আপাতত ধরনা তুলে নিয়েছে তৃণমূল, কিন্তু সঙ্গে হুঁশিয়ারি ৩১ অক্টোবরের মধ্যে রাজ্যের বকেয়া টাকা চাই, না হলে আবার আন্দোলন। রাজ্যপাল কেরল, দার্জিলিং ইত্যাদি করে বুঝেছেন ফেঁসে গেছেন। যত ফুটেজ খাবেন তত হাওয়া গরম হবে, তত স্কোর বাড়বে অভিষেক এবং তৃণমূলের। উনি বরং ঝটপট ব্যাপারটার এক আপাত সমাধানের রাস্তায় গেলেন। দিল্লি ছুটেছেন গাইডলাইন দরকার কারণ আউট অফ সিলেবাস প্রশ্ন এসে যাচ্ছে, সামলানো যাচ্ছে না। কিন্তু এই দিনে রাতে গগলস পরা গলাবন্ধ কোটওলা রাজ্যপাল আজকের বিষয় নয়, বরং আমরা এই বকেয়া টাকা আদায়ের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের রাজ্যের তিন প্রধান দল তৃণমূল, বিজেপি আর সিপিএমকে নিয়ে খানিক আলোচনা করি। নিশ্চয়ই বলবেন কংগ্রেস কি বানের জলে ভেসে এসেছে? তাকে নিয়ে আলোচনা করবেন না কেন? করব না কারণ কংগ্রেস এ রাজ্যে হিজ মাস্টার্স ভয়েজ, হয় সিপিএম-এর কথা মেনে চলবে না হলে হাইকমান্ডের কথা। নাক ঘুরিয়ে মমতার কথা বা শর্ত মেনে চলবে, তার স্বাধীন অস্তিত্ব এখনও নেই, হলে তাকে নিয়ে আলোচনা করা যাবে। টাকা বাকি, কীসের টাকা? জিএসটির টাকা বাকি, এবং সেখানে কোনও কিন্তু যদি হবে আচ্ছা ইত্যাদি নেই। ফেডারেল সরকারের হিসেব মতো মোদি সরকারের হিসেব মেনে রাজ্যগুলোর কাছে ৮৬ হাজার ৯১২ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে। তার মধ্যে বাংলার ভাগ ২৪০৯ কোটি টাকা, এর মধ্যে ৮২৩ কোটি টাকা জুন মাসে এসেছে। তার মানে ১৫৭৬ কোটি টাকা বাকি আছে, কোনও এফআইআর নেই, কোনও হিসেব বাকি নেই, নির্মলা সীতারমনের হিসেব এই বাকির কথা জানাচ্ছে। দিচ্ছেন না কেন মোদিজি? হ্যাঁ, এই জন্যেই ধরনায় বসা। রাজ্যের মানুষ ১০০ দিনের কাজে শ্রম দিয়েছে, টাকা পাচ্ছে না, কী হয়েছে? দুর্নীতি হয়েছে? এফআইআর করেছেন? দুর্নীতির হিসেব দিয়েছেন? কীসের দুর্নীতি জানিয়েছেন? কোনও পত্রপত্রিকাতে সেই দুর্নীতির কথা ছাপা হয়েছে? কোনও মামলা চলছে? উত্তর না। সেই টাকা বাকি, তার জন্য ধরনা। এইরকমভাবে আবাস যোজনার টাকা, আরও বিভিন্ন প্রকল্পের হাজার হাজার কোটি টাকা বাকি, তার জন্য ধরনা। সেই ধরনা নিয়েই আজকের আলোচনা, বিষয় আজকে, বকেয়া টাকার আন্দোলন, তৃণমূল, বাম ও বিজেপির ভূমিকা।
রাজ্যের স্বার্থে, রাজ্যের পাওনা আদায়ের জন্য লড়াই রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল লড়বে এটা স্বাভাবিক। লড়ছেন, এর আগেও লড়াই হয়েছে, বাংলার প্রতি বঞ্চনা নতুন কিছু নয়, বিভিন্ন খাতে বাংলার লক্ষ কোটি টাকা বকেয়া থেকে যাওয়াটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন তা আরও বেশি করে গায়ে লাগছে কারণ বহু প্রকল্প হাতে নিয়েছে রাজ্য সরকার, সেই সব প্রকল্পের টাকা জোগাতে নাজেহাল হতে হচ্ছে। কাজেই এবারের আন্দোলন এক ধাপ উঠেছে, স্বর চড়েছে। দিল্লি চলো, সেখানে মন্ত্রী দেখা করলেন না, সুযোগ করে দিলেন আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তুলতে। রাজভবনের সামনে ধরনা, অবশেষে আপাতত বিরতি। কিন্তু রাজ্যজুড়ে খবর গেছে, মানুষ দেখেছেন কাগজে, টিভির পর্দায়, লড়ছে তৃণমূল, লড়ছেন অভিষেক। মানুষ বোকা নয়, খানিক বুঝেছেন নিশ্চয়ই।
তৃণমূল বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইটাকে নিয়ে যেতে পেরেছে, এরপর খানিক টাকা এলে সেটা প্রাথমিক সফলতা বলেই মানবে মানুষ। এবার চলুন এই ইস্যুতে বিজেপির অবস্থানটা দেখে নিই। এই ইস্যুতে এক্কেবারে শুরুতেই বিজেপিই আগ বাড়িয়ে কেন্দ্রের কাছে, নির্মলা সীতারমন বা মোদিজির কাছে দরবার করে কিছু টাকাও এনে দিতে পারলে হাওয়াটা অন্যদিকে ঘুরত। কিন্তু সে বোধ আর বুদ্ধি শুভেন্দুর আছে এমন কথা কাঁথির লোকেও বলে না, উলটে টাকা যেন না দেয়, তার কথাই বলেছেন। চলে গেছেন মন্ত্রীর কাছে, দেখা করেছেন সেই দিন, যেদিন তৃণমূল দলের দেখা করার কথা। মন্ত্রী ওনার সঙ্গে দেখা করেছেন, তৃণমূল নেতাদের পুলিশ দিয়ে তুলে থানায় নিয়ে গেছে। ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য মন্ত্রী বিজেপির সদর দফতরে এসে সাংবাদিক বৈঠক করলেন বটে কিন্তু এমন কোনও তথ্য দেননি যাতে বকেয়া টাকা প্রাপ্য নয়, তা প্রমাণ হয়। এক বিজেপির নেতা বলছিলেন, এই বকেয়া টাকার আন্দোলনের ফলে আমাদের বিরাট ক্ষতি হবে, যা লোকসভার ভোটের সময় বোঝা যাবে। বিজেপি রাজ্য নেতৃত্বের এক অংশ এটাই মনে করেন। এবং রাজ্যের কালিদাস পার্টি বা সিপিএম-এর কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। ওনারা প্রাণপণে বোঝাচ্ছেন তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে সেটিং আছে। তৃণমূল আর বিজেপি হল আরএসএস-এর দুটো আলাদা আলাদা শাখা, মোদি-দিদি সেটিংয়ের কথা বলেই চলেছেন। কিন্তু সেখানে সমস্যা হল মানুষ। মানুষ কোনওভাবেই তাঁদের এই কথা বুঝে উঠতে পারছেন না, আর সেই না বুঝতে পারার কথা কি সিপিএম নেতা কমরেডদের কানে যাচ্ছে না? গেছে। তাই কানাঘুসোয় শুনছি ওনারাও নাকি রাজ্যের বকেয়া নিয়ে আন্দোলন করবেন। সে আরেক কেলো হবে নিশ্চয়ই, অপেক্ষায় থাকব। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম রাজ্যের হাজার হাজার কোটি টাকা বকেয়া দিল্লির সরকারের কাছে। তৃণমূল টাকা আদায়ের লড়াই লড়ছে, বিজেপি বিরোধিতা করছে আর সিপিএম বিজেপি-তৃণমূল সেটিং এর কথা বলছে। আপনাদের কী মনে হচ্ছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আছে মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা আছে, বেকারত্ব আছে, বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার ইস্যু তাও আছে, কিন্তু এখন থেকেই তৃণমূল একটা ন্যারেটিভ সেট করে দিতে চায়। বিজেপি বাংলা বিরোধী, বাংলার মানুষের বিরোধী, তারা বাংলার মানুষকে ভাতে মারতে চায়, এবং তৃণমূল এই কাজে অনেকটা সফল। অন্যদিকে এখনও বাঙালি না হতে পারা কারিয়াকর্তার দল বিজেপির সর্বাঙ্গে গোবলয়ের ছাপ। তারা লড়বে বাংলায়, মাথায় দুই কাঠ অবাঙালি, তারা প্রচারে নামবে। এসে হাজির হবে এক ডজন অবাঙালি নেতা এবং তার উপরে এই বাংলা বিরোধী, বাঙালি বিরোধী ন্যারেটিভ। আর এই লড়াইটা এতটাই মুখোমুখি যে এর মধ্যে তৃতীয় কোনও শক্তির জায়গা নেই। কাজেই আগামী লোকসভার নির্বাচনে বিজেপি আর তৃণমূলের লড়াইয়ের মধ্যে সিপিএম হাইফেন-এর ভূমিকাও পালন করতে পারবে না। বকেয়া টাকা আদায়ের লড়াই আগামী মহাভারতের যুদ্ধের প্রথম ইস্যু হয়ে উঠতে চলেছে।