স্কুলের নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম না পরলে তা রাখার যৌক্তিকতা কোথায়? পোশাকের অধিকার কি পোশাক না পরার বা পোশাক খোলার অধিকার দেয়? বিতর্কিত হিজাব মামলায় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলল সুপ্রিম কোর্ট৷
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাবের অধিকারের জল গড়িয়েছে শীর্ষ আদালতের আঙ্গিনা পর্যন্ত৷ সেই মামলার শুনানিতেই দেশের শীর্ষ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চ বলেছে, হিজাব পরার ক্ষেত্রে বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের তরফেই দাবি জানানো হচ্ছে৷ অন্য সম্প্রদায়ের পড়ুয়ারা কিন্তু কখনই বলছে না যে তাঁরা ইউনিফর্ম পরবেন না। হিজাব মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হেমন্ত গুপ্তা বুধবার প্রশ্ন তুলেছেন,“একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের তরফেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব পরার বিষয়ে জোর করা হচ্ছে। অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত পড়ুয়ারা ড্রেস কোড মেনেই চলছেন।তাঁরা কিন্তু একবারও বলছেন না, আমরা এই পোশাক পরব অথবা ওই পোশাক পরব না। স্কুলের নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম যদি কেউ পরতে অস্বীকার করে, তবে তা রাখার যৌক্তিকতা কোথায়?”
গত পয়লা জানুয়ারি থেকে এই সমস্যার সূত্রপাত হয়। কর্নাটকের উদুপি-র একটি সরকারি কলেজের ৬ জন মহিলা পড়ুয়া হিজাব পরে ক্লাসে আসেন। পরে তারা অভিযোগ আনেন, তাঁদের ক্লাস করতে দেওয়া হয়নি। ওই ৬ পড়ুয়ারা প্রতিবাদ শুরু করলে রাজ্যজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টিতে রাজনীতির রং লাগে৷
জাতীয় রাজনীতির অ্যাজেন্ডা হয়ে ওঠে। কর্নাটক অতিক্রম করে এই হিজাব বিতর্ক ঢুকে পড়ে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ এবং পুদুচেরিতে।তখনই হিজাবের পক্ষে-বিপক্ষে একাধিক মামলা দায়ের হয় বিভিন্ন আদালতে। তেমনই এক মামলার রায়ে কর্নাটক হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে জানায়, ইসলামের ধর্মীয় রীতিতে হিজাব পরা মুসলিম মহিলাদের কাছে অপরিহার্য নয়৷ এমনকী তা ধর্মীয় আচরনের মৌলিক অধিকারেরও অন্তর্ভুক্ত নয়৷ স্বাভাবিকভাবেই পাল্টা আন্দোলনে নামে অন্য অংশের কিছু মানুষ৷ এই বিতর্ক গড়ে ওঠার সময়ই সংশ্লিষ্ট কলেজের প্রিন্সিপাল মন্তব্য করেছিলেন, বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের পড়ুয়ারা হিজাব পরে কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারবেন। কিন্তু ক্লাসে ঢোকার সময় তাঁদের তা খুলে আসতে হবে। এরপরই বিষয়টি নিয়ে কর্নাটক হাইকোর্ট মামলা রুজু হয়। সেই মামলায় ‘হিজাব’ কখনই অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় আচার নয় বলে রায় ঘোষনা করে কর্নাটক হাইকোর্ট৷ আর সেই রায়ের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেই মামলা গড়ায় দেশের শীর্ষ আদালতে।
অন্যদিকে শীর্ষ আদালতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরার অধিকারের পক্ষে জোরালো সওয়াল করে আইনজীবী দেবদত্ত কামাথের পাল্টা যুক্তি, “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসে কেউ পোশাক বদল করে না। এমনও দেখা যায়, অনেক পড়ুয়ারই গলায় রুদ্রাক্ষের মালা রয়েছে। অনেকের শরীরে ক্রস বা অন্য কোনও ধর্মীয় প্রতীক দেখা যায়। সেসবও তো এক ধরনের ধর্মাচরনই৷” কামাথ প্রশ্ন তোলেন, অন্যের ক্ষতি না করে কোনও পড়ুয়া হিজাব পরলে রাষ্ট্র বা সংবিধান তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে কি ? সেই পড়ুয়া হিজাব পরাকে যদি তাঁর ধর্মীয় অনুশীলনের অংশ বলে মনে করেন, তাতেই বা রাষ্ট্রের সমস্যা কোথায়? কামাথের এই সওয়ালে সরাসরি ক্ষোভ প্রকাশ করেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হেমন্ত গুপ্তা একের পর এক প্রশ্ন তোলেন৷ কামাথকে উদ্দেশ্য করে ক্ষুব্ধ বিচারপতিরা বলেন, “সওয়ালের মোড়কে আজগুবি যুক্তি দেবেন না।
এসব অর্থহীন, অসার যুক্তি৷ রুদ্রাক্ষের মালা জামার ভিতরে থাকে। কোনও পড়ুয়া জামা খুলে খালি গায়ে ক্লাশে ঢোকেনা বা দেখায়ও না সে রুদ্রাক্ষের মালা ধারন করেছে।” আরও চড়া সুরে বিচারপতি হেমন্ত গুপ্তা এবং বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া
মন্তব্য করেন, “পড়ুয়া হোক বা বয়স্ক, প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে নিজের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ধর্মীয় আচার পালন করার৷ কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সেই ধর্মীয় আচারের অজুহাত সামনে এনে স্কুলের নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম তারা কেউ পরবে না? তাহলে স্কুল ইউনিফর্ম রাখার যৌক্তিকতা কোথায়? দেশ থেকে ইউনিফর্ম পরার প্রথা তুলে দিলেই হয়৷’ দুই বিচারপতির বেঞ্চ জানায়, হিজাব পরার অধিকার নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। বিতর্ক তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম বা ড্রেস কোড অমান্য হচ্ছে কি না, তা নিয়ে।’’ একইসঙ্গে বিচারপতিরা বলেন, “এটা হয়তো ঠিক, কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠানে কেউ নিজের ধর্মীয় আচার পালনের জন্যে জোর করতেই পারেন। কারণ ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু এই বক্তব্য স্কুলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।” হিজাব মামলায় দু’তরফের সওয়াল জবাব চলার সময়ই সর্বোচ্চ আদালতের দুই বিচারপতি তাঁদের পর্যবেক্ষণে স্পষ্টভাষায় দেশের সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে হিজাব পরা আবশ্যিক কিনা তা নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছেন৷ বলেছেন, “এই ইস্যুর ব্যাখ্যা তো অন্যভাবেও হতে পারে। কারো বিচারে এটা হয়তো আবশ্যিক, আবার অন্য কোনও দৃষ্টিতে হয়তো আদৌ আবশ্যিক নয়।” হিজাব মামলার শুনানি শেষ হয়নি৷