কলকাতা: মেয়ের আবদারে শুরু হয় বেহালার মুখোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো। বেহালার বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলির মধ্যে অন্যতম বেহালা ব্রাহ্মসমাজ রোডের মুখোপাধ্যায় পরিবার। এই পরিবারে দুর্গা প্রতিমা সোনার। সারা বছর কন্যাজ্ঞানে নিত্যসেবা পান মা দুর্গা।
কথিত আছে, বংশের আদিপুরুষ জগৎরাম মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে জগত্তারিণী দেবী একবার তাঁর মামাবাড়িতে দুর্গাপুজোয় নিমন্ত্রিত হন। কিন্তু মামাবাড়িতে যথাযথ আপ্যায়ন না পেয়ে অপমানিত হয়ে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়িতে এসে বাবার কাছে জগত্তারিণী বায়না ধরেন, এই মুহূর্তে বাড়িতে দুর্গাপুজো করতে হবে। সেদিন ছিল মহাষ্টমী। পরের দিন নবমী পুজো। আদুরে কন্যার আবদার মেনে নিয়ে এক রাতের মধ্যে পুজোর সব আয়োজন করেন জগতরাম। সেবার ঘটে-পটেই পুজো হয়েছিল। সালটি ছিল ১৭৭৯। পরের বছর থেকেই প্রতিমা পুজো শুরু হয় মুখোপাধ্যায় বাড়িতে।
জগতরাম মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরেও বংশধররা পুজো চালিয়ে যেতে থাকেন। জগতরামের প্রপৌত্র ছিলেন যদুনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি পেশায় ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান। একবার কর্মসূত্রে ঢাকায় গিয়ে যদুনাথ ঢাকেশ্বরীর মূর্তি দেখে মুগ্ধ হন। ঢাকা থেকেই কারিগর আনিয়ে তিনি তৈরি করান অষ্টধাতুর দশভূজা মহিষমর্দিনী। ১৮৫৮ সালে ভাদ্র সংক্রান্তির দিন প্রতিষ্ঠা হয় দশভূজার মন্দির, প্রতিষ্ঠার নামকরণ সংস্কারের সময়ে অক্ষর ওঠে ‘জ’। যদুনাথ নির্দ্বিধায় দেবীর নামকরণ করেন “জগত্তারিণী”। মা সম্বৎসর নিত্য মধ্যাহ্নে মৎস্যভোজ গ্রহণ করেন। কোনও অবস্থাতেই মায়ের ভোগ নিরামিষ হওয়া নিষিদ্ধ মুখোপাধ্যায় পরিবারে।
বাড়ির ঠাকুরদালানে সারা বছর দেবী অধিষ্ঠান করেন।মুখোপাধ্যায় বাড়ির সদস্য ইন্দ্রজিৎ মুখোপাধ্যায় জানান, অষ্টধাতুর বিগ্রহটির উচ্চতা প্রায় দুই ফুট, সাবেক গঠন মূর্তিটির। অতীতে চালচিত্র না থাকলেও পরবর্তীকালে সুদৃশ্য চালচিত্রে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পুজোর সময় বেনারসি শাড়ি ও নানা স্বর্ণালঙ্কারে দেবীকে সাজানো হয়। এই পরিবারের জীবনচক্রের মূলেই মা জগত্তারিণী। কোনও সন্তান জন্মালে মাকে দেখিয়ে আনতে হয়। নতুন বউ এলে মাকে দেখিয়ে আনতে হয়, কন্যা বিদায় হয় মাকে দেখিয়ে। আবার বংশের কেউ মারা গেলেও উঠোনে শুইয়ে মাকে দেখিয়ে মার নির্মাল্য মাথায় দিয়ে তাঁর শেষযাত্রা হয়।
আরও পড়ুন: ১৩ দিনের বোধন আজও বহাল সাবর্ণদের বাড়িতে
সারাবছরই ভোগরাগ-সহ নিত্যপুজা হয়। দুর্গাপুজোর তিনদিনই সকালে বিউলির ডালের খিচুড়ি, বিভিন্ন ভাজাভুজি, তরকারি, মাছভাজা, মাছপোড়া, চাটনি পায়েস ভোগ হয়। সপ্তমীর দুপরে ডাল, বিভিন্ন তরকারি ও একাধিক মাছের পদ, মাছপোড়া, চাটনি পায়েস ভোগ হয়। অষ্টমীর দুপুরে ভাতের বদলে হয় বাসন্তী পোলাও। নবমীর দুপুরে অম্ল, বিভিন্ন মাছ, বলিদানের মাংস, চাটনি ও পায়েস ভোগ হয়। প্রত্যেকবার খিচুড়ি বা অন্নভোগের সঙ্গে রূপোর থালায় ফলমূল, রূপোর গ্লাসে মিছরির পানা ও মায়ের প্রিয় জিনিস কয়েতবেল মাখা নিবেদন করা হয়। নবমীর দুপরে ভোগ দিয়ে মন্দির বন্ধ রাখা হয় বেশ কিছুক্ষণ। নবমীর দুপরের ভোগকে বলে ইচ্ছাভোগ।
মহালয়ার পরদিন প্রতিপদ থেকে শুরু হয় শ্রী শ্রীচণ্ডীপাঠ, পার্থিবশিব পূজা, দুর্গানামজপ ও শালগ্রামশিলাকে তুলসী দান। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বিল্বমূলে দেবীর বোধন আমন্ত্রণ অধিবাস। সপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ করিয়ে শুরু হয় মহাপূজা। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী জুড়ে চলে মহাপুজো। নবমীতে হয় ছাগশিশু, কুষ্মাণ্ড ও ইক্ষুদন্ড বলিদান, হয় কুমারিপুজো, সধবাপুজো, হোম ও তারপরে মাকে দেওয়া হয় দক্ষিণা। সন্ধিপূজা এই পরিবারে নিষিদ্ধ, কারণ সন্ধি বিশেষ কাম্যপুজো, এই পরিবারের পুজোর সংকল্প কেবল শ্রীদুর্গা। দশমীতে পরিবারের সকলে মাকে প্রদক্ষিণ করে বেড়াপুষ্পাঞ্জলি দেন। তারপর দর্পণ বিসর্জন হয় জলপূর্ণ মাটির হাঁড়িতে আর নবপত্রিকা ও ঘট বিসর্জন হয় প্রতিষ্ঠিত পুকুরে।
যেহেতু জগতরাম দুহিতার হাত ধরেই পুজোর শুরু, তাই পরিবারের মেয়ে জামাইদের বিশেষ সম্মানের সঙ্গে আপ্যায়ন করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আগের প্রতিপত্তি ও জৌলুস কিছুটা ম্লান হয়ে পড়লেও, এখনও পুজোর দিনগুলিতে পরিবারের সমস্ত সদস্য মাতৃ আরাধনায় মেতে ওঠেন। অন্য সমস্ত পরিবারে মা দুর্গা পাঁচদিনের জন্য আসেন। আর জগতরামের বংশে মা সারা বছরই থাকেন।
আরও অন্য খবর দেখুন