে তাড়াবেন, তাঁরা চাইলে সিনেমা দেখানো যাবে, না চাইলে দেখানো যাবে না। সবমিলিয়ে পাবলিকের এক বুঝুম্ভুল অবস্থা, চলছেটা কী? আসলে দখলদারির এক বিচিত্র নাটক এই যাদবপুরে, যা দখলদারদের আলাদা আলাদা বয়ানে বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই তৈরি করে না।