Saturday, June 14, 2025
Homeচতুর্থ স্তম্ভচতুর্থ স্তম্ভ: লড়াই জারি আছে

চতুর্থ স্তম্ভ: লড়াই জারি আছে

Follow Us :

আমার ছোটকা, ছোটকাকা বলে তার যখন বয়স ১৫ কি ১৬, তখন একটা বই সবসময় তার ব্যাগে থাকতো, সবসময়। পুজোর সময় মামাবাড়িতে গেলেও ব্যাগে থাকতো ওই বই, গরমের ছুটিতে মা বাবার সঙ্গে সিমলা, কিন্তু ব্যাগে সেই বই আছে, ইস্পাত, হাউ দ্য স্টিল ওয়াজ টেম্পার্ড, নিকোলাইচ অস্ত্রিওভিস্কির লেখা বই, ছোটকা সে বইয়ের নায়ক পাভেল হতে চাইতো, বন্ধুরা, পরে পাড়ার সবাই, তারও পরে বাড়ির লোকজনও ছোটকাকে পাভেল বলেই ডাকা শুরু করে, আমার সেই পাভেল কাকা, ছোটকার মুখেই শুনেছি তখন সোভিয়েত প্রকাশনার বই আসতো, কুমারী মাটির ঘুম ভাঙছে, ধীরে বহে ডন, চিং চিং মাই এর বিপ্লবের গান এল আরও পরে।

ছোটকার মুখেই শোনা, সারা দেশের মানুষ গান্ধী বাবার ভক্তও ছিল, বহু মানুষ গান্ধী বিরোধীও ছিল, কিন্তু নেতাজীকে এগিয়ে রাখলেও তাঁরা মনে করতো, গান্ধী, নেহেরু, আজাদ,প্যাটেল দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনা, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবা, চে গুয়েভারা তখন চেনা শব্দ, চেনা নাম, আমাদের ছোটবেলা থেকে সে সব নামে ভাঁটা পড়তে থাকে, আমাদের ছোটবেলায় রাদুগা প্রকাশনীর বই পাওয়া যেত না, ছিল না সস্তার সোভিয়েত বই, বরং জ্ঞান হবার পরেই দেখলাম সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো, স্তালিনের দেশ জর্জিয়াতে স্তালিনের মূর্তিটা থেকে গেল বটে, লেনিনের মূর্তি ওপড়ানো হল, তো সেসব জটিল রাজনৈতিক ব্যাপার বলেই জানতাম। কিন্তু আমাদের কলেজ জীবনে লিবারাল, উদার গণতন্ত্র বেশ একটা জায়গা করে নিয়েছিল, ফেসবুকে স্ট্যাটাস, লিবারাল লেফট, লিবারাল ডেমোক্রাট। সেকুলার হওয়াটাই ছিল আধুনিকতা, আমি সেকুলার, বলত অনেকেই, গর্ব করেই বলতো। হঠাৎ সব ধারণা পালটে দিয়ে নতুন কিছু কথা শোনা যেতে লাগলো, বছর পাঁচ ছয় ধরে সে সব কথাবার্তা অনেকের মুখে, লিবারালদের ব্যঙ্গ করে বলা হল লিবেড়াল, যেন লিবারাল হওয়াটা খুব খারাপ, সেকুলারের বদলে শব্দ এল সিকুলার, ফেসবুকে চে গুয়েভারা উধাও, এসেছে বিবেকানন্দ, ট্যাগ লাইন, গর্বের সঙ্গে বল আমি হিন্দু, শোনা গেলো দেশ স্বাধীন হবার পেছনে গান্ধী, নেহেরু, আজাদের ভূমিকা নেই, বল্লভ ভাই প্যাটেলকে ঠকিয়ে নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশকে ডুবিয়েছেন, স্বাধীনতার পর থেকে দেশ পাকিস্তানের দাদাগিরির কাছে, চীনের দাদাগিরির কাছে মাথা নীচু করেছিল, দেশে উন্নয়ন তো হয়ই নি, দেশে এক পরিবারের শাসন চলেছে, নেহেরু আসলে মুসলমান, দেশটা ইতালির কাছে বেচে দেবার পরিকল্পনা হচ্ছে, মুসলমানরা জনসংখ্যায় এমন বাড়ছে যে, ২০৩০ কি ২০৪০ এর মধ্যে তাঁরাই ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াবে, নতুন তথ্যে ভরে গেল হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক, স্যোশাল মিডিয়া।

কেবল মন্তব্য নয়, বড় বড় লেখা, জ্ঞান গর্ভ প্রবন্ধ আসতে শুরু করলো, বাম হয়ে গেলো ভাম। লিবারাল হল লিবেড়াল, সেকুলার হল সিকুলার। মুসলমান হয়ে দাঁড়ালো টেররিস্ট, মাদ্রাসাতে টেররিস্ট তৈরি হচ্ছে, মাদ্রাসায় জেহাদী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, আমরা শুনলাম। মাই নেম ইজ খান, অ্যান্ড আই অ্যাম নট এ টেররিস্ট, সিনেমা হবার পর শাহরুখ খানকেই ট্রোল করা শুরু হয়ে গেলো, অযোধ্যা রামমন্দিরের ভূমিপুজো হল, দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস, কারা বলছেন এসব? কিছুদিন আগে যাদের গলায় বামপন্থার কথা শোনা গেছে, কিছুদিন আগে যে অভিনেতা হাসুলি বাঁকের উপকথা নিয়ে মঞ্চে নেমেছিলেন, যিনি বিশ্ব যুব সম্মেলনে গান গাইতে গিয়েছিলেন, যিনি তরুণ মজুমদারের তৈরি করা নির্বাচনী প্রচার সিনেমায় নায়িকা ছিলেন, তাঁদের গলায় শোনা গেলো এসব কথা, আগুনখেকো এক বিপ্লবী কাম শিল্পপতি, যিনি ক’বছর আগে বাম সরকারের সাধের ন্যানো কারখানা বন্ধ করার জন্য, মমতাকে দক্ষিণপন্থী বলে ১২০০ শব্দ খরচ করলেন, তিনি ভিক্টোরিয়ায় গিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সেলফি তুলে আপ্লুত হলেন, ফেসবুকে পোস্ট করলেন। আমাদের আশেপাশে ঘটে গেলো এক প্যারাডাইম শিফট, আমূল পরিবর্তন।

সারা দেশ জুড়ে দেখলাম, আমাদের বাংলাতেও। কেউ কখনও ভেবেছিল? এই বাংলায় ভোট চাওয়া হবে প্রকাশ্যে ধর্মের নামে? প্রার্থী ঠিক করা হবে জাতের হিসেব করে? ভেবেছিল কেউ, বাংলায় ভোটের প্রচারে ইস্যু হবে লাভ জেহাদ? মমতা দুর্গাপুজোতে বাধা দেয়, এটা ইস্যু হবে, প্রচার হবে কেউ ভেবেছিল? আমরা ভাবিনি, কিন্তু ঘটনা ঘটেছে, এরকম তীব্র সাম্প্রদায়িক নির্বাচনী প্রচার গোবলয় দেখেছে, বাংলাতেও তা হল। তীব্র বিষ। তার বিরুদ্ধে লড়েছেন বামপন্থীরা, বাজে, পচা ভুল অস্ত্র নিয়ে, তাঁদের আব্বাস প্রেম ব্যুমেরাং হয়েছে, তৃণমূল লড়েছে, লড়েছে অন্যান্য বাম সংগঠন, বামপন্থী মানুষ লড়েছেন তাঁদের মত করে। কিছুটা বিজেপির ভুলে, অনেকটা তৃণমূলের নির্বাচনী প্রচারে উন্নয়ন, তাঁদের তৈরি করা বিরাট ডাইরেক্ট বেনিফিসিয়ারি তৈরি হবার কারণে, বিজেপির বিরুদ্ধে প্রায় সব ভোট তৃণমূলের দিকে যাবার কারণে তৃণমূল জিতেছে, কিন্তু ফলাফল? ২ কোটি ৮৭ লক্ষ ভোট তৃণমূলের, বেশ। কিন্তু বিজেপির? ২ কোটি ২৮ লক্ষ। মানে? ৫৯/৬০ লক্ষ ভোটের তফাতে তৃণমূল এই জয় পেয়েছে, মানে ২ কোটি ২৮ লক্ষ ভোটার ওই সাম্প্রদায়িক প্রচারে সায় দিয়েছে, তারা মনে করে মুসলমানরা বিপদ, দেশবিরোধী। তারা হিন্দুরাষ্ট্রের অদ্ভুত পরিকল্পনায় সায় দিয়েছে, তারা শুভেন্দু অধিকারী বা দিলীপ ঘোষ যে বিষ উগরিয়েছেন তা ধারণ করেছেন, তাঁরা মনে করেন নরেন্দ্র মোদিই হলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি দেশের উন্নয়নের কথা বলছেন, আগের সবাই ছিল নেহাতই চোর চোট্টা, তারা মনে করে দেশের থেকে মুসলমানদের তাড়াতে হবে, তারা মনে করে জওহরলাল একজন মুসলমান, গান্ধী একজন মুসলমান প্রেমী, তারা মনে করে অপরাধী দেখলেই গুলি করে মারা উচিত, ওসব আইন টাইন দিয়ে কিছু হবে না, মনে করেন মানবাধিকার, সেকুলারিজম এসব বাজে কথা। তারা মনে করে নরেন্দ্র মোদির জন্যই, পাকিস্তান এখনও ভারত আক্রমণ করার সাহস পাচ্ছে না, তারা মনে করে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব ইত্যাদি অর্থনৈতিক ইস্যুর থেকে অনেক বেশি জরুরি এক হিন্দু রাষ্ট্র, হ্যাঁ ওই ২ কোটি ২৮ লক্ষ মানুষের সিংহভাগ কিন্তু এটাই মনে করে, এবং সেটাই এক বিরাট সমস্যা। বা বলা ভাল সেটাই আমাদের রাজ্যে, গণতান্ত্রিক, উদার, অসাম্প্রদায়িক মানুষের সামনে সবথেকে বড় সমস্যা। কারণ এ এক অদ্ভুত প্রচার যা শুরু হল ২০১৪/১৫/১৬ নাগাদ, হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল সারা রাজ্যে, আগেই ছড়িয়েছে গোটা গো-বলয়ে।

বিজেপি হেরেছে, রাজ্য সরকার কাজ করছেন, বহু প্রকল্প হবে, ত্রুটি বিচ্যুতি থাকবে, কিছু দুর্নীতি থাকবে, কোথাও মানুষ খুশি হবেন, কোথাও অখুশি, এসব চলতেই থাকবে। কিন্তু সরকারের কাজ দিয়ে ওই সব মানুষকে ফেরানো যাবে না, যে মানুষেরা আরএসএস – বিজেপির এই প্রচারে সায় দিয়েছেন, যে মানুষেরা সত্যি করেই বিশ্বাস করেন দেশের সব সমস্যার জন্য মুসলমানরা দায়ী, তাদের ফেরানো যাবে না, তাকিয়ে দেখুন না এক বিরাট মতুয়া জনগোষ্ঠীর দিকে, তাঁরা দেশের নাগরিক, তাঁরা নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন, এবারেও দিয়েছেন, যে অধিকার কেবলমাত্র নাগরিকদেরই আছে, কিন্তু তাঁরা মনে করেন বিজেপি সরকার, ইউনিয়ন সরকার, ভারত সরকার, নরেন্দ্র মোদি – অমিত শাহ তাঁদের নাগরিকত্ব দেবে, হ্যাঁ এটাই ওই অঞ্চলে বিজেপির প্রচার ছিল, সেই মানুষেরা কেবল রাজ্য সরকারের কাজ দেখে ফিরবে না। তাহলে? আমাদের কাজ, এটা আমাদেরই কাজ, এই বিষ নির্মূল করা, যে মানুষেরা বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে বলেছিলেন, তাঁদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, যে বামপন্থীরা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, যে গণতান্ত্রিক, উদার, অসাম্প্রদায়িক মানুষজন বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, তাঁদের দায়িত্ব, যে বামপন্থীরা শূন্য পেয়েছেন, তাঁদের দায়িত্ব, যে বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, কবি, সাহিত্যিক সমাজে এগিয়ে থাকা মানুষজন নির্বাচনের সময় বিজেপির বিরোধিতা করেছিলেন, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে, তাঁদের প্রত্যেকের দায়িত্ব, শাসক দল তৃণমূলের তো বটেই। প্রত্যেকটা মানুষকে বলতে হবে রবীন্দ্রনাথের কথা, নজরুলের কথা, বলতে হবে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির কথা, কবির, নানক, চৈতন্যের কথা, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রামমোহন, রবিঠাকুরের কথা। এ বিষ নির্মূল না করতে পারলে এরপর এ বিষ মাথায় চড়বে, ফ্যাসিস্টদের কেবল নির্বাচনে হারানোটাই যথেষ্ট নয়, ফ্যাসিবাদ একটা দর্শন, তার বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াইটাও খুব জরুরি, আমরা বাংলার মানুষ তো জানিই, বর্গীরা বহুবার পিছিয়েছে, আবার এসেছে নতুন শক্তি সঞ্চয় করে, আবার লড়েছে বাংলার মানুষ, এবারের নির্বাচনে ফ্যাসিস্ট বর্গীরা কেবল পিছু হটেছে, ওদের নির্মূল করার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের।

RELATED ARTICLES

Most Popular

Video thumbnail
Ahmedabad | বিমান ভাঙার পর কী হয়েছিল ডাক্তারি হস্টেলে? অভিজ্ঞতার কথা জানালেন গুজরাতের ডাক্তারি পড়ুয়া
01:45:55
Video thumbnail
Narendra Modi | আহমেদাবাদে বিমান দুর্ঘ/টনা, দুর্ঘ/টনাস্থলে নরেন্দ্র মোদি, কী জানালেন? দেখুন Live
02:45:32
Video thumbnail
Narendra Modi | একমাত্র জীবিত যাত্রীর সঙ্গে কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী, কী জানালেন তিনি?
01:44:06
Video thumbnail
Narendra Modi | আহমেদাবাদের পরিদর্শনের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট নরেন্দ্র মোদির, কী লিখলেন তিনি?
59:27
Video thumbnail
Stadium Bulletin | বিরাটের টেস্ট অবসরের কারণ কী?
01:43
Video thumbnail
Stadium Bulletin | ভারতীয় দলে বিমানে চড়তে ভয় কাদের?
00:48
Video thumbnail
Bangla Bolche | Nandita Halder | ত্রুটির কারণ কি তাড়াতাড়ি জানা যাবে?
01:27
Video thumbnail
Politics | রবিঠাকুরের ভিটে ভাঙচুর, মমতার মুখে নিন্দার সুর
03:32
Video thumbnail
Politics | চাপ দিতে নীতীশকে এবারে, আরএসএস নামল বিহারে?
02:51
Video thumbnail
Politics | ইন্ডিয়া জোট শক্ত ফের, বৈঠক হল শরিকদের
03:19