Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar | মোদি–শাহ এক অর্ধসত্যের কারবারি    

Fourth Pillar | মোদি–শাহ এক অর্ধসত্যের কারবারি    

Follow Us :

গতকাল অমিত শাহ হাজির ছিলেন এক প্রেস কনফারেন্সে। যেন এক বিরাট ঐতিহাসিক তথ্যকে দেশের মানুষের সামনে এনে রাখছেন, প্রায় তেমন কায়দাতেই এক অর্ধসত্য এনে হাজির করলেন দেশের মানুষের সামনে। জানালেন, লর্ড মাউন্টব্যাটেন, ভারতের শেষ ভাইসরয় নাকি জওহরলাল নেহরুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে এই ট্রান্সফার অফ পাওয়ার-এর জন্য কোনও বিশেষ অনুষ্ঠান করা হবে কি না। এটা শুনে জওহরলাল নেহরু নাকি চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীকে এরকম কিছু করা যায় কি না তার খোঁজ খবর নিতে বলেন। রাজাগোপালাচারী নাকি বহু পুঁথি ঘেঁটে বই পড়ে এক রীতির কথা জানান। চোল বংশের এক রাজা অন্য রাজার হাতে ক্ষমতা দেওয়ার সময় এক রাজদণ্ডের হস্তান্তর হত, রাজ্যাভিষেকের অঙ্গ হিসেবেই রাজদণ্ড যেত নতুন রাজার হাতে। প্রায় ৮০০ বছর ধরে চলে আসা এই রাজদণ্ড বা সেঙ্গল হস্তান্তরণ হত। দক্ষিণের এক মঠের উদ্যোগে এই রাজদণ্ড বা সেঙ্গল স্থানীয় এক সোনার দোকানে তৈরি হয়। রাজদণ্ডের মাথায় শৈব চোল রাজাদের চিহ্ন হিসেবে শিবের বাহন নন্দীকে রাখা হয়েছে, সমৃদ্ধির প্রতীক এই রাজদণ্ডকে দিল্লিতে আনেন সেই মঠাধীশ। তারপর নাকি ওই রাজদণ্ড প্রথমে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের হাতে দেওয়া হয়, তিনি সঙ্গে সঙ্গেই তা ওই মঠাধীশকে ফিরিয়ে দেন। তারপর ওই সেঙ্গলটিকে গঙ্গাজল দিয়ে পবিত্র করা হয়, মন্ত্রোচ্চারণ হয়, এবং তুলে দেওয়া হয় জওহরলাল নেহরুর কাছে। এই ঘটনার দুজন সাক্ষী আছেন, যাঁরা ওই সোনার রাজদণ্ডটা তৈরি করেছিলেন, এখন সেই রাজদণ্ড কোথায় পাওয়া গেল? দক্ষিণের এক মঠ থেকে তা পাওয়া গেছে। বাকি ইতিহাস কারা বলছেন? দমিনিক লাপিয়ের-এর ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট-এ জওহরলাল নেহরুর হাতে এই সেঙ্গল তুলে দেওয়ার অনুষ্ঠানের কথা আছে, ১৪ আগস্ট বিকেলে এই অনুষ্ঠান হয়েছিল। 

বাকি কথা কারা জানাল? মানে ওই লর্ড মাউন্টব্যাটেন জওহরলালকে বললেন, জওহরলাল রাজাগোপালাচারীকে বললেন, মঠাধীশ লর্ড মাউন্টব্যাটেনের হাতে এই রাজদণ্ড দিলেন এবং নিলেন, এসব তথ্য কে জানালেন? ছোটা মোটাভাই অমিত শাহ। কোন সূত্রে জানা গেল? না, কোনও সূত্রের হদিশ তিনি দেননি, বলেছেন, বহত রিসার্চ কর করকে ইয়েহ পতা চলা। এবার আসুন ঘটনাক্রমকে সাজানো যাক। প্রথম কথা, ট্রান্সফার অফ পাওয়ার নিয়ে। ১৯৪৭-এ দেশের মানুষ পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছিল, সেই স্বাধীনতাকে কমিউনিস্টরা এবং হিন্দু মহাসভার সদস্যরা মেনে নেয়নি, তাঁরা এটাকে ক্ষমতার হস্তান্তর বলেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন বা বলতে চেয়েছিলেন ৪৭-এর স্বাধীনতা অর্জিত স্বাধীনতা নয়, ব্রিটিশরা চাপে পড়ে কেবল ক্ষমতার হস্তান্তর করেছিলেন, একে স্বাধীনতা বলা যায় না, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। কমিউনিস্টরা পরবর্তী সময়ে এই ভুল শুধরে নিয়েছেন, কিন্তু হিন্দু মহাসভা, আরএসএস? না, তাঁরা যে কোনওদিনই এই স্বাধীনতাকে মেনে নেননি তার প্রমাণ হল এখনও তাঁরা এটাকে ক্ষমতার হস্তাস্তর বলেই মনে করেন, এক রাজার থেকে তাঁর বংশের একজনের কাছে স্রেফ ক্ষমতার হস্তান্তর, রাজদণ্ড তুলে দেওয়া। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষের অবর্ণনীয় সংগ্রাম মিথ্যে হয়ে গেল, শয়ে শয়ে বিপ্লবীর ফাঁসিকাঠে ওঠা বিফলে গেল, নেতাজির যুদ্ধের কোনও প্রভাব নেই, নৌ বিদ্রোহ তো কিছুই নয়, গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন, ৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কোনও অর্থই নেই, স্বাধীনতা অর্জন করে আসেনি, স্বাধীনতা এসেছে ক্ষমতার হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে। গতকাল অমিত শাহ সেটাই আরও একবার প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | নেকড়ে আর ভেড়ার ছানার গল্প   

সেদিন যাঁরা বলেছিলেন এটা স্বাধীনতা নয়, ক্ষমতার হস্তান্তর, যাঁরা বলেছিলেন ত্রিবর্ণ পতাকা আমাদের পতাকা হতেই পারে না, যাঁরা মেনে নেননি আমাদের সংবিধান, সেই তারা, আরএসএস–বিজেপি আজ আবার এক অর্ধসত্যের পাহাড় সামনে রেখে তাঁদের কথাই প্রমাণ করতে চাইছেন। ওই প্রেস কনফারেন্সে দেখানো ডকুমেন্টারিতে নজর রাখুন। দুটো কাগজ দেখানো হচ্ছে, একটা টাইম ম্যাগাজিনের অংশ, যেটা ছাপা হয়েছে ২৫ আগস্ট, ১৯৪৭। অন্যটা অ্যান্টনি ফার্নান্দো লিখেছেন, তিনি কি লেখাটা ১৯৪৭-এ লিখছেন? না তিনি বহু পরে এই লেখা লিখেছেন, যেটাকে অমিত শাহ প্রামাণ্য দলিল বলে চালাতে চাইছেন। কিন্তু চালাকি তো ধরা পড়ে যায়। অ্যান্টনি ফার্নান্দোর প্রতিবেদনের পাশে @Mayiladuthurai লেখা আছে, এমনটা ১৯৪৭ কেন? ১৯৮০তেও লেখা হত না। মানে কিছুদিন আগে ছাপা এক প্রতিবেদনকে ১৯৪৭-এর ডকুমেন্ট বলে চালানোর চেষ্টা করছেন অমিত শাহ। যে ডকুমেন্টে বলা হচ্ছে, স্বাধীনতা দিবসের সেই বিখ্যাত ভাষণ ট্রিস্ট উইথ ডেসটিনি বলার ১৫ মিনিট আগেই নাকি জওহরলাল নেহরুর মাথায় ছাই মাখিয়েছিলেন মঠাধীশ, হাতে দিয়েছিলেন রাজদণ্ড, ওটাই নাকি ছিল ট্রান্সফার অফ পাওয়ারের মূল অনুষ্ঠান। ঠিক অন্য কিছু লেখা হচ্ছে ওই ২৫ আগস্ট ১৯৪৭-এর টাইম ম্যাগাজিনে। লেখা হচ্ছে সকালটা শুরু হয়েছিল সরোজিনী নাইডুর কথা দিয়ে, ‘ও লাভলি ডন, আহা কী সুন্দর এই সূর্যোদয়, কিন্তু তারপরেই অ্যাগনস্টিক, ইশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান জওহরলাল নেহরুর মাথায় মাখানো হল ছাই, দক্ষিণের মঠাধীশ তাঁর মাথায় গায়ে গঙ্গাজল ছড়িয়ে দিলেন, হাতে দিলেন সেঙ্গল। এই অনুষ্ঠানের পরে সন্ধেয় তিনি এবং তাঁর মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা গেলেন ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের বাড়ি, সেখান থেকে ফিরে কলাগাছ দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছিল, প্রচুর মানুষ ছিল। তিনি, রাজেন্দ্র প্রসাদ, অন্যরা সংসদের সেন্ট্রাল হলে পৌঁছলেন। খানিকক্ষণ পরে শুরু হল অনুষ্ঠান। 

না, সেদিন কংগ্রেসের কোনও নেতার মুখে শোনা যায়নি ট্রান্সফার অফ পাওয়ারের কথা, ওনারা বলেছিলেন স্বাধীনতা এসেছে। এই সেঙ্গল দেওয়া যদি রাষ্ট্রের অনুষ্ঠান হত তাহলে তা ঘটত এই সংসদ ভবনে এবং সেই সেঙ্গল রাখা হত সংসদেই, কোনও মিউজিয়ামে নয়। এটা সেদিনের আর পাঁচটা মানুষের নানান অনুষ্ঠানের মতোই একটা অনুষ্ঠান ছিল। কীরকম ছিল সেসব অনুষ্ঠান? আজমের শরিফে ধুমধাম করে চাদর চড়ানো হয়েছিল সেই দিনেই। দিল্লির জামা মসজিদের তরফে সাতদিন ধরে মানুষদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। দিল্লির শিখ সমুদায় কেবল নয়, পঞ্জাবে গোল্ডেন টেম্পলেও অখণ্ড কীর্তন প্রার্থনার আয়োজন হয়েছিল। কামাখ্যা মন্দিরে পুজো হয়েছিল। বেলুর মঠের সন্ন্যাসীরাও সেদিন অনুষ্ঠান করেছিলেন। অমিত শাহের চোখে পড়ল কেবল সেঙ্গল, তাই নতুন পার্লামেন্ট উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি ওই সেঙ্গল নিয়ে হাজির। কেন? সেদিন আজমের শরিফে দরগায় চাদর চড়ানো হবে না কেন? স্বর্ণমন্দিরে উৎসব? জামা মসজিদের তলায় কি আসবেন হাজার হাজার মানুষ খাবার খেতে? না, এসব তাঁর মাথায় নেই। মোদি-শাহ সাভারকরের জন্মদিনে ১৫ আগস্ট ১৯৪৭-এর এক ছোট্ট অনুষঙ্গকে বেছে নিয়ে দুটো খেলা খেললেন বা খেলার চেষ্টা করছেন, প্রথমটা হল মানুষকে বলা— ওটা তো স্বাধীনতাই ছিল না, ওটা ছিল ট্রান্সফার অফ পাওয়ার। ব্রিটিশরা রাজদণ্ড তুলে দিয়ে গিয়েছিল কংগ্রেসের হাতে, কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা তো হল। দু’ নম্বর বিষয় হল গোটা অনুষঙ্গতে হিন্দু সনাতন ধর্মের গাঢ় প্রলেপ লাগানো গেল। রাজদণ্ডের মাথায় শিবের নন্দী আছে, মন্ত্র উচ্চারণ হবে, গঙ্গাজল ছেটানো হবে। যেমনটা এক প্রাচীন চোল শৈব রাজার রাজ্যাভিষেকে করা হত। সে উৎসবে চিক-এর আড়ালে থাকতেন নারীরা, আজকেও দেশের রাষ্ট্রপতি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত নন। হ্যাঁ, সেদিন সেঙ্গল আনা হয়েছিল, এনেছিলেন দক্ষিণের এক মঠাধীশ, তা তুলেও দেওয়া হয়েছিল জওহরলাল নেহরুর কাছে, সে অনুষ্ঠান রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ছিল না, ছিল না বলেই নেহরু এই অনুষ্ঠানের কথা কোথাও লিখে যাননি। বরং সেদিন স্বাধীনতার প্রাক্কালে উনি ভাষণে কী বলেছিলেন দেখে নেওয়া যাক— We have hard work ahead. There is no resting for any one of us till we redeem our pledge in full, till we make all the people of India what destiny intended them to be. We are citizens of a great country on the verge of bold advance, and we have to live up to that high standard. All of us, to whatever religion we may belong, are equally the children of India with equal rights, privileges and obligations. We cannot encourage communalism or narrow-mindedness, for no nation can be great whose people are narrow in thought or in action. আমাদের পরিশ্রম করতে হবে, যতদিন না আমাদের প্রতিজ্ঞা পূরণ হয়, যতদিন না আমাদের দেশের মানুষকে সেই কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারছি। আমরা এক মহান দেশের নাগরিক এক বড় পরিবর্তনের মুখে, এক উচ্চতায় আমাদের যেতেই হবে। আমাদের প্রত্যেককে, যে কোনও ধর্মের মানুষকে, ভারতের সন্তান হিসেবে সমানভাবে সমান অধিকারের জন্য, সমান সুবিধের জন্য সমান দায়িত্ব নিয়েই কাজ করতে হবে। আমরা কোনও সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতার পথে চলতে পারি না কারণ কোনও মহান দেশের মানুষের চিন্তা বা কাজ এত সংকীর্ণ হতেই পারে না। সারা জীবন জওহরলাল নেহরু যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন, যে গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, যে উদার চিন্তা চেতনার কথা বলেছেন, সেসবের এক শতাংশও যাঁরা বিশ্বাস করেন না সেই মোদি–শাহ হঠাৎ এক অর্ধসত্যের পুঁটলি নিয়ে হাজির।

RELATED ARTICLES

Most Popular