যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আজ বিষয় ভোটার লিস্টের ভূত।
ভোটার লিস্টের ভূত নিয়ে কথা বলতে গেলেই সেই বৃদ্ধ মানুষটির কথা মনে পড়ে যায়, তিনি সত্তরোর্ধ্ব এক মানুষ, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ডাঁটিভাঙা চশমা, বুথে ঢুকে ভোটার তালিকার সঙ্গে তার নাম মিলিয়ে নেওয়ার সময়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার পরে নাম, সারদা সুন্দরী ঘোষ, তাঁর ভোট। ছোকরা থার্ড পোলিং জানালেন, হ্যাঁ আপনার স্ত্রী এই তো একটু আগেই ভোট দিয়ে চলে গেলেন। ভদ্রলোক দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন এবারেও একটুর জন্য দেখা হল না। প্রিসাইডিং অফিসার সেও ছোকরাই বলা যায়, তিনি কৌতুহল না ধরে রাখতে পেরেই জিজ্ঞেস করলেন, কাকা, আপনার স্ত্রী কি আপনার সঙ্গে থাকেন না? মানে…। বৃদ্ধ চশমাটা খুলে চোখের পিচুটি পরিষ্কার করছেন এমন এক ভাব করে চোখের জলটাকে পড়ে যেতে দিলেন না, বললেন, না মানে উনি তো ১৩ বছর আগেই মারা গেছেন, কিন্তু দেখুন প্রতিটা নির্বাচন, লোকসভা, বিধানসভা, মিউনিসিপালিটির ভোট এলেই আমার আগেই ভোটটা দিয়ে টুক করে চলে যান। এবারেও যেমন আমাকে ফাঁকি দিয়েই ভোটটা দিয়ে চলে গেছেন। বৃদ্ধ চলে গেলেন, ভোটার লিস্টে জ্বলজ্বল করছে প্রমাণ সারদাসুন্দরী ঘোষ তাঁর গণতান্ত্রিক কর্তব্য সেরে চলে গেছেন। হ্যাঁ, এটাই সেই ভোটার লিস্টের ভূত। এর ইতিহাস দীর্ঘ। বামপন্থীরা নির্বাচনে নেমেছিলেন ঠিকই, সেই ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, রণদিভের লাইন ছেড়ে ঢুকে পড়েছিলেন এই সংসদীয় গণতন্ত্রের ফাঁকে ফোকরে, কিন্তু কোনওদিনই সেই গণতন্ত্রকে মন থেকে মেনে নেননি, কারণ বুকের মধ্যে স্লোগান আর মগজের ভিতরে স্বপ্ন লাল কিলে পর লাল নিশান। এসব তো ছ্যাঃ, বুর্জোয়া গণতন্ত্র, একে ব্যবহার করাটাই কাজ, মাত্র ব্যবহার করা। কাজেই সেই শুরুর দিন থেকে তারা অসাধারণ সব কায়দায় এই ভোটার লিস্টে, বুথে ভূত ঢোকানো শুরু করেন। অন্যদিকে কংগ্রেসের ধারণা স্বাধীনতা গণতন্ত্র ইত্যাদি তো তেনাদের বাপকেলে সম্পত্তি, কাজেই তেনারা কোনও সূক্ষ্ম পদ্ধতি, কায়দাবাজি নয়, এক্কেবারে সরাসরি বুথ দখল করে, ভোটারদের আটকে সেই ভূতুড়ে খেলাতে যোগ দিল। চলছিল বেশ, এ হারলে ও ভূতের কথা বলে, সে হারলে এ। এরমধ্যে এক অত্যন্ত তেএঁটে লোক ব্যাগড়া দিল, টি এন সেশন, বললেন ভোটার কার্ড করব, প্রত্যেকের ভোটার কার্ড থাকবে। সে কী হাসি, সে কী খোরাক। বাম ছাত্র যুবরা রাস্তাতে ভাষণ দিচ্ছেন, মাথার উপর ছাদ নেই যাঁদের, ঝড়ে বন্যায় যাঁদের ঘর উজাড় হয়, তাঁরা রাখবেন কোথায় এই এপিক কার্ড? মাথাতেও নেই এরই মধ্যে বাম সরকার ক্ষমতায় নয় নয় করে ২০ বছর। জ্যোতি বসু বলেই দিলেন এই সেশন হলেন একজন মেগালোম্যানিয়াক। ওদিকে রাস্তায় মমতা, নো এপিক, নো ভোট, ভোটার কার্ড ছাড়া ভোট হবে না। এবং শেষমেশ ২১ জুলাই ১৯৯৩ ১৩ জনের শহাদত। দেশের মানুষ পেল এপিক কার্ড, ভোটার কার্ড।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | ট্রাম্প বিশ্ব মানবতার শত্রু
টি এন সেশন বলেছিলেন আমি এক ঝটকায় এই জাল ভোটার, ভুয়ো ভোটার ইত্যাদির সমাধান এনে দিয়েছি, এটাই আমার লক্ষ্য ছিল, আই হ্যাভ আচিভড দ্যাট। কিন্তু উনি জানতেন না, উনি ডালে ডালে চলেন, আর এনারা পাতায় পাতায় চলেন। ভোটার কার্ড হওয়ার পরে বহু জায়গাতেই ভূতের আনাগোনা খানিক কমল বটে কিন্তু আমাদের এই বাংলায় সেই ভূতকে কে রোখে?
২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে সারা বাংলার বেশ কিছু বুথে শাসকদল ১০০-তে ১০০, মৃত, অসুস্থ, পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়া ভূতেরা নির্বিঘ্নে এলেন বুথে, ভোট দিলেন। কাজেই এবার দাবি উঠল ভোটার লিস্ট সংশোধনের এবং তারপর থেকে লাগাতার সেই ভোটার লিস্ট নিয়ে অভিযোগ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই অভিযোগের একটা পরিসমাপ্তি হল ২০১১-তে। ২৩৫ থেকে সিপিএম নেমে এক্কেবারে ৩৫ এবং তারপরে আপাতত শূন্য এবং স্বাভাবিকভাবেই চেয়ারের ওপাশে দাঁড়িয়ে এবার সেই ভোটার লিস্টের ভূতের কথা আমরা শুনছি সিপিএম এবং বামেদের মুখে। যাকে বলে ভূতের মুখে রামনাম। ভুয়ো ভোটার আর ভোটার লিস্টের কারসাজিতেই জিতে যাচ্ছে শাসকদল এরকম একটা কথা চলছিল, এরমধ্যে বিজেপি মাঠে হাজির। কেন্দ্রে তাদেরই সরকার অতএব শুরু হল কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরাট পাহারা আর তা নিয়ে কাজিয়া। এবারে আর নড়তে দেব না, ম্যান মার্কিংয়ে পেড়ে ফেলা হবে অনুব্রতকে ইত্যাদি বলে আসর গরম করার পরে দেখা গেল তৃণমূল অনায়াসে গোল দিয়েছে, তারা তো বলেই ছিল খেলা হবে এবং সেই আগের প্লেয়ার আপাতত মাঠের বাইরে, কংগ্রেস, সিপিএম শূন্য। এবারে কিন্তু আবার নতুন করে খেলা জমে উঠেছে, সারা ভারতেই উঠেছে ভুয়ো ভোটার মানে ওই ভোটার লিস্টে ভূতের কথাগুলো, বিরোধী প্রায় প্রত্যেক দলই এ নিয়ে তাঁদের সন্দেহ জানিয়েছে, কাজেই তৃণমূলও আসন্ন ২০২৬-কে মাথায় রেখে গোটা দলকেই রাস্তায় নামানোর জন্যই এই ভোটার লিস্টে ভূতের তথ্য এনে হাজির করেছেন এবং কী আশ্চর্য, শান্তিকুঞ্জের খোকাবাবুর মনেই নেই যে ওনাদের হাতেই দেশের ক্ষমতা, তো ওনারাও পালটা নেমেছেন ওই একই দাবিতে, ভোটার লিস্টের ভূত ভাগাও। দেখা যাক সম্মিলিত চিৎকারে ভূত ভাগে কি না।