২০২৪ ছিল মহারণের বছর। কারণ তার আগেই রাহুল গান্ধী রথযাত্রা করেছেন, ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্সের বৈঠক হয়েছে, প্রায় মাকড়সার জাল জমেছিল যে এনডিএ-র উপরে সেই এনডিএকে আবার ঝেড়েপুঁছে সামনে রাখলেন নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহ। সবটাই ছিল ওই ২০২৪-এর মহারণের সূচনা। ধরুন ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্স, এর সলতে কিন্তু পাকিয়েছিলেন ওমপ্রকাশ চৌতালা, সেই ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে, দেবীলালের জন্মদিনে নীতীশ কুমারকে ডেকে এক বৈঠকে বিরোধী জোটের নতুন করে সূত্রপাত। নীতীশের চোখ বিহার থেকে দিল্লির দিকে পড়েছিল। তিনি সেদিন বলেছিলেন, কংগ্রেস সমেত সমস্ত দলগুলোকে নিয়ে এক বিজেপি বিরোধী জোট গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু পরের বছর জুনে পাটনায় বসল সেই বৈঠক, তার আগে নীতীশ কুমার কলকাতায় এসেছেন, বিভিন্ন রাজ্যে গেছেন, মুখে বলেছেন বিজেপিকে হটানোই লক্ষ্য কিন্তু আসলে চোখ দিল্লির গদির দিকেই ছিল। কিন্তু মজাটা হল যখন সেই বিরোধী বৈঠক পাটনাতে হল, তখন ওই চৌতালার লোকদলকে ডাকাই হল না। কিন্তু সেই বৈঠকে কি কিছু হল? তেমন কিছু নয়, কিন্তু বিরোধী নেতারা অন্তত একসঙ্গে বসলেন। এরপরে কংগ্রেসের গা-ছাড়া ভাব কিছুদিন, রাহুল গান্ধীর যাত্রা, সেখানেও ইন্ডিয়া জোটের কথাবার্তা নেই। কিন্তু কর্নাটকের ভোটে দারুণ জয়, বিরোধীদের অক্সিজেন জোগাল, কংগ্রেস নতুন সরকারের প্রথম টাস্ক হিসেবেই জোটের বৈঠক আয়োজন করল ওই বেঙ্গালুরুতে।
পাটনার বৈঠক যতটা ম্যাড়ম্যাড়ে ছিল, বেঙ্গালুরুর বৈঠক ততটাই উজ্জ্বল। হঠাৎই আগের বিরোধী জোট ইত্যাদির ধারাবাহিক হতাশা, আগের গড্ডালিকা প্রবাহের উল্টোদিকে ঝর ঝর ঝরনার মতো নেমে আসে নতুন আশা, নিউ হোপ। যখন খবর পেয়েছিলাম বিজেপি বিরোধী এই রাজনৈতিক ঐক্যের নাম হয়েছে ইন্ডিয়া, তখন তা এক মুহূর্তে চিন্তাভাবনাগুলোকে অন্য খাতে বইয়ে দিয়েছিল। বিজেপির হাতে দুটো প্রবল তুরুপের তাস হল এক, হিন্দুত্ব, হিন্দু খতরে মে হ্যায়, হিন্দুদের এক জায়গায় আসতে হবে, সনাতনীদের ভোট এক জায়গায় জড়ো করতে পারলেই ভোটে জিতে যাওয়া যাবে, মুসলমানরা আওরঙ্গজেবের অওলাদ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি বিষাক্ত প্রচার। কিন্তু মজার কথা হল বহু বহু চেষ্টা করেও, বিজেপি এখনও সেই অর্থে হিন্দু ভোটারদের ৪০ শতাংশও নিজের দিকে আনতে পারেনি, এখনও পর্যন্ত পারেনি। ওদিকে রামমন্দির হয়ে গেছে, একটা মন্দির উদ্বোধন করে আবেগের বন্যা বইয়ে দেওয়া যাবে না। আর বিজেপি আরএসএস জানে যে মথুরা, কাশী, সম্ভল, আজমের শরিফ ইত্যাদি হতে শুরু করলে দেশজুড়ে যা শুরু হবে তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই।
দু’ নম্বর অস্ত্র হল, জঙ্গি জাতীয়তাবাদ। আমরাই দেশপ্রেমী, আমরাই দেশকে ভালোবাসি, এমন একটা ন্যারেটিভ যেখানে বার বার করে বলা হবে ওই বিরোধীরা দেশ বিরোধী, ভারত বিরোধী, ইন্ডিয়া বিরোধী। এবার এই দ্বিতীয় অস্ত্রের শান কমিয়ে দিল বিরোধীরা, ইন্ডিয়া ইন্ডিয়ার বিরোধী, এরকম আহাম্মকের মতো কথাবার্তা বলার জায়গাটা কমে গেল। বিজেপি এবার বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রচারে নামল, ইন্ডিয়া মানে নাকি ইনকম্পিট্যান্ট, ন্যফারিয়াস, ডাইনাস্টিক, ইমমরাল, অ্যালায়েন্স। উল্টোদিকে ডেরেক ও’ব্রায়েন টুইট করেছেন, চক দে ইন্ডিয়া, রাহুল লিখেছেন ইন্ডিয়া জিতবে বিজেপি হারবে। হ্যাঁ, অন্তত পারসেপশনের দিক থেকে ইন্ডিয়া এনডিএ-র থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল। এরপর নিশ্চয়ই এক ত্রিবর্ণ পতাকা, সঙ্গে সংবিধানের ছবির পাশে ইন্ডিয়া লেখা একটা লোগো বেরিয়ে আসবে, আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে এই প্রস্তুতি পর্বে দুই শিবিরই নেমেছিল, একইদিনে, একদল দিল্লিতে, অন্যদল বেঙ্গালুরুতে। সেই কবেই বেঙ্গালুরুর দিনক্ষণ জানিয়ে দিয়েছিল বিরোধীরা, থুড়ি ইন্ডিয়া, এবং অন্তত বিরোধীরা এক জায়গায় বসে পড়েছে সেটা দেখেই নি-জার্ক রিয়্যাকশন ছিল বিজেপির।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িক, এটা ভুলবেন না
মোদি জমানায় এনডিএ-র কোনও গুরুত্ব ছিল না, এনডিএ থেকে একে একে বেরিয়ে গিয়েছিল অকালি দল, শিবসেনা, জেডিইউ, শেষ পর্যন্ত ওই অপনা দল আর মহারাষ্ট্রের আটাওয়ালের মতো কয়েকজন পড়েছিল, গুরুত্ব হারিয়েছিল এনডিএ। সেই কারণেই বিজেপি রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে এনডিএ-র কোনও বৈঠক ডাকেনি, গুজরাট জয়ের পরে এনডিএ-র মুখ্যমন্ত্রীদের এক ডিনারে ডাকা হয়েছিল, সেটা এনডিএ-র বৈঠক ছিল না। আসলে এনডিএ-র প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছিল বিজেপির কাছে। অন্তত বছরখানেক আগে ভেঙেছিল শিবসেনা, সেই একনাথ শিন্ডের শিবসেনাকে নিয়ে কোনও বৈঠক করেছিল এনডিএ? করেনি। পাটনার বৈঠকের পরে হঠাৎই মোদি–শাহ বুঝতে পেরেছিলেন ইডি-সিবিআই দিয়েও কাজ হচ্ছে না, বিরোধীরা এক জায়গায় বৈঠ করকে তো দিখাও, বিরোধীরা কেবল বসেনি, সেদিনের ১৬ দলের বদলে ২৬টা দল নিয়ে বেঙ্গালুরুতে বসে পড়েছিল, এক নতুন ইন্ডিয়ার জন্মও দিয়েছিল। কাজেই এতদিনের প্রো অ্যাকটিভ বিজেপি এবার রিয়্যাকটিভ মোডে নামল।
এতদিন বিজেপি একটা কিছু করত, বাকিরা সেই কিছু নিয়ে তাদের মতামত দিতেন বা ব্যবস্থা নিতেন। এবারে খেলাটা উল্টো বিরোধীরা বৈঠকে বসছেন, বিজেপি এনডিএ-র বৈঠক ডাকছে, বিরোধীরা ইন্ডিয়া তৈরি করছেন, কাঁথির খোকাবাবু এ বাংলায় ইন্ডিয়াকে নিয়ে তামাশা করছেন। ছবিটা বদলে গিয়েছিল। বিজেপি কেবল এনডিএ-র বৈঠক ডেকেছিল তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন সব চোরেরা এক জায়গায় বসেছে, নাড্ডাজি জানিয়ে দিয়েছিলেন ওরা ২৬? মাত্র ২৬? আমরা ৩৮। একেই বলে নি-জার্ক রিয়্যাকশন। কারা ছিলেন এই ৩৮টা দলে? সে এক দিন ছিল যখন বিজেপির ছিল ৩০৩, শরিকদের ৫৫, সব মিলিয়ে এনডিএ-র ছিল ৩৫৮ জন সাংসদ। আর সেদিন? বিজেপির ৩০১ জন, আর শরিকদের ২৮ জন, সেটাও শিবসেনা ভেঙে বেরিয়ে আসা ১৩ জন সাংসদ, এনসিপি ভেঙে বেরিয়ে আসা প্রফুল্ল প্যাটেলকে নিয়ে। অন্যদিকে ইন্ডিয়ার কাছে আছে ১৫৭টা আসন। বিজেপির ভোট পার্সেন্টেজ ৩৭.৭৬ শতাংশ আর যারা বিজেপির সঙ্গে ছিল, তাদের মিলিত ভোট পার্সেন্টেজ ৭ শতাংশ। মানে সেই সময়ে এনডিএ-র সম্মিলিত ভোট হল ৪৪.৭৬ শতাংশ। মানে বিজেপি বুঝেছিল বিপদ আসছে। তাই তারা এনসিপিকেও ভাঙল, বাংলার দিকে নজর দিয়েছিল। ইন্ডিয়া জোট তখন এই বাংলা কেরালার ফল্ট লাইন ছাড়া এমনকী পঞ্জাব, দিল্লিতেও হম সাথ সাথ হ্যায়। এবারে মহারাষ্ট্র বৈঠক, কিছুই হল না, কংগ্রেসের ভুল চালে ইন্ডিয়া জোটের যাবতীয় আশা হতাশা হয়ে উঠতে শুরু করল। নীতীশ কুমার বুঝলেন দিল্লি তো দূর অস্ত, পাটনাও থাকবে না, উনি ইউ টার্ন নিলেন, সিপিএম ইন্ডিয়া জোটের কমিটিতে নামই দিল না। ইন ফ্যাক্ট কোনও কমিটি তৈরিই হল না।
এর সম্পূর্ণ দায় কিন্তু কংগ্রেসের, তাদের জমিদারসুলভ আচরণ এই জোট গড়ে উঠতে দিল না। এসে গেল ২০২৪। দিল্লির বৈঠকে জানানো হল একসঙ্গে র্যালি হবে, জনসভা হবে, প্রচার হবে। কিছুই হল না। মানে যখন ২০২৪-এর সেই মহারণ হাজির হল আমাদের সামনে তখন ইন্ডিয়া জোট কোথাও নেই, এনডিএ আছে। কিন্তু তাদের একটা ভুল মানুষ মেনে নিল না, ওই যে অবকি বার চারশো পার। আর চারশো পার হলেই সংবিধান বদল দেগা। মানুষ মেনে নেয়নি। ইন্ডিয়া জোটের সব দলই নিজেদের মতো করে লড়ল। মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা, শরদ পওয়ারের এনসিপি চমকে দিল, ইউপিতে অখিলেশ যাদব কাঁপিয়ে দিল, বাংলায় মমতা ৮টা আসন বাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলেন এ মাটি আর মানুষের সমর্থন তাঁর দিকেই আছে। তামিলনাড়ুতে স্তালিন ধরে রাখলেন তাঁর জয়। বিজেপি ২৪০-এ থমকে গেল। ইন্ডিয়া জোটের কৃতিত্ব নয়, মানুষ আটকে দিল বিজেপিকে। কংগ্রেস অনেক দিন পরে তিন সংখ্যায় পা দিল, ৯৯-১০০তে। এবারে ইন্ডিয়া জোটের হুঁশ ফিরবে, আমরা ভেবেছিলাম, সাধারণ মানুষ ভেবেছিল। কিন্তু রাহুল গান্ধী তো রাহুল গান্ধী, কাজেই ওনারা ওই সংসদেই ইন্ডিয়া জোটকে সীমাবদ্ধ রাখার পরিকল্পনা নিয়েই চলছেন, চললেন গোটা ২০২৪।
কিন্তু ঠিক যেমন ২০২৩ ছিল বিরোধী জোটের উত্থানের সময়, ২০২৪ জুড়ে আমরা দেখলাম সেই জোটের ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়া। ধড় নেই মুড়ো নেই, কনভেনর নেই, চেয়ারম্যান নেই, সভাপতি নেই, এক অবয়বহীন জোট হয়ে কেবল নামটা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্স। ওদিকে আবার মহারাষ্ট্র হরিয়ানা জিতে বিজেপি, এনডিএ নিজেদের ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তায় নিয়ে গেছে, তারা দিল্লিতে এবারে জান দিয়ে লড়বে, এরপরে বিহার আছে। তাদের পাশে তেলুগু দেশম আছে, চন্দ্রবাবু নাইডু আছেন। কাজেই ২০২৫ কিন্তু একেবারে সোজাসাপ্টা হবে তা নয়, ২০২৪-এর গর্ভে লুকিয়ে থাকা রাজনৈতিক সম্ভাবনাগুলো দেখে নেওয়া যাক। ১) আবার নীতীশ কুমার পাল্টি খেতেই পারেন। ২) ইন্ডিয়া জোটের মাথায় মমতা আসতে পারেন। আম্বেদকর বা দলিত প্রশ্নে চন্দ্রবাবু নাইডু ইউ টার্ন নিতেই পারেন। বিজু জনতা দল, বা কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের বিআরএস, অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআর কংগ্রেসের জগন রেড্ডি কোনদিকে যাবেন সেটাও অনিশ্চিত, তাঁদের জায়গা হতেই পারে ইন্ডিয়া জোট। ৩) বিরোধী জোট চুরমার হয়ে গেলে বিজেপি অনায়াসে জিতবে বিহার, বাংলাতে আবার সর্বশক্তি নিয়ে নামবে বিজেপি। ৪) বামেরা তাদের শেষ দুর্গ কেরালা ধরে রাখার জন্য হাতে পাচ্ছে এই বছরটা। সর্বভারতীয় নেতৃত্বে যাবেন কি কমরেড মহম্মদ সেলিম? হতে পারে। ৫) বিহারের নির্বাচনে পিকে, প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজ পার্টি নামবে, খুব বিরাট কিছু না হলেও, নীতীশ কুমারের ক্ষতি করবে, এটা নিশ্চিত। ৬) প্রিয়াঙ্কা গান্ধী কংগ্রেস দলের সভাপতি হতে পারেন, কারণ খাড়্গে সাহেবের টার্ম শেষ। কর্নাটক কংগ্রেসের ভিতরের হাল কিন্তু ভালো নয়, কাজেই এই ২০২৫-এ বিরাট চমক কিন্তু কর্নাটক থেকেও আসতেই পারে। ৭) এ রাজ্যে মানে বাংলায় শুভেন্দু অধিকারী, অধীর চৌধুরী দলে মূল্যহীন, গুরুত্বহীন হয়ে পড়বেন। সিপিএম তার শূন্যতা থেকে বের হওয়ার পথ অন্তত এই ২০২৫-এ পাবে না।