মিডিয়া মিথ তৈরি করে, আর মিডিয়ার তৈরি মিথকে ধ্রুব সত্য ধরে নিয়েই সান্ধ্য কলতলার আসরে অসাধারণ সব আলোচনা হয়, চুলচেরা বিশ্লেষণ যাকে বলে। তো সেই চুল চিরে আসলে যা পাওয়া যায় তা হল বালির ভিতে দাঁড়িয়ে থাকা রাজপ্রাসাদের গল্প, আবার সেই রাজপ্রাসাদ হুউউউশ করে ভেঙে পড়লে আবার তা নিয়ে চুলচেরা বিতর্ক। মিডিয়ার এই স্টাইলটাকে আপনি এই সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ বিনোদন হিসেবে নিতেই পারেন, সত্যি ভাবলেই বিপদে পড়বেন, হিসেব মিলবে না, হিসেব মেলাতে পারবেন না। তেমন এক মিথ হল বীরভূমের কেষ্ট মোড়ল। একবার নয় বার বার বীরভূমের নির্বাচন কভার করতে গিয়ে আমার এটাই মনে হয়েছে যে হাতির দাঁতের মতোই বীরভূম জেলা তৃণমূলের এক পিলার হল ওই কেষ্ট মোড়ল। চড়াম চড়াম করে ঢাক বাজবে, রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে, গুড় বাতাসা দেব, গাঁজা কেস দিয়ে দে ইত্যাদি কোটেশন তো আছেই, কিন্তু সেসবের পাশাপাশি চন্দ্রনাথ সিনহা, বিকাশ রায়চৌধুরী, অভিজিৎ সিনহা আশিস ব্যানার্জি বা নানুরের কাজল শেখের মতো আরও অনেকের মিলিত প্রচেষ্টার ফল আজকের বীরভূমের তৃণমূল কংগ্রেস। তার মানে কেষ্ট মোড়ল ফালতু? এক্কেবারেই নয়, ৭৭ থেকে যে মানুষটা সিপিএমের বিরুদ্ধে জেলা রাজনীতিতে লড়ে গেছে, তার জনভিত্তি আছে বইকী, সংগঠনের উপরে নিয়ন্ত্রণ আছে বইকী। কিন্তু ওই যে, শেষ পর্যন্ত সব হিসেবের শেষ হিসেব একমাত্র পিলারে গিয়ে ঠেকে। একটাই পোস্ট বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট। হ্যাঁ শেষকথা, আল্টিমেট কন্ট্রোল মমতা ব্যানার্জির হাতে। হ্যাঁ, তিনি যতটা সুতো ছেড়েছেন, ছাড়বেন তা দেখে কোনও বেড়ালের নিজেকে বাঘ বলে মনে হলে সেটা তার সমস্যা। তো সেরকম এক মিথ হলেন বীরভূমের কেষ্ট মোড়ল। সেটাই বিষয় আজকে। বীরভূমে কেষ্ট বিনা তৃণমূল, হিসেবটা দেখে নিন।
২০০৯-তে বীরভূমে শতাব্দী রায় জিতেছিলেন সিপিএমের ব্রজ মুখার্জিকে হারিয়ে। ওই জেলার বোলপুর লোকসভা কেন্দ্র তখনও ছিল সিপিএমের দখলে, কিন্তু ২০১৪ থেকে সে আসন তৃণমূলের দখলে। কেন? কারণ সব্বাই জানে, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, জমি আন্দোলন, মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্ব। হ্যাঁ, সেখানে বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন নেতারা সেই লড়াইয়ের উল্লেখযোগ্য মুখ হয়েছিলেন, কিন্তু সেই সমস্ত মুখের মধ্যে অনুব্রত মণ্ডল আলাদা কেন? কারণ তিনিই সেই নেতা যিনি এমপি এমএলএ তো ছেড়েই দিন, নিজে পঞ্চায়েত বা জেলাপরিষদেও কোনওদিন দাঁড়াননি। দাঁড়াতে চাইলে আটকাচ্ছিল কে? কেউ না। কিন্তু তিনি কিং মেকার হতে চেয়েছিলেন আর সেটাই তাঁকে এক অনন্য মিথ করে তুলেছে।
আরও পড়ুন: Aajke | উত্তরবঙ্গে ঘুঁটি সাজাচ্ছে তৃণমূল
কেষ্টদার নেতৃত্বে বীরভূমের তৃণমূল। মমতা ব্যানার্জি, পরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাট আউটের পাশে একই সাইজের অনুব্রত মণ্ডল ঝুলেছে আর সেই মিথ আরও বড় হয়েছে, প্রকাণ্ড হয়েছে। আর সম্ভবত সেই কারণেই ২০২৪ এর নির্বাচনের আগে কেষ্ট মোড়লকে গ্রেফতার করে এমনকী জেলাতে, রাজ্যেও রাখা হল না, দিল্লি নিয়ে যাওয়া হল। এত শত মামলা হল যা বুঝিয়ে দিল অদূর ভবিষ্যতে তিনি ফিরছেন না। তো বীরভূমে তৃণমূল কি উঠে গেল? বীরভূমে তৃণমূলের কি খুব বড় কোনও পরিবর্তন হল? কিছুই না, একটা কোর কমিটি তৈরি করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দল যেমন চলার তেমন চলল, মমতার নির্দেশেই চলল। এবং ভোটের ফলাফল দেখুন। ২০১৯-এ বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল পেয়েছিল ৪৫.১৩ শতাংশ ভোট, ২০২৪ এ মানে কেষ্ট বিনা নির্বাচনে ৪৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল তৃণমূল। মানে ২ শতাংশ ভোট বেড়েছিল বীরভূম লোকসভাতে। আর ২০১৯-এ বোলপুর আসনে তৃণমূল পেয়েছিল ৪৭.৮৫ শতাংশ ভোট, ২০২৪-এ ৫৫.৯৮ শতাংশ ভোট। মানে প্রায় ৮ শতাংশ ভোট বৃদ্ধি। এই ফলাফল বলে দেয় কেষ্ট মণ্ডল একজন বড় নেতা, মেঠো নেতা, দলের উপর ভালো নিয়ন্ত্রণ আছে কিন্তু তিনি অপরিহার্য নন, তিনি নির্বাচনের ধারেকাছে না থাকলেও, তৃণমূল অনায়াসে কেবল জিতে নয়, ব্যবধান বাড়িয়ে সেটা বুঝিয়েছে। কাজেই কেষ্ট মোড়লের ফোন, গালাগালি আর জেলার দুই নেতা কাজল কেষ্টর দ্বন্দ্বে বীরভূমের রাজনীতি বদলে যাবে বলে যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা বাস্তব অবস্থাটা জানেন না, বোঝেনও না। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, কেষ্ট মোড়লের ফোনে গালিগালাজ, বা দলের ভেতরে কেষ্ট-কাজল দ্বন্দ্ব আগামী ২৬-এর নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে? নাকি রাজ্যের অন্য জেলার মতোই মমতা ব্যানার্জির নামেই ভোট হবে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আসলে ২০০৯ থেকে তৃণমূলের যে জয়যাত্রা তাতে জেলার নেতাদের ভূমিকা আছে, ভূমিকা আছে অভিষেক ব্যানার্জির, ক্যামাক স্ট্রিট দফতরের, ভূমিকা আছে আই প্যাকের। কিন্তু তার সবটাই ওই মমতা ব্যানার্জিকে ঘিরে, তাঁর উপরে নির্ভর করে। সেখানে অনুব্রত মণ্ডল ওরফে কেষ্ট মোড়লের এক বড় ভূমিকা ছিল বইকী, কিন্তু তা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, অপরিহার্য নয়। মমতা ব্যানার্জি খুব সুকৌশলে একমাত্র সিপিএম বিরোধিতার রাজনীতি থেকে সরে এসে নিজেকে এ রাজ্যে, দেশে বিজেপি বিরোধী হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, আর কেকের উপরে ক্রিমের মতো এক বিরাট ডাইরেক্ট বেনিফিশিয়ারি তৈরি করেই দল এবং নিজেকে এ রাজ্যে বিরোধীদের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সেখানে জেলার নেতা ১ শতাংশ ভোট এদিক ওদিক করার জায়গাতেও নেই, একজনও নয়, কেষ্ট মোড়লও নয়।