অনেকেই ভাবছেন যে খেয়েদেয়ে কাজ নেই সিপিএম-এর, তারা এমন মুক্তকচ্ছ হয়ে জোট ইত্যাদি ধর্তব্যের মধ্যে না রেখেই এ বাংলায় তৃণমূলের বিরোধিতায় নেমেছে কেন? সারাদেশে যে জোট, বিরোধী জোট, সেখানে কি তারা থাকতে চায় না, বা এইরকম করেও বলা যায়, বিজেপি বিরোধী এক মহাজোটে সিপিএম কি থাকতে চায় না? আসলে সিপিএম যা যা করছে সেটা তাদের নির্বাচনী পাটিগণিতকে মাথায় রেখেই করছে, তাদের সংগঠনের আগাম ভবিষ্যৎকে মাথায় রেখেই করছে, এবং যা করছে ঠিকই করছে কারণ এ ছাড়া তাদের অন্য কিছু করাটা সম্ভব নয়। সারা দেশে বিজেপি তাদের সংগঠন ছড়াতে পেরেছে? না পারেনি, তাদের অগ্রগতি উত্তর ভারত আর মধ্য ভারতেই সীমাবদ্ধ। উত্তর পূর্বাঞ্চলে তাদের অগ্রগতি অসম ছাড়া অন্য কোথাও সাংগঠনিক নয়, বিভিন্ন প্যাঁচ পয়জার কষে তারা বিভিন্ন দলের সঙ্গে নানাবিধ কোয়ালিশনে গিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে, সরকারে আছে, সারা দেশে পিছোলে, এখানেও ধুয়ে যাবে। তাদের মাথায় দেশ আছে? নেই। তাঁদের মাথায় হিন্দুরাষ্ট্র আছে, হিন্দুত্ব আছে, সেই লক্ষ্যে তাঁরা এগিয়ে চলেছেন। কংগ্রেসের দায় আছে, দায়িত্ব আছে, কমবেশি সারা দেশে তাঁদের সংগঠন আছে। কম হোক বেশি হোক, শক্তিশালী হোক দুর্বল হোক আছে, তাঁদের মাথায় দেশের এক ছবি আছে, ধারণায় সংবিধান, গণতন্ত্র আছে, তাঁরা তা পেতে চাইছেন। দেশের কংগ্রেস থেকে ভেঙে নানান আঞ্চলিক দল আছে, তাঁদের আঞ্চলিক চাহিদা আছে, দলগুলোর মধ্যে প্রচ্ছন্ন স্বৈরতান্ত্রিক ঝোঁক আছে, কিন্তু তাঁদের অনেকেই রুটেড, মাটির সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষ। আর দুর্নীতি কংগ্রেস, আঞ্চলিক দলে আছে, বেশ কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ আছেন, একই তালিকায় পুরনো সমাজতন্ত্রী, সমাজগণতন্ত্রীরাও আছেন। বিজেপির দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক, অনেক ডিপ রুটেড, দল হিসেবেই তারা এক দুর্নীতির সংস্কৃতিকে জন্ম দিয়েছে। যা এক ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট ব্লক তৈরি করেছে, তাদের টিকে থাকার এবং বেড়ে চলার শর্তে তারা বিজেপিকে ক্ষমতায় রেখেছে, এ এক বিচিত্র করাপশন। এভাবে আমাদের দেশের দলগুলোকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করলে দেখবেন সিপিএম এদের থেকে এক্কেবারে আলাদা। একটা সময়ে এঁদের বিপ্লব, সমাজ বদল ইত্যাদির এক ধোঁয়াটে স্বপ্ন ছিল, অ্যাট লিস্ট, সেরকম কিছু বলার চেষ্টা করতেন। আপাতত ডারউইনের তত্ত্ব মেনে কেবল টিকে থাকার চেষ্টায় মগ্ন, অন্য কিচ্ছু না কেবল টিকে থাকা তাও আবার সংসদীয় রাজনীতিতে। সারা দেশ থেকে পিছু হঠতে হঠতে আপাতত কেরল ওঁদের বিচরণভূমী, কিন্তু ক্রমাগত হারের পরেও নজর বাংলার মাটির দিকে। সেটাই বিষয় আজকে, ২০২৪-এ সিপিএম এই বাংলায় ক’টা আসন পাবে?
কংগ্রেসের লক্ষ্য দেশের শাসনে আবার ফিরে আসা, লোহিয়াইট, স্যোশালিস্ট ইত্যাদিরা চান এক সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, এক সামাজিক পুনর্গঠন যা তাঁদের ক্ষমতায় আনবে, আঞ্চলিক দলগুলোর আঞ্চলিক চাহিদার রাজনীতি নিয়েই চলতে হবে, বাংলা তার নিজের মেয়েকেই চায় গোছের স্লোগান তাদের মানায় ভালো। বিজেপি হিন্দুরাষ্ট্র চায়, হিন্দুত্ব চায়, এক দেশ, এক নেতা, এক দল চায়, এবং এখন তাঁদের এসব চাহিদার কথা তাঁরা লুকোন না। সিপিএম কী চায়? কেরলে টিকে থাকতে আর বাংলায় যদি এক আধটা আসন পাওয়া যায় তার জন্য লড়ে যেতে চায়। ত্রিপুরাতে আসন মিলবে না, তা তাঁরা বুঝে গেছেন।
আরও পড়ুন: Aajke | শিল্প, সৌরভ, মাদ্রিদ, বার্সেলোনা
কেরলে তাঁদের লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গে, ওই কে সি ভেনুগোপাল, যিনি ইন্ডিয়া জোটের কো অর্ডিনেশন কমিটিতে বসে আলোচনা করবেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলবেন, জোট কী সিদ্ধান্ত নিল, সেই ভেনুগোপালের পাশে ইয়েচুরি বসলে কেরলের কমরেডরা রেগে যাবেন। আবার সেই বৈঠকে অভিষেক আছেন, ইয়েচুরির পাশে উনি বসলে বাংলার কমরেডরা রেগে যাবেন। তার থেকে কমিটিই যদি না থাকে? না রহেগি বাঁশ, না বাজেগি বাঁশুরি। সিপিএম সেটাই চায়। কেন? কারণ এই বাংলায় তার ক্যাডারকুলকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করার অবিরাম মন্ত্র দিতে হবে, শয়নে স্বপনে তৃণমূল বিরোধিতাই যাঁদের টিকে থাকার মন্ত্র, তাঁরা কোন প্রয়োজনে জোটের কথা বলবেন? যদি বাংলায় জোট হয়, তাহলে কী হবে? মমতা কংগ্রেসকে ৪টে আসন ছেড়ে দিলেন, কংগ্রেস দুটো আসন সিপিএমকে ছেড়ে দিল। সম্ভব? না সম্ভব নয়। কারণ সিপিএমকে তার মমতা বিরোধিতা নিয়েই টিকে থাকতে হবে, সেটা ছেড়ে দিলে তার যেটুকু আছে সেটুকুও যাবে। কাজেই আপাতত তাঁদের নজর একলা লড়ে একটা কি দুটো আসন, মানে খুব জোর হলে ২০১৪-র রায়গঞ্জ আর মুর্শিদাবাদ দখল নেওয়া। ক’টা আসনে লড়বে সিপিএম? আইএসএফকে দিয়ে দক্ষিণ আর উত্তর ২৪ পরগনা, হুগলির কিছু মুসলিম আবাদি আছে এরকম সিটে লড়ানো। কংগ্রেসকে বেশ কিছু আসন দিয়ে সিপিএম বড় জোর হলে গোটা ১৫-১৬ আসনে লড়তে চায়, লক্ষ্য ওই রায়গঞ্জ আর মুর্শিদাবাদ। কী হবে? যদি কংগ্রেস সিপিএম-আইএসএফ জোট হয় তাহলে কংগ্রেস বড়জোর একটা আসন জিতবে, সিপিএম শূন্য, আইএসএফ শূন্য। যদি তৃণমূল আর কংগ্রেস জোট হয় তাহলে কংগ্রেস নিশ্চিত ৩টে আসন পাবে। আর এই কংগ্রেস সিপিএম আইএসএফ জোটের ফলে বিজেপিও যে খুব লাভবান হবে তাও নয়, কারণ বিজেপির ভোট কমছে। এ বাংলার রাজনীতি ২০২৪ পর্যন্ত সিল হয়ে গেছে, বিরাট কোনও ঘটনা না ঘটলে, এই ফলাফল অন্যরকম হবে না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই বাংলায় সিপিএম-এর লাগাতার মমতা বিরোধী রাজনীতি আগামী দিনে ২০২৪-এ তাদের কতগুলো আসন এনে দিতে পারে? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
বাংলায় সিপিএম-এর লড়াই আসনের নয়, সংগঠন টিকিয়ে রাখার, ওঁরা নিজেরাও জানেন একটা আসনও ২০২৪-এ বের করে আনার মতো সাংগঠনিক ক্ষমতা ওঁদের নেই, সে জোট হোক বা না হোক। কিন্তু যেটুকু সংগঠন আজও টিকে আছে তাও ভেসে যাবে যদি সারাদেশের রাজনীতি মাথায় রেখে বিজেপি বিরোধী জোটে শামিল হতে হয়। সেই জন্যই তাঁদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতেই তাঁদের ওই জোটে থাকব কমিটিতে থাকব না, ছোট কমিটিতে থাকব, বড় কমিটিতে থাকব না, পশ্চিমবঙ্গে যৌথ জনসমাবেশে থাকব না কিন্তু বিজেপি বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করব গোছের অনর্গল বাওয়াল দিয়ে যেতে হবে, দিয়ে যাবেন, কেবল সাইন বোর্ডটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য।