Friday, June 13, 2025
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar | মহিলা রিজার্ভেশন বিল এবং মোদিজির রাজনীতি

Fourth Pillar | মহিলা রিজার্ভেশন বিল এবং মোদিজির রাজনীতি

সেই ঝামেলার মধ্যেই পড়ে থাকবে এই নারী সংরক্ষণ বিল

Follow Us :

বিশেষ অধিবেশন কেন ডাকা হল? এ নিয়ে বিস্তর অঙ্ক কষা হয়েছে, পলিটিক্যাল পণ্ডিতদের বিস্তর আলোচনা আমরা শুনেছি। কী কী হতে পারে সেই তালিকায়, এক দেশ এক নির্বাচন, ভারত বনাম ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে কতকিছুই না এসেছে। এবং শেষমেশ কয়েকটা বিল আনার কথা চলছিল, একটা বিল এসেই গেল, লোকসভাতে তা আনুষ্ঠানিকভাবে পেশও করা হল। মহিলা রিজার্ভেশন বিল ২০২৩ আনা হল, প্রধানমন্ত্রী বললেন এ এক ইতিহাস তৈরি হল। সত্যিই এক ইতিহাসই বটে, স্বাধীন ভারতে এতদিন ধরে এক বিল কখনও ঝুলে থাকেনি, এতগুলো আলাদা আলাদা সরকার একই বিল এতবার পেশ করেননি, এবং একই বিল নিয়ে বিভিন্ন দলের এতরকম পাল্টি খাওয়া আমরা এতবার দেখিনি। সেই কবে রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পঞ্চায়েত, লোকাল বডি ইলেকশনে মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ রিজার্ভেশনের বিল আনার কথা বলেছিলেন, তার আগেই সরকার পড়ে যায়। নরসিমহা রাওয়ের সরকার এলে সেই বিল পাশ হয়। এখন দেশ জুড়েই মিউনিসিপালিটি, পঞ্চায়েত ভোটে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ রিজার্ভশন আছে। মহিলারা স্থানীয় রাজনীতিতে ধীরে ধীরে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন, তা বাড়ছে। কারও বউ, কারও কন্যা, কারও বোনের পরিচয়ের বাইরেও মহিলারা রাজনৈতিক পরিসরে আসছেন, কাজ করছেন, গুরুত্ব পাচ্ছেন, বা বলা ভালো গুরুত্ব আদায় করে নিচ্ছেন। এসবের মধ্যেই দেবেগৌড়ার ছোট্ট টেনিওরে তাঁর আইনমন্ত্রী রমাকান্ত ডি খালাপ প্রায় অবাক করে দিয়েই ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬-এ সংসদে এই বিল আনেন, বিলটাকে প্রবল বিরোধিতার পরে তখনকার সিপিআই সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ৩১ জনের এক কমিটির কাছে পাঠানো হয়। কমিটিতে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমিত্রা মহাজন, মীরা কুমার, সুষমা স্বরাজ, উমা ভারতী, গিরিজা ব্যাস, রামগোপাল যাদব, নীতীশ কুমার, শরদ পাওয়ার প্রমুখ নেতারা।

এই কমিটির কেউই এই বিলের বিরোধিতা করেননি, তাঁরা বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। প্রথম কথাটাই ছিল ওই মিনিমাম লেস দ্যান ওয়ান থার্ড-এর বদলে পরিষ্কার ওয়ান থার্ড রিজার্ভেশনের কথা বলা হোক। বিলে লোকসভা, বিধানসভায় রিজার্ভেশনের কথা বলা হয়েছিল, কমিটির রায় ছিল এমনকী রাজ্যসভা, বিধান পরিষদেও এই রিজার্ভেশন দিতে হবে। এই কমিটিই জানিয়েছিল যে আদার ব্যাকওয়ার্ড কমিউনিটির কোটার মধ্যেই ৩৩ শতাংশ ওই আদার ব্যাকওয়ার্ড কমিউনিটির মহিলাদের জন্য রাখা হোক। লালু, নীতীশ, মুলায়মরা এটাই চাইছিলেন। সেদিন ওই কমিটিই জানিয়েছিল এই রিজার্ভেশন আগামী ১৫ বছরের জন্য করা হোক, তারপর প্রয়োজন মতো তা সংশোধন করা যাবে। এই কমিটির রিপোর্টে আরেকটা সুপারিশও এসেছিল, যে সব রাজ্যে দুটো কি তিনটে আসনের মধ্যে একটা আসন এসসি বা এসটির জন্য সংরক্ষিত আছে, সেখানে এক বছর এসসি, একবছর এসটি, পরের বছর মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ থাকুক। ১৯৯৬-এ ডিসেম্বর মাসে এই কমিটি রিপোর্ট দেয়। কিন্তু নীতীশ কুমার শরদ যাদব ইত্যাদিরা ওই আদার ব্যাকওয়ার্ড কমিউনিটির বিষয় নিয়ে আপত্তি জানাতে থাকেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, কেবল মহিলা রিজার্ভেশন বিল আনলে কিছু শিক্ষিত শহরের মহিলারাই জায়গা পাবেন। এইসবের মধ্যেই সরকার পড়ে গেল, নটে গাছটি মুড়োল। ৯৬-এর পরে আবার এই বিল এল কবে? ১৯৯৮, ৯৯, ২০০০, ২০০৩-এ বাজপেয়ী সরকারের আমলে। বহুবার তাঁরা বিল আনার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের দলের মধ্যেই প্রবল বিরোধিতা ছিল, বিরোধিতা ছিল শরিক দলের তরফে এবং সমাজবাদী দল, বিএসপির বিরোধিতার কারণেই বিল পাশ হয়নি, বিল ঠান্ডা ঘরে চলে গেছে। ১৯৯৮-এ আইনমন্ত্রী থাম্বিদুরাই বিল পেশ করার পরে সংসদের ওয়েলে নেমে আসেন আরজেডি আর এসপি সদস্যরা, একজন আরজেডি সদস্য সুরেন্দ্র প্রসাদ যাদব লোকসভা স্পিকার বালাযোগীর হাত থেকে বিল কেড়ে ছিঁড়ে ফেলে দেন, উনি পরে বলেছিলেন এটা নাকি তাঁকে বাবাসাহেব আম্বেদকরা স্বপ্নে আদেশ দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | নেহরু মন্ত্রিসভায় ছিলেন তাঁর তীব্র বিরোধীরাও

এরপরে আবার সেই বিল এসে হাজির হল ২০০৮-এ মনমোহন সিং সরকারের সময়। এবারে বিজেপি দলের মধ্যেই আদিত্য যোগী গোছের কিছু মানুষের বিরোধিতার পরেও বিজেপি, কংগ্রেস, নীতীশ কুমার ইত্যাদির সমর্থনে এই বিল পাশ হয়ে গেল। কিন্তু ঝামেলা কম হয়নি, আইনমন্ত্রী এইচ আর ভরদ্বাজের হাত থেকে আবার বিল কাড়ার জন্য তাঁর সামনে চলে যান এসপি সাংসদ আবু আজমি, কংগ্রেসের রেণুকা চৌধুরি ইত্যাদিরা মন্ত্রীর সামনে এসে দাঁড়ান। রাজ্যসভায় বিল কিন্তু আলোচনা পরে, বিতর্কের পরে পাশ হয়েছিল। মমতা পরে জানিয়েছিলেন যে বিল পাশ করানো নিয়ে কিছু বোঝাপড়ার অভাবেই তাঁরা ভোটদান থেকে বিরত থাকেন, ঘটনা হল তৃণমূলের দু’ জন রাজ্যসভা সদস্য এই বিলের ভোটদানের সময়ে রাজ্যসভা থেকে বেরিয়ে যান। রাজ্যসভাতে এই বিল পাশ হবার পরে এক বিরল মুহূর্তের ছবি সবার মনে পড়বেই। সিপিএম-এর কমরেড বৃন্দা কারাত জড়িয়ে ধরেছেন সুষমা স্বরাজকে, নাজমা হেপতুল্লার সঙ্গে হাত তুলে ছবি আমরা দেখেছি, একই ফ্রেমে কংগ্রেস, বিজেপি, বাম নেত্রীরা সেদিন উল্লসিত ছিলেন কিন্তু এই বিল লোকসভায় পাশ করানো যায়নি, পড়েছিল, এবং তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে মনমোহন সরকারের পতনের পর। এবার মোদিজি এলেন। কেউ একদিনের জন্যও এই ওম্যান রিজার্ভেশন বিল নিয়ে একটা কথাও শোনেননি, সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো সেই ২০১৪-তেই ছিল, ২০১৯-এ আবার আরও বড় সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়েই ফিরেছিল মোদি সরকার। না, বিল আনা হয়নি। এতদিন পরে হঠাৎ মোদিজির মনে হল ভগবান তাঁকে দিয়েই নারী সংরক্ষণ বিলটা পাশ করিয়ে নিতে চান, তাই বিল এসেছে। প্রায় হুবহু গীতা মুখার্জি কমিটিতে যা যা বলা হয়েছিল, সেগুলোই আছে এই বিলে, কিন্তু নতুন দুটো কথা এই বিলে আছে। প্রথম কথাটা হল, লোকসভা আসনের ডি লিমিটেশনের আগে এই সংরক্ষণ কার্যকরী হবে না, দ্বিতীয় কথাটা হল ওই ডিলিমিটেশনের জন্য জনগণনা আবশ্যিক। তার মানে বিল তো পাশ হয়েই যাবে, কিন্তু তা এখনই লাগু হবে না। কেন? কারণ আগে জনগণনা করাতে হবে, এতদিন হয়নি কেন? প্রথমে কোভিডের কারণে ২০২০-তে জনগণনা হয়নি। তারপর এই জনগণনার সঙ্গেই এনআরসি-কে জোড়ার তালে আছে বিজেপি, সেটার সুযোগ তাঁরা পাননি, আপাতত তা হবে না। নতুন সরকার এসে জনগণনা করবে, সেখানেও সমস্যা আছে, বিরোধীদের দাবি জাতিভিত্তিক জনগণনা করতে হবে। এরপরের সমস্যা হল ডিলিমিটেশন। কীসের ভিত্তিতে এই ডিলিমিটেশন হবে? সংখ্যার ভিত্তিতে? মানে যে রাজ্য, বিহার বা উত্তরপ্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশে কেরল, কর্নাটক, তামিলনাড়ু বা বাংলার চেয়ে জনসংখ্যা বেশি, সেখানে বেশি সাংসদ থাকবে? তার মানে দেশ চালাবে ইউপি, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, কাউ বেল্টের মানুষজন? দক্ষিণের মানুষ এটা মেনে নেবেন? এই বাংলার মানুষ এটা মেনে নেবেন? মানে সেখানেও প্রচুর ঝামেলা আছে।

কাজেই সেই ঝামেলার মধ্যেই পড়ে থাকবে এই নারী সংরক্ষণ বিল। কিন্তু কেন? এই ক্লজ দেওয়া হল কেন? কেন ২০২৪ থেকেই এই বিল কার্যকরী করা হবে না? অসুবিধে কোথায়? জনগণনা হবে, তখন তার ভিত্তিতে হবে, ডি লিমিটেশন হবে, তখন তার ভিত্তিতেই হবে। এখনই সব দল রাজি আছে কিন্তু এই ডিলিমিটেশন ইত্যাদির নাম করে এই সংরক্ষণ বিলকে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে কেন? কারণ বিজেপি তৈরি নয়, ভারত জুড়ে প্রায় ১৭০-১৮০ জন মহিলা প্রার্থী তাঁদের দাঁড় করাতে হবে, কোথা থেকে আসবেন তাঁরা? আর এই করতে গিয়ে তাঁদের বাহুবলীরা যদি বাদ পড়েন, তাহলে নির্বাচন সামলাবে কে? কাজেই আপাতত বিল আনা হল, নির্বাচনের আগে ধামাকা, নির্বাচনের আগে এক অপটিকস। দেখুন আমরা মহিলা সংরক্ষণ বিল আনলাম, সেটাও হল আবার ডিলিমিটেশন ইত্যাদির কথা বলে বিল কার্যকরীও হল না, মোদি স্টাইল পলিটিকস। এসব নতুন নয়, দল টেনশনে থাকলে, জেতা নিয়ে সংশয় থাকলে, বিরোধীদের বিরাট ধাক্কা দেওয়ার জন্য এটা শাসকদল বহুবার করেছে, করে থাকে। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ, ইন্দিরা গান্ধী, গুঙ্গি গুড়িয়া ইমেজ থেকে বের হতে আর দলের মধ্যেই সিন্ডিকেট পন্থীদের ঘোল খাওয়াতে ব্যাঙ্ক ন্যাশনালাইজেশন আর প্রিভি পার্স বাতিল করেছিলেন, কাজেও দিয়েছিল। ভি পি সিং বিজেপির রথযাত্রাকে সামলাতে মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট ঠান্ডাঘর থেকে বের করে এনে দেশের সামনে রেখেছিলেন, বিজেপি ধাক্কা খেয়েছিল। মোদি-শাহ, আরএসএস-বিজেপি ২০২৪ নিয়ে বেশ চাপেই আছে, তাই এই নারী সংরক্ষণ বিল এসেছে। কিন্তু এই দিয়েই কি সামলানো যাবে? নারী সংরক্ষণ বিল তো এসেছে, কিন্তু বাহুবলী ব্রিজভূষণ সিংকে কি গ্রেফতার করা গেছে? বিলকিস বানোর ধর্ষকদেরকে জেল থেকে আগাম ছেড়ে দিয়ে মিষ্টি খাওয়ানো, মালা পরানো হয়নি? হাথরসের ধর্ষকদের সমর্থনে বিজেপি কি মিছিল করেনি? মণিপুরে ধর্ষিতা নারীকে উলঙ্গ করে প্যারেড করানো কি মানুষ ভুলে যাবে? শিশুদের অপুষ্টি, গর্ভবতী মহিলাদের অপুষ্টি রেকর্ড ছুঁয়েছে, এই সত্য কি ঢাকা যাবে? উজ্জ্বলা সিলিন্ডারের নামে আবার ধাপ্পা কি নারীরা বুঝতে পারবে না? মোদিজি নিজের, সরকারের ইমেজ ঠিক করার জন্য একটা বিল এনেছেন সত্যি, কিন্তু সেই মোদিজিই তো দেশের প্রথম আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতিকে নতুন সংসদ ভবনের উদঘাটন থেকে প্রথম দিন পর্যন্ত দূরে রাখলেন, তাঁকে ডাকাও হল না। এটাই মোদিজির নারী সম্পর্কে ধারণা, আসলে এক মনুবাদী নারী সম্পর্কে তাঁর ধারণা লুকোতে চাইছেন, যে মনু সাফ জানিয়েই গেছেন নারী হল নরকের দ্বার। মোদিজি সেটাই মনে করেন, করেন বলেই নির্লজ্জভাবে বিবাহিত স্ত্রীকেও মর্যাদা দেওয়ার সাধারণ ভদ্রতা দেখাতে পারেন না, যেটা করছেন তা হল বিশুদ্ধ নৌটঙ্কি।

 

RELATED ARTICLES

Most Popular

Video thumbnail
Indian Exportation | এবার ভারত থেকে বিদ্যুৎ যাবে আরব দুনিয়ায়, কীভাবে যাবে? দেখুন স্পেশাল রিপোর্ট
02:09:51
Video thumbnail
Air India | Gujrat | ভেঙে পড়া বিমানে ছিলেন গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী! এই খবরে তীব্র চাঞ্চল্য
03:05:49
Video thumbnail
Iran-America | ইরান থেকে সরানো হচ্ছে মার্কিন নাগরিকদের, এবার কি আসন্ন আমেরিকা-ইরান যু/দ্ধ?
33:11
Video thumbnail
Donald Trump | America | ফেলো কড়ি থাকো আমেরিকায়
21:50
Video thumbnail
Ahmedabad | আহমেদাবাদে বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে কেন্দ্র
30:36
Video thumbnail
Air India | Ahmedabad | কীভাবে ভেঙে পড়ল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান? দেখুন সেই মুহূর্তের ছবি
02:21:32
Video thumbnail
Indian Exportation | বিদ্যুৎ রফতানি, বিরাট পদক্ষেপ ভারতের, কী সিদ্ধান্ত? দেখুন বড় খবর
20:45
Video thumbnail
Ahmedabad | Air India | লন্ডনগামী বিমানে কতজন যাত্রী ছিলেন? কী অবস্থা তাঁদের? দেখুন লেটেস্ট আপডেট
02:34:06
Video thumbnail
Ahmedabad | Air India | আহমেদাবাদে ভেঙে পড়ল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান, বহু হ/তাহ/তের আশঙ্কা, দেখুন ভিডিও
02:26:20
Video thumbnail
Vidhan Sabha | BJP | আজ বিধানসভায় কী অবস্থা? দেখুন এই ভিডিও
01:59:14