কলকাতা: চার উপ-নির্বাচনে জয়-জয়কার তৃণমূলের ৷ দিনহাটা-গোসাবায়ে লাখের বেশি ভোটে জয় ৷ খড়দহ তৃণমূলেরই ৷ বিজেপির দখলে থাকা শান্তিপুরও ৫০ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী ব্রজকিশোর গোস্বামী ৷
দিনহাটা, শান্তিপুর, গোসাবা এবং খড়দহ—এই বিধানসভা আসনগুলি উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ পর্যন্ত রাজ্যের চারটি ভিন্ন জেলায় । তবে, একটি সাধারণ বিষয় তাদের সবাইকে একই পংক্তিতে নিয়ে এসেছিল । সেটি হল সীমান্ত ইস্যু । কোচবিহার, নদিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং উত্তর ২৪ পরগনার জেলাগুলির যেখানে এই বিধানসভা কেন্দ্রগুলি অবস্থিত, তাদের প্রতিটির সীমানাই প্রতিবেশি বাংলাদেশের সঙ্গে ৷ আর সে দিক থেকে বিচার করলে এই চার কেন্দ্রের ফলের উপর সম্প্রতি সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের এক সিদ্ধান্ত অনেকটাই কাজ করেছে, সন্দেহ নেই ৷ কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে রাজ্যের ভিতরে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় কাজ করতে পারবে বিএসএফ ।
এই চারটির মধ্যে, কোচবিহারের দিনহাটায় এপ্রিল-মে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল বেশ কিছুটা লড়াই করেছিল ৷ সে বার বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক তৃণমূল কংগ্রেসের উদয়ন গুহকে মাত্র ৫৭ ভোটে হারাতে পেরেছিলেন । যে নিশীথ ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির টিকিটে ১৫,৫৩৯ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন । ৩৫ বছর বয়সের সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কাজ করতে চাওয়ায় ফের এখানে উপ-নির্বাচন ৷ আর ছয় মাসের মধ্যেই ছবিটা পুরোপুরো পাল্টে গেল ৷ বিজেপি যাকে প্রার্থী করেছিল সে অশোক মণ্ডলের জামানত জব্দ হয়ে গেল ৷
বেশ কিছু দিন ধরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ করে আসছেন ৷ তাঁর অন্যতম, কেন্দ্র রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে, আইনশৃঙ্খলা নষ্ট করার চেষ্টা করেছে ৷ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, হিন্দু জনসংখ্যার একটা বিপুল অংশ এই সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা ৷ যাঁরা নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি ৷ দিনহাটার পরিস্থিতি আরও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল গত কয়েক বছরে ৷
অন্যদিকে, দক্ষিণে, নদিয়ার শান্তিপুর বরাবরই মতুয়া সম্প্রদায়ের শক্ত ঘাঁটি । শান্তিপুরের বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকার এই বছরের শুরুতে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং জয়ী হয়েছিলেন । তিনিও নিশীথের মতো, উপ-নির্বাচনের অনুরোধ জানিয়ে সাংসদ পদটি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন ৷ ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল ৷ এই বছর বিধানসভা নির্বাচনে তা ৪৯ শতাংশে নেমে আসে ৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিরোধী ভোট বাম এবং তৃণমূলের মধ্যে ভাগ হওয়ার কারণেই কিছুটা সুবিধা পেয়েছিল বিজেপি ৷ কিন্তু, আজ শান্তিপুরের ব্রজকিশোর গোস্বামীর বিপুল ভোটে জয় লাভ বুঝিয়ে দিল মতুয়া ভোট আর বিজেপির দিকে নেই ৷ পাশাপাশি, সিএএ এবং এনআরসি যে গেরুয়া ভোট ব্যাঙ্কে ফাটল ধরিয়েছে, তাও আজকের ফলে প্রমাণিত হয়ে গেল ।
একটু দূরে দক্ষিণে সুন্দরবনের গোসাবা ৷ যেখানে তিন বারের তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক জয়ন্ত নস্করের আকস্মিক মৃত্যুর কারণে উপ-নির্বাচন হল । এই জেলা বাংলাদেশের সঙ্গে একটি নদী সীমানা দ্বারা যুক্ত ৷ গোসাবা এমন একটি আসন যেখানে তৃণমূলের ভোট ম্যানেজাররা চমক ধরানোর আশা রেখেছিলেন প্রথম থেকেই । জেলার ৩১ টি বিধানসভা আসনের মধ্যে, এপ্রিল-মে-র নির্বাচনে ৩০টিতে জিতেছিল তৃণমূল ৷ একটি আসন ভাঙড় পেয়েছিল নবগঠিত ভারতীয় সেকুলার ফ্রন্ট ৷ ২৩ হাজারের বেশি ভোটে গত বার জিতেছিলেন জয়ন্ত নস্কর, আর আজ সেই ব্যবধান এক লাখের বেশি নিয়ে নিয়ে গেলেন সুব্রত মণ্ডল ৷
অবশেষে, উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহ ৷ রাজ্যের বৃহত্তম জেলা ৷ বাংলাদেশের সঙ্গে সব চেয়ে বেশি লাগোয়া ৷ ২০১১ সালের রেকর্ড অনুসারে ৭৩.৪৬ শতাংশ হিন্দু জনগণ রয়েছেন এখানে ৷ প্রথম থেকেই আসনটা ছিল তৃণমূলের অনুকূলে ৷ আর ৯৩ হাজারের বেশি ভোটে জিতে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন খড়দহ তৃণমূলেরই ৷
চার কেন্দ্রেই বিপুল ভোটে জিতল তৃণমূল ৷ শান্তিপুর বাদে তিন কেন্দ্রে বিজেপির জামানত জব্দ হল ৷ বিরোধী মুখ বলতে বাংলায় আর কিছুই কার্যত থাকল না ৷ দিনহাটা এবং শান্তিপুর আগের বার নিজেদের দখলে রাখলেও এবার তাও হাতছাড়া হয়ে গেল ৷ কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি, পেট্রোপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা, লকডাউনের জেরে হাজার হাজার মানুষের কর্মহীন হওয়া–এ সবের প্রভাব নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছিল সন্দেহ নেই ৷ উপরন্তু, উপ-নির্বাচনে ফল সাধারণ ভাবে সরকারের পক্ষেই থাকে ৷ কিন্তু, তার পরও এই বিপুল সাফল্যের পিছনে কোনও যাদু-রহস্য কি রয়েছে ?
উত্তর মিলতে হয়তে আরও বেশ কিছু দিন সময় লাগবে ৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মতো করে পর্যালোচনা করবে ৷ কিন্তু, অতি সম্প্রতি বিএসএফ প্রসঙ্গে যে নির্দেশিকা কেন্দ্রীয় সরকার দিয়েছে, তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব এই নির্বাচনে দেখা গেল না তো ?
সীমান্তের কাঁটা তারেই বিদ্ধ হতে হল না নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের নেতৃত্বাধীন বিজেপি ?