জয়জ্যোতি ঘোষ
২০০২ সালের জুন মাস। ওভালে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ভারত-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এই লো-স্কোরিং ম্যাচ ভারত জিতলেও ক্ষণিকের জন্য উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভারতীয় ড্রেসিংরুম। ম্যাচের আগে ভারতীয় ওপেনার বীরেন্দ্র শেহবাগকে কোচ জন রাইট বলেন, ‘টার্গেট বড় নয়। ঝুঁকিপূর্ণ শট না খেলে ম্যাচ জিতিয়ে ফিরে এসো।’ কিন্তু শেহবাগ তো শেহবাগই। কে শোনে কার কথা? নিজের স্বাভাবিক খেলা থেকে পিছিয়ে যাওয়ার পাত্র নন এই জাঠ ক্রিকেটার। ২০৩ রান চেজ করতে নেমে র্যাশ শট খেলে আউট হয়ে যান নজফগড়ের নবাব। সেইসময় তাঁর ব্যক্তিগত রান ১২। দলীয় স্কোর ২৬/২।
শেহবাগ ড্রেসিংরুমে ঢুকতেই চেয়ার থেকে উঠে পড়েন ভারতীয় কোচ জন রাইট। ড্রেসিংরুমে শেহবাগের কলার ধরে তাঁকে রীতিমত ধাক্কা দেন জন রাইট। একইসঙ্গে শেহয়াগকে জন রাইট বলেন, ‘এরকম শট খেলে ভারতীয় দলে থাকবে মনে করেছো? এভাবে খেললে ভারতীয় দলে আর থাকতে হবে না। তোমার এই শটের জন্য ভারত ম্যাচ হারতেও পারতো।’
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ভারত সেই ম্যাচ জেতার পর ভারত অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে একান্তে ডাকেন অনিল কুম্বলে এবং ‘শেহবাগ-জন’ পুরো এপিসোড তাঁকে ওয়াকিবহাল করান। সৌরভ শুনে একেবারে বিস্মিত হয়ে যান। এরপর টিম বাসে জন রাইটের কাছে সৌরভ এই প্রসঙ্গ তোলেন। জন রাইটও বিষয়টি হাল্কা করে দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এবারে সৌরভ চেপে ধরেন জনকে- ‘আপনি কি শেহবাগকে ধাক্কা মেরেছেন?’ জন রাইট এবারে স্বীকার করে নেন। এরপর সেইসময়ের ভারত অধিনায়ক বলেন, ‘শেহবাগ কি পাল্টা ধাক্কা দিয়েছে আপনাকে?’ জন রাইট অস্বীকার করেন। সৌরভ জন রাইটকে বলেন, ‘ভাগ্য ভালো আপনি শেহবাগের থেকে পাল্টা খেয়ে যাননি।’
টিম বাস থেকে এক এক করে নেমে হোটেলের দিকে যাচ্ছেন। বাস থেকে নামার শেষ ব্যক্তির নাম বীরেন্দ্র শেহবাগ। সৌরভ তাঁর পাশের সিটে ডেকে নিলেন শেহবাগকে। জন রাইটের সঙ্গে কী হয়েছে জানতে চাইলে শেহবাগ বলেন, ‘তেমন কিছু নয় দাদি। খারাপ শট খেলে আউট হওয়াতে জন রাগ করেছে।’ এরপর টিম হোটেলে গিয়ে সোজা শচীনের রুমে ঢোকেন সৌরভ। ‘শেহবাগ-জন’ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত কিনা শচীন জানতে চাইলে মাস্টার-ব্লাস্টার বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি সব জানি। ড্রেসিংরুমে আমার সামনেই সব হয়েছে।’
সৌরভকে কিছু না বললেও জন রাইটের ব্যবহার একেবারেই ভালো লাগেনি নজফগড়ের নবাবের। তিনি সোজা চলে যান ভারতীয় দলের ম্যানেজার রাজীব শুক্লার কাছে। ভারতীয় দলের ম্যানেজার রাজীব শুক্লার কাছে গিয়ে শেহবাগ নালিশ করে বলেন, ‘জন রাইট আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছেন। আমি ভারতে ফিরে যাচ্ছি।’ শেহবাগের এই কথা শুনে রীতিমতো চমকে যান রাজীব শুক্লা। তিনি গিয়ে ভারত অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে আবারও পুরো বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করান। সৌরভ নিজেও মনে করছিলেন জন রাইট যেটা করেছেন, সেটা ঠিক করেননি। তাঁকে শেহবাগের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। সূত্রের খবর, এরপর শচীন তেন্ডুলকর বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন। ভারতীয় স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে জন রাইট বলেন, ‘আমি চাইছিলাম শেহবাগ বড় রান করুক। বাজে শট খেলে যেন উইকেট দিয়ে না আসে! আমার ব্যবহারে যদি শেহবাগ খারাপ পেয়ে থাকে, তাহলে দুঃখিত।‘
ওভালে ভারত-শ্রীলঙ্কা ম্যাচের পর যে ম্যাচ ছিল তার আগে একটা টিম মিটিং ডাকা হয়। সেখানে শচীন তেন্ডুলকর সবাইকে বলেন, ‘শেহবাগ-জন রাইট প্রসঙ্গ নিয়ে আর কেউ কোনও আলোচনা যেন না করে।’
পরে কালের নিয়মে সব ঠিক হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর দুরন্ত শতরান করেন বীরেন্দ্র শেহবাগ। জন রাইট সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ওপেনার হতে চলেছেন বীরেন্দ্র শেহবাগ।’ ২০০২ সালের ৩০ জুনের ওভালের পড়ন্ত বিকেল আজ অতীত। দু’জনের মধ্যে সেই তিক্ত সম্পর্ক আজ আর নেই। দু’জনেই দু’জনের ভালো মুহূর্ত মনে রেখেছেন।
অন্য খবর দেখতে ক্লিক করুন: