বেহালার ছেলে সুদূর মাদ্রিদে বসে মেদিনীপুরে আয়রন ফ্যাক্টরি করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। দাদা চিন্তাভাবনা না করে কিছু করেন বলে জানা নেই, দাদা যা করেন নিজের ভালোর জন্যেই করে থাকেন। তাঁর ঘোষণা সেই কারণেই চমকে দেবার মতো কিছু নয়, কিন্তু আলোচনা করার মতো তো বটেই। অন্য বহু দেশ ছেড়ে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যখন স্পেনে গেলেন শিল্প আনতে তখনই এসব প্রশ্ন উঠেছে, সত্যিই কি শিল্প আসবে? আসলে কী ধরনের শিল্প আসবে? এই যে শিল্প আনতে যাচ্ছেন তার আগে কি যথেষ্ট হোম টাস্ক করা হয়েছে? স্পেনের শিল্পপতিদের কারও সঙ্গে একটা প্রাথমিক যোগাযোগও কি হয়েছে যার ভিত্তিতে শিল্প আসবে এরকম একটা ধারণাও আমরা করতে পারি? এবং আরও একটা বড় কথা হল শিল্প আনতে বিদেশে যাওয়া, সেও কি এই প্রথম? রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, যাবই, আমি যাবই, ওগো বাণিজ্যেতে যাবই, লক্ষ্মীরে হারাবই যদি, অলক্ষ্মীরে পাবই, যাবই আমি যাবই। লক্ষ্মী না পেলে অলক্ষ্মীই সই, বাণিজ্যেতে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। স্বাধীনতার পরে অমন শিল্প আনতে যাওয়ার চল ছিল না। শিল্প তখন আসত, রাশিয়ান ব্লক হিসেবেই আমাদের কাছে ইস্পাত ইত্যাদি ভারি শিল্প এসেছিল। কিন্তু তারপর পৃথিবীর ভারসাম্য ভেঙে গেল। এখন আয় বাছা জমি দেব, আয় বাছা ফ্রিতে বিদ্যুৎ দেব, জল দেব ইত্যাদি বলে শিল্প আনতে হয়। তেনারা আসবেন, চাকরি হবে, তেনারা আসবেন অর্থনীতিতে জোয়ার আসবে। কাজেই সেই জ্যোতিবাবুর সময় থেকে বৎসরান্তে শিল্প ধরার অনুষ্ঠান চালু ছিল। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নামই হয়ে গিয়েছিল মউ দাদা, শয়ে শয়ে মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং সই করাতেন তিনি। কিন্তু ওই মউ খেয়ে মৌমাছিরা উধাও হতেন। বুদ্ধদেবের রাজত্বেও আলাদা কিছু নয়, বরং কমিউনিস্ট হিসেবে তিনি আরেক নতুন কয়েনেজের জন্ম দিয়েছিলেন, বেড়াল ইঁদুর মারতে পারবে কি না সেটা জরুরি, বেড়ালের রং দেখাটা জরুরি নয়। লক্ষ লক্ষ কমিউনিস্ট হত্যাকারী সুহার্তোর বন্ধু সালেম গোষ্ঠীর সঙ্গেও তিনি হাত ধরতে রাজি ছিলেন, এবং সেই শিল্প দৌত্যে আজকের কুণাল ঘোষও সঙ্গে ছিলেন। সে এক হাফ প্যান্টুল শিল্পপতি চ্যাটার্জির সঙ্গে কী দহরম মহরম। বিশাল তোরণের উপর আরও বিশাল ঘোড়া, শিল্প চুক্তি হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতা মেনেই এবারেও শিল্প ধরতে যাওয়া, তবে আলাদা হল এবার শিল্প ধরতে মাদ্রিদ, বার্সেলোনা এবং সঙ্গে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, শিল্প, সৌরভ, মাদ্রিদ, বার্সেলোনা।
স্পেনের মাদ্রিদ বা বার্সেলোনা শিল্প-শহর বলে মোটেও পরিচিত নয়। এ দুই শহরে যে শিল্প বিকশিত তা হল ট্যুরিজম। ইতিহাস প্রতিটি ছত্রে লেখা আছে মাদ্রিদে, মাত্র ক’ বছর হল স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্ত স্পেনের মাদ্রিদ তার ঐতিহাসিক প্রাসাদ, রাজপথ, বিশাল বিশাল বাড়ি আর খাবারের পশরা নিয়ে আন্তর্জাতিক ট্যুরিস্টদের কাছে এক অমোঘ আকর্ষণ। শহর কেন্দ্রে এক কবির মূর্তির সামনে জড়ো হয়ে স্থানীয় মানুষ চিৎকার করে কবিতা পড়েন, লোরকা দীর্ঘজীবী হন। রেস্তরাঁয় ভাতের পদ প্যালেলা আর ফল মেশানো পানীয় সাংগ্রিয়া, এবং ফুটবল, এই তো জীবন কালীদা। হ্যাঁ, এক্কেবারে বাঙালি জীবন বললেও ভুল হবে না। আর ট্রেনে ঘণ্টাচারেক দূরত্বে আরেক শহর বার্সেলোনা, সেও তার ফুটবল, বিশ্ববিখ্যাত চার্চ, সমুদ্রতীর আর সি-ফুড নিয়ে আরেক ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন।
আরও পড়ুন: এ রাজ্যে বিজেপির সমস্যা বেড়েই চলেছে (15.09.23)
স্পেনের শিল্প যন্ত্রপাতি, ইলেক্ট্রনিক্স, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক শিল্প, মোটরগাড়ি ইত্যাদির জন্য বিখ্যাত, এর কোনওটাই এই মাদ্রিদ বা বার্সেলোনাতে নেই, থাকলেও তা শুধুই প্রশাসনিক দফতর মাত্র। এইসব শিল্প আনতে মুখ্যমন্ত্রী সেদেশে গেছেন, মনে হয় না। দুটো মোক্ষম জিনিস নিয়েই তিনি ওদেশে গেছেন, প্রথমটা হল এই মাদ্রিদ আর বার্সেলোনা জুড়ে যে ফুটবল, তাকে আমাদের রাজ্যে আনা যায় কি না, আর দ্বিতীয়টা হল বাংলার ট্যুরিজম মানচিত্রে স্পেনকে কতটা জুড়ে নেওয়া যায়, তার একটা চেষ্টা। আপাতত যা শোনা যাচ্ছে তা হল ওই ফুটবল, হ্যাঁ, এটাই ছোঁওয়া যায় এমন প্রাপ্তির তালিকাতে এসেছে। বাকিটা হল নির্ভেজাল রাজনীতি, মহারাজ তাতে নিজেই জড়িয়েছেন। ঘোষণা মাদ্রিদে বসে, কাজেই আরও তীব্র তার অভিঘাত, এবার মহারাজার দায় সেই ঘোষণাকে সাকার করা, এরকম এক অস্ত্র খোলা ছেড়ে রেখে দিতে নেই। যখন ২০২৪-কে মাথায় রেখে সব্বাই অস্ত্র শানাচ্ছে, তখন মমতা আলতো করে বিজেপির হতে পারে এক অস্ত্রকে স্বল্প প্রচেষ্টায় ভোঁতা করে রেখে দিলেন। সৌরভ বড় লোহা শিল্প গড়ে তুললে তাঁর লাভ, না তুললে সৌরভের ক্ষতি, মমতার নয়। আর দিদির জন্য শিল্প প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরে দাদা আপাতত বিজেপি তালিকাতে নেই। সব মিলিয়ে এই মাদ্রিদ-বার্সেলোনা প্রকল্প থেকে রাজ্যে ফুটবল আসছে আর মহারাজের এক প্রতিশ্রুতি, এটাই প্রাপ্তি। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, বেহালার মহারাজ, মাদ্রিদে গিয়ে মেদিনীপুরে লোহা কারখানা তৈরি করার ঘোষণা করলেন, আপনাদের কি মনে হয় সত্যিই এই শিল্প গড়ে উঠবে? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
আজ বিশ্বকর্মা পুজো, ঢাক বাজছে, রিকশা স্ট্যান্ডে, গ্রিল ফ্যাক্টরিতে, বেহালা তারাতলা জুড়ে শিল্পের কঙ্কাল পড়ে আছে। বাংলার অ্যামবাসাডর গাড়ি মানেই তো হিন্দমোটর, সে এখন ভূতের জায়গা, হাওড়ার যন্ত্রপাতি শিল্প ধুঁকছে, চটকল খোলে আর বন্ধ হয় মালিকও নয় ভাড়াটে মালিকের ইচ্ছেয়। শিল্প যা নাকি এসেছিল সেদিন, সেই দুর্গাপুর ইত্যাদি এখন ইতিহাস। এখন শিল্প মানে ফুটবল, শিল্প মানে পর্যটন, শিল্প মানে মহারাজের আশ্বাসে গড়ে ওঠা টিএমটি বার ফ্যাক্টরি।