Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar | ২০০০ নোট এল কেন? যাচ্ছে কেন?    

Fourth Pillar | ২০০০ নোট এল কেন? যাচ্ছে কেন?    

Follow Us :

শিশু, বুদ্ধি শুদ্ধি লোপ পেয়েছে এমন বৃদ্ধ, উন্মাদ বা মানসিকভাবে অসুস্থদের একটা বিষয় তো কমন, তাদের যুক্তিবোধ নেই। কেন একটা কিছু করলেন বা করলেন না, এই যুক্তিবোধ আপনি কোনও উন্মাদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই আশা করেন না। বরং যুক্তিহীনতাকেই সাধারণত পাগলামি বলেই মনে করা হয়। বাপরে কি ডানপিটে ছেলে, শিলনোড়া চুষে খায় দুধভাত ফেলে, এখন সেই শিশু ভোলানাথকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বাছা তুমি দুধভাত ফেলে শিলনোড়া চুষছ কেন? সে কি কোনও জবাব দেবে? বহুদিন আগে লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের লেখা, তাঁরই কোনও আত্মীয়ের সন্তানের গল্প— বছর ৫ কি ৬, সে বিচ্ছু একটা দামি টেবিল ঘড়িকে প্রথমে খোলার চেষ্টা করেছে, তারপর তাকে ঝুমঝুমি বানিয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে রয়েছে। তাকে বলা হল কেউ তোমাকে মারবে না বকবে না, কেবল বলো ঘড়িটা তুমি ভাঙলে কেন? ছেলেটির জবাব ছিল, ভাঙতে পারি, তাই ভেঙেছি। সিম্পল। কিন্তু একজন পূর্ণ বয়স্ক সুস্থ মানুষ যদি এটা করেন? তাহলে জেনে রাখবেন তিনি অসুস্থ, তাঁর চিকিৎসা দরকার। ২০০০ টাকা নোট বাতিল প্রসঙ্গেই এই কথাগুলো বলা। আচ্ছা বলুন তো কেন এই ২০০০ টাকার নোট বাজারে আনা হল? কেন সেই নোট আবার তুলে নেওয়া হল? এ কি এক উন্মাদের পাঠক্রম? এক মেগালোম্যানিয়াকের ইচ্ছাপূরণ? এক মহম্মদ বিন তুঘলকের ফতোয়া। নাকি এই আপাত পাগলামির মধ্যে আছে আরও অনেক বড় খেলা? আসুন সেটাই আলোচনা করা যাক। 

ইতিমধ্যেই আমরা জেনে ফেলেছি নোটবন্দি ছিল এক অশিক্ষিত, উন্মাদের কাজ, যা দিয়ে কোনও উদ্দেশ্যই সাধিত হয়নি, অবশ্য কারওর উদ্দেশ্য যদি দেশের মানুষকে চূড়ান্ত হয়রানির মধ্যে ফেলা হয়, তাহলে সে উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে বইকী। কিন্তু আপাত উদ্দেশ্য বলে মানুষকে যা বলা হয়েছিল তার একটাও অর্জন করা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বক্তৃতা শুনে দেখুন, উনি সাফ বলছেন এই নোটবন্দির সিদ্ধান্ত ছিল কালো টাকা উদ্ধারের জন্য। মানে ওনার সাদা মাথায় নাকি এটাই মনে হয়েছিল যে মানুষ বিছানার নীচে কালো টাকা লুকিয়ে রেখেছে, কাজেই নোট বাতিল করলে সে টাকা তো জমা দিতে আসবে না, মাঝখান থেকে সরকারের হাতে এসে যাবে এক বিরাট ভাণ্ডার। কিন্তু বাস্তবে হল কী? ৯৯.৯ শতাংশ টাকা ফিরে এসেছে, আমি বলছি না, দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলছে। কী ভাবে এল? বিভিন্ন ভাবে এসেছে, আমরা যতটা না জানি, মোদিজির বন্ধুরা, অমিত শাহের বন্ধুরা তার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। আমরাই এই কলকাতার বুকে আরএসএস ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ীকে জানি যিনি ১৫-১৮-২০ শতাংশ কমিশন নিয়ে বাতিল নোট নিয়ে নতুন নোট দিয়েছেন। মানে কালো টাকা এল না। না এল দেশের বাইরে থেকে, না এল দেশের মধ্যের কালো টাকা। এরপর যুক্তি ছিল কাউন্টারফেইট নোট, জাল টাকা। যেমন ছিল তেমন চলছে, ২০০০ টাকার জাল নোট পাওয়া গেছে বাজারে আসার মাসখানেক পর থেকে। এরপরের যুক্তি আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেননি, এই ঘোষণায় প্রথমে ভ্যাবাচাকা খাওয়া অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি পরে দলের মুখরক্ষার জন্য দিয়েছিলেন। বলেছিলেন এর ফলে দেশে ডিজিটাল অর্থনীতি বাড়বে, ডিজিটাল লেনদেন বাড়লে দেশের সুবিধে ইত্যাদি। এই কথাগুলো ১০০ শতাংশ সত্যি। কিন্তু এরসঙ্গে নোটবন্দির কী সম্পর্ক তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি কোনও যুক্তিই খাড়া করতে পারেননি শুধু নয়, যুক্তি যে ছিল না, তাও জানতেন, দলের ভেতরেই সই, তিনি একথা বলেওছেন। খেয়াল করে দেখুন তিনি ওই কালো টাকা বা জাল নোটের কথা প্রায় বলেনইনি। সে যাই হোক, চালু হল নতুন নোট এবং বছর দুয়েকের মধ্যেই তিনটে জিনিস লক্ষ করা গেল। এক, বিভিন্ন জায়গায় যে টাকা ইডি বা ইনকাম ট্যাক্স উদ্ধার করছে তার সিংহভাগ ২০০০ টাকার নোট। কারণ খুব সোজা, ২০০০ টাকার বান্ডিল কম জায়গা নিচ্ছে। এরপরের তথ্য হল কাউন্টারফেইট নোট বা জাল টাকারও সিংহভাগ ২০০০ টাকার, ওই একই কারণে। এবং ২০০০ টাকা ছাপা বন্ধ করা হচ্ছে, বাজারে নতুন ২০০০ টাকার নোট আসছেই না। গোদি মিডিয়ার সুধীর চৌধরি অ্যান্ড কোম্পানি এই ২০০০ টাকায় চিপ আছে, সে চিপ নাকি স্যাটেলাইটের সঙ্গে লিঙ্কড ইত্যাদি আষাঢ়ে গল্প বাজারে ছেড়েছিলেন, ততদিনে মানুষ বুঝে গেছে সেসব নেহাতই বকওয়াস। সু সুধীর চৌধরি, অঞ্জনা ওম মোদি থুড়ি কাশ্যপ এবং অন্যরা কিছুদিনের মধ্যেই ভুলে গেলেন এই গোলাপি নোটের কথা। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদি–শাহ এক অর্ধসত্যের কারবারি     

এবং কী আশ্চর্য, খেয়াল করে দেখুন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ঘরে ২০০০ টাকার নোট নেই বললেই চলে। অন্তত আবার নোট বাতিলের কথা শুনে আমি বাড়িতে অনেক খুঁজেও একটা ২০০০ টাকার নোট পেলাম না, বাজারে লেনদেনের সময়েও এই ২০০০-এর নোট কি তেমন দেখা যাচ্ছে? কিন্তু হিসেব বলছে বাজারে ১৮১ কোটি ২০০০ টাকার নোট আছে। সেই সময় আবার এই ২০০০ টাকার নোট বাতিলের খবর এল। কে দিলেন? প্রথমবারে তো বিরাট নৌটঙ্কি, গলা কাঁপিয়ে, হাততালি দিয়ে আজ সে হাজার আউর ৫০০ কা নোট কাগজ কা টুকরা হো গয়া, মোদিজির চোখেমুখে কী আনন্দ। তারপরেই জাপান চলে গেলেন, জাপান থেকে ফিরেই হম তো ফকির হ্যায় ঝোলা লেকে চল পড়েঙ্গে, ৫০ দিন কা সময় দিজিয়ে ইত্যাদি বাওয়াল শুনেছিলাম। এবার? এবারে তিনি এ নিয়ে একটা কথাও বলেননি। নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন শক্তিকান্ত দাস, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান। জানানো হয়েছে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মানুষ এই নোট ব্যাঙ্কে গিয়ে জমা করে ৫০০ বা ১০০ বা তারও কম মূল্যের নোটে ভাঙিয়ে নিয়ে আসতে পারবেন। কেউ কোনও প্রশ্ন করবে না, কেউ কেওয়াইসি চাইবে না, আধার নম্বর চাইবে না, যত বার খুশি ব্যাঙ্কে যান, টাকা বদলে ঘরে আসুন। এবার ব্যাঙ্কের সামনে লাইন আমজনতার, শুনেই বলবেন এই তো বললেন আমজনতার কাছে ২০০০-এর নোট নেই, তাহলে তাঁরা কেন লাইনে দাঁড়াবেন? খোঁজ নিয়ে দেখুন বড়বাজারের গদিতে এমন কি মুটে মজুরদেরও ২০০০ টাকার নোটে মজুরি দেওয়া হচ্ছে, কেরানিদের মাইনে দেওয়া হচ্ছে। কেবল তাই নয়, এটা ধান বিক্রির সময়, ধানকলের মালিকরা চাষিদের হাতে ২০০০ টাকার নোট দিয়ে দিচ্ছেন, ফ্যাক্টরিতে অনেক সময়েই ক্যাশে মাইনে হয়, সেখানে ২০০০ টাকার নোট আসছে। গলায় মোটা চেন বাবুরা ঘড়ি কিনছেন, দামি গগলস কিনছেন, আলফানসো আম কিনছেন, গলদা চিংড়ি কিনছেন ওই ২০০০ টাকার নোটে। 

আমজনতার কাছে ফিরে আসছে সেই জমানো নোট, সময় আছে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, ১৮১ কোটি ২০০০ টাকার নোট এই আমজনতাই ফিরিয়ে দেবে ব্যাঙ্কে, ঠিক এরকমটাই তো হয়েছিল নোটবন্দির সময়ে। কেউ ড্রাইভারের ৬ মাসের মাইনে দিয়েছিল, কেউ রান্নার মাসিকে ঘর তৈরি করার টাকা দিয়েছিল আগাম মাইনে বলে, সে সব দয়ার কথা তো আমরা জানি। সেবারও কৃষকরা ধান বিক্রি বাবদ টাকা পেয়েছিল বাতিল নোটে, পাবার পরের দিনেই ব্যাঙ্কের সামনে লাইন দিয়েছিল। আম্বানি আদানি তো ছেড়ে দিন, আপনার চোখের সামনে বাজোরিয়া, সারাফ বা চুড়িওয়ালেরা কি একবারের জন্যও দাঁড়িয়েছিল ব্যাঙ্কের সামনে, এটিএম-এর দরজায়? এবারে নিশ্চিত এই ২০০০-এর টাকা জমা ছিল, অন্তত ওই ১৮১ কোটি ২০০০ নোটের সিংহভাগ জমা ছিল বিত্তশালীদের হাতেই, কিন্তু এবার তাদের ধীরেসুস্থে সেই টাকা বদলে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হল। টাকা চলে যাবে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, বালি, মালদ্বীপে, তারপর এমনকী ৩০ সেপ্টেম্বরের পরেও সেই টাকা ফিরে আসবে নিজেদের কাছে, তারই ব্যবস্থা করার জন্য মোদি সরকার এবার বড্ড সদয়। কেবল এই প্রশ্নটা করুন, কেন ২০০০ টাকার নোট আনা হয়েছিল? কেন সেই নোট আজ বাতিল করা হচ্ছে আর বাতিল করার সময় এবার সরকার এত সদয় কেন? বুঝতে পারবেন, আপাত কেয়স মনে হতেই পারে, মনে হতেই পারে যে এ এক উন্মাদের পাঠক্রম, কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন এর পেছনে আছে পাকা মাথা। সে মাথার বুদ্ধিতেই দেশের কালোবাজারিরা ধীরেসুস্থে তাদের যাবতীয় কালো টাকাকে সাদা করে নেওয়ার সুযোগ পেল, অথচ দেশের মানুষের কাছে জানানোও হল যে দেশের সরকার ব্ল্যাক মানির বিরুদ্ধে লড়ছে। সেবারও দেশের মানুষের টাকাতেই এই নোটবন্দির জন্য যাবতীয় খরচ মেটানো হয়েছে, পয়সা তো বিজেপি বা মোদি শাহ দেয়নি। ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা দিবারাত্র খেটেছেন, কেবল এই ২০০০ টাকার নোটের সাইজের জন্য গোটা দেশের এটিএম মেশিনে পরিবর্তন আনতে হয়েছে, ২০০০ টাকার নোট ছাপতে বিপুল খরচ হয়েছে। এখন সবটাকেই এক প্রহসন করে ছেড়ে দিল এই মোদি–শাহ সরকার। এবং লক্ষ করুন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে, তিনি যেন শিশু ভোলানাথ, ২০০০ টাকার নোট বাতিল হচ্ছে? তাই নাকি? কই আমি তো জানিই না। এরকম এক মুখ নিয়ে তিনি ঘুরছেন। সাত বছর আগের নোটবন্দি, ২০০০-এর নোট আনা, আবার তাকে বাতিল করা নিছক পাগলামি নয়, এ এক পরিকল্পিত শয়তানি, যা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার কাজেই ব্যস্ত। দেশের অর্থনীতি মানে মোদি-শাহ বোঝেন ২০-২৫ শতাংশ মানুষের খেয়েপরে বেঁচে থাকা, বাকি মানুষকে তো তিনি রেশনে চাল গম ফ্রি দেবেন, মরে যেতে যেতে তারা দেখবে মোদির কৃপায় দাড়ি গজায়, ভাল্লুকে খায় শাকাঁলু, মোদি আমার পরম দয়ালু। একবেলা খেয়ে সেই ৭৫ শতাংশ মানুষ বেঁচে থাকবেন, সেই সময়কালেই মুকেশ আম্বানির বাড়ির দাম ১৫ হাজার কোটি টাকা, নোটবন্দি বা নোট বাতিলে তেনাদের কিছুই যায় আসে না।

RELATED ARTICLES

Most Popular