অনেকে বলছে বিজেপি হেরে যাবে, অনেকে। যে গোদি মিডিয়াতে সমবেত হুক্কাহুয়া চলছিল, তাদেরও গলাতে অন্য সুর, ছন্দপতন আমরা দেশতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি। সে যাক, এক চূড়ান্ত অপদার্থ সাম্প্রদায়িক জনবিরোধী সরকার আজ না হয় কাল তো যাবেই, এরাও যেতেন কিন্তু আমার দুঃখ একটা ক্ষেত্রে থেকেই যাবে। এই নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহের একশো রগড় আর দেখা যাবে না, সেটাই আমার দুঃখ। ধরুন উনি রবিঠাকুরের ছদ্মবেশ ধরে দাড়ি বাড়িয়ে এই বাংলাতে আসবেন, তারপর সেই চোলায় চোলায় বাজবে জোয়ের ভেড়ি, রাজ্যসুদ্ধু লোকের খোরাক। হ্যাঁ, বিশ্বাস করুন বিজেপিতে কিছু তো সুস্থ মানুষজন আছেন, তাঁদের একজন বড় সাংবাদিক তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন যে কেন যে উনি রবি ঠাকুর বলতে গেলেন কে জানে? তারপর বেলুড়ঘাট থেকে ভিদ্দিয়াসাগরের সহজ পাঠ, ওনারা বলে চলে যান, আমাদের বাজারের চাপে বিধ্বস্ত জীবনে খোরাক জোটে। ওনাদের রাজ্যের নেতাদের কথাও কি কম মজার? একা দিলু ঘোষই তো জহর-ভানুর কমেডির থেকে কম নাকি? গরুর কুঁজে সোনা থেকে বুদ্ধিজীবীদের রগড়ে দেওয়ার হুমকি, কম নাকি? নরেন্দ্র মোদি বাংলার বাইরে এবারেও ছড়াচ্ছেন, মণিমুক্তো। কিন্তু বাংলাতে একটু সিরিয়াস রোলে নেমেছেন, টেনশনে হাসি আসে না গোছের ব্যাপার। কিন্তু অবকি বার দোশো পার বলা অমিত শাহ সেই অভাব পূরণ করে দিয়েছেন। মাত্র গতকাল তিনি বলেছেন সত্যজিৎদা, হ্যাঁ সত্যজিৎদা বলেছেন। একজন বললেন মানিকদা বলেননি যে এটাই কি যথেষ্ট নয়, তো ওনার সত্যজিৎদা বেঁচে থাকলে নাকি হীরক রানির দেশে নামে ছবি বানাতেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি এই গুজরাটি তড়িপার মানুষটি হীরক রাজার দেশে দেখেননি, যে কোনও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এমন সরব এক ছবি আজ তৈরি হত না, কারণ এই ছবির জন্য প্রযোজক মিলতো না, আর মিলে গেলেও সেন্সর এই ছবিকে রিলিজ করতে দিত না। আর যদি তর্কের খাতিরে আদালত ইত্যাদি করে একটা সেন্সর সার্টিফিকেট জোগাড়ও হত, তাহলেও তা রিলিজ করার হল পাওয়া যেত না। অমিত শাহ বলেছেন, সত্যজিৎদা, আজ বেঁচে থাকলে নাকি নতুন করে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে হীরক রানির দেশে নামের ছবি করতেন, সেটাই বিষয় আজকে, দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান।
অমিত শাহের সত্যজিৎদা, আমাদের সত্যজিৎ রায় যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে কি মমতাকে নিয়ে একটা ছবি তৈরি করতেন? এরকম বকওয়াস আলোচনার কোনও মানেই হয় না কারণ সত্যজিৎবাবু স্বৈরাচারের পুংলিঙ্গ বা স্ত্রীলিঙ্গ যে হয় না তা বিলক্ষণ বুঝতেন, বুঝতেন বলেই ইন্দিরা গান্ধীর ওই জরুরি অবস্থার প্রেক্ষিতেই হীরক রাজার দেশে বানিয়েছিলেন। রাজা হোক রানি হোক স্বৈরাচারের স্বরূপটা তিনি বুঝিয়েছিলেন এক রূপকথার আঙ্গিকে। আমরা বুঝেছি, বিশ্বের মানুষ বুঝেছে, এক তড়িপারের বোঝার কথা নয়, বোঝেনওনি।
আরও পড়ুন: Aajke | সন্দেশ এবার শুভেন্দুর গলায় আটকেছে
আজ যাঁরা সিনেমা নিয়ে সামান্যতম খবরও রাখেন তাঁরা প্রত্যেকে একমত হবেন যে এই জমানাতে সত্যজিৎবাবুর অন্তত দুটো ছবি সেন্সর সার্টিফিকেট পেত না, আর পেলেও তা সিনেমা হলে আসতে দিত না এই তড়িপারের দল, এই বজরং দল, এই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বিজেপি। দেবী আর গণশত্রু। পারলে এই ছবি দুটো আবার দেখুন। ধর্মীয় গোঁড়ামো, কু-আচার, আর অন্ধবিশ্বাস নিয়ে এ দুটো ছবির অর্ধেক কেটে বাদ দিয়ে দিত সেন্সর বোর্ড। গণশত্রুতে ক্ষমতায় বসে থাকা এক মানুষ প্রশ্ন করছে একজন ডাক্তারকে, আপনি কি নিজেকে হিন্দু বলে মনে করেন? আপনি মন্দিরে যান না কেন? এক্কেবারে আজকের গোরক্ষকদের প্রশ্ন, আমরা যারা ওই ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলি, তাদের কাছে এই প্রশ্নই তো করে ওই তড়িপারের দল, আপনি কি হিন্দু? আপনি মন্দিরে যান না কেন? আর যদি নাই যান, তাহলে পাকিস্তানে চলে যাচ্ছেন না কেন? গণশত্রুতে যে ডাক্তার বলছেন মন্দিরের সামনের পুকুরের জল বিষাক্ত হয়েছে, রোগ ছড়াবে, তাঁকে প্রশ্ন করা হচ্ছে আপনি কি হিন্দু? তারপর তার বাড়িতে ঢিল ছোড়া হচ্ছে, কাচ ভাঙা হচ্ছে, ভয় দেখানো হচ্ছে। ঠিক যেমনভাবে এই হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা গৌরি লঙ্কেশকে খুন করে, দাভোলকরকে খুন করে, বাকিদের ভয় দেখায়, ঠিক তেমন করেই। ওই যে দু’ একজন বাংলা জানেন, তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ এখনও আছেন বিজেপিতে তাঁরা অমিত শাহকে বলুন, এক) স্বৈরাচারের কোনও লিঙ্গ হয় না এটা আমাদের সত্যজিৎ রায় জানতেন। দুই) সত্যজিৎবাবুকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে বিজেপি-আরএসএস-এর বিপদ বাড়বে, আর এসব না করে রাজার মূর্তি সামলান, অলরেডি সেই দুষ্টু ছেলেটা ঢিল মেরে রাজার নাক ভেঙে দিয়েছে, মগজ ধোলাই যন্ত্রও কাজ করছে না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, হাইপোথেটিকাল প্রশ্ন, সত্যজিৎ বাবু বেঁচে থাকলে এই চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক জঙ্গি জাতীয়তাবাদী আরএসএস-বিজেপর বিরুদ্ধেই কি সরব হতেন না? তিনি কি মনে করতেন না যে দেশের কেন্দ্রে শাসনে থাকা এই বিজেপি সরকার অনেক বেশি ভয়ঙ্কর? শুনুন মানুষজন কী বলছেন?
যারা শিক্ষার বাজেট কমিয়ে ডিফেন্স বাজেট বাড়ায়, যারা শিক্ষাকে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে, যারা মানুষকে, কৃষককে শ্রমিককে অনাহারে রাখে, যারা সভাসদদেরকে হিরে দিয়ে তুষ্ট রাখে, যারা স্বৈরাচারী, যারা মানুষের মগজ ধোলাই করে অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের বদলে এক অলীক কল্পনাকেই মাথায় ঢোকাতে চায় তাদের নিয়েই হীরক রাজার দেশে তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তড়িপার যখন সেই ছবির কথা মনেই করিয়েছেন, তখন একবার দেখে নিন, হীরক রাজার ছবিটা পরিষ্কার হবে, তারপরে দড়িও আছে, হাওয়াও ঘুরছে, সক্কলে মিলে জোরসে বলুন, দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান।