কাঁথির খোকাবাবু কিছুদিন আগে বোমা ফাটানোর কথা বলেছিলেন, ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি কেড়ে নেওয়ার বোমা। তো সে বোমা কোথায় ফেটেছে তা আপনারাই ভালো বলতে পারবেন। ক’দিন আগেই সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে যা বলা হয়েছে তাতে একজনও নিরপরাধ শিক্ষকের চাকরি যাবে না, এই স্বস্তি তাঁরা পেয়েছেন। এবং তার ক’দিন পরেই সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে জেল থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে বেরিয়ে এলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল, তিনি বেরিয়ে এসেই প্রচারে নেমেছেন এবং ওনার এই প্রচারের জন্যই দিল্লিতে ৩-৪ খানা আসনে বিজেপি হারবে। তারপরেই গতকাল ওই সর্বোচ্চ আদালত নিউজ ক্লিকের মালিক সম্পাদকের গ্রেফতারকেই বেআইনি বলে রায় দিলেন, তাঁকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিলেন, নেহাতই প্রবীর পুরকায়স্থের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল হয়েছিল, তাই তাঁকে নিয়মরক্ষার জন্য জামিন নিতে হল। ওই গতকালই শ্রীনগরের বিশেষ আদালত ৭২ দিন ধরে ইউএপিএতে বন্দি সাংবাদিক আসিফ সুলতানকে জামিনে মুক্তির আদেশ দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, ওই গতকালই ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির প্রাক্তন কনসালট্যান্ট এডিটর, সাংবাদিক গৌতম নওলাখাকে আদালত জামিন দিয়েছে, উনি এখন কিছু সাধারণ হাজিরার শর্তসাপেক্ষে বাইরে ঘোরাফেরা করতে পারবেন, লিখতে পারবেন। এদিকে ইডি গ্রেফতার করেছিল তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহাকে, তিনিও জামিন পেয়েছেন। কোথাও কি অন্য হাওয়া বইছে? বা আমরা যে কথা বলছিলাম, এই ক’দিন ধরেই যে এই মুহূর্তের হাওয়া বলছে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না, সেই খবর কি বিচার ব্যবস্থার কাছেও পৌঁছছে, লাল চোখ রাঙানি অস্বীকার করে, চাপমুক্ত বিচার ব্যবস্থা কি তাহলে এবার সুবিচার দেবে। আমাদের চ্যানেলের মালিক কাম সম্পাদক আজ ৩০৫ দিন জেলেই আছেন, আদালতে আসছেন, যাচ্ছেন, নতুন তারিখ পড়ছে, আবার আসছেন, এরকম চলছিল, প্রায় হঠাৎই সেখানেও নতুন হাওয়া। বিচারক ইডিকে মানে ইডির আইনজীবীকে সাফ জানিয়েছেন এনাফ, এবারে এই অভিযুক্ত যে তথ্যগুলো এনে হাজির করেছে তার ক্লারিফিকেশন চাই, সেগুলো সত্যি না মিথ্যে?
তাহলে একটু পুরনো গল্পটা মনে করিয়ে দিই। গল্পের শুরু এক এফআইআর থেকে, ২ নভেম্বর ২০১৭তে রাজস্থানের জয়পুরে এক এফআইআর দায়ের করা হয়, মূলত টাকা তছরুপ, চিটিংবাজি, চিটফান্ডের মাধ্যমে মানুষের টাকা নিয়ে ফেরত না দেওয়া ইত্যাদি ধারায় অভিযোগের ভিত্তিতে ওই জয়পুর থেকেই গ্রেফতার করা হয় পিনকন স্পিরিটস লিমিটেডের মালিক মনোরঞ্জন রায়কে। এফআইআর ছিল আমাদের রাজ্যের খেজুরি থেকেও, তার বহু আগেই করা, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭তে দায়ের করা আরেক এফআইআরেও একই অভিযোগ ছিল, সেটাও এই গ্রেফতারির সঙ্গে জোড়া হল। যথারীতি সার্চ হল, রেড হল বিভিন্ন দফতরে, বিভিন্ন ডকুমেন্ট সিজ করা হল, সেসবের ভিত্তিতে মামলা চলতে লাগল। ২০২০তে ৩ অক্টোবর বিচারকেরা রায় দিলেন, আজীবন কারাবাসের রায় ঘোষণা হল। সে রায়ে কী বলেছিলেন বিচারকেরা, আসব সে কথায়। কিন্তু এতবড় এক মামলায় যেখানে অপরাধীর আজীবন কারাবাসের সাজা শোনানো হচ্ছে যা প্রায় তিন বছর ধরে চলল, সেই মামলাতে কোনও দলিল দস্তাবেজে কি একবারের জন্য কৌস্তুভ রায়ের নাম বা তাঁর অন্য কোনও কোম্পানির নাম এসেছে? না, আসেনি। কোনও এক চিলতে কাগজেও এরকম কোনও তথ্য নেই। সেসব দলিল দস্তাবেজ আদালত দেখেছে, বাদী, বিবাদী পক্ষের উকিলেরা সেসব দস্তাবেজ নিয়ে সওয়াল করেছেন। না, একবারও সেই দলিল দস্তাবেজের কোথাও না ছিল কৌস্তুভ রায়ের নাম, না তাঁর কোনও কোম্পানির নাম।
তো সেই দলিল দস্তাবেজ দেখে বিচারকেরা কী বলেছিলেন? বলেছিলেন, “Monoranjan Roy has intention to cheat from the very beginning so he did not keep proper legal system because the existence of such systems will be helpful for a clear and clean accounts. He told lies and took loans from the banks. The banks and the authorities had the duty to investigate before giving loans, in that case such irregularities would not be happened. Probably they were purchased by Monoranjan Roy. Monoranjan Roy intentionally created such irregularities so that it cannot be identified easily in case of legal enquiries and legal claim or in investigation. খুব সাফ জানিয়েছিলেন যে এই মনোরঞ্জন রায় একজন ঠগ, প্রতারক, হিসেবের খাতায় যতরকমের গন্ডগোল করা সম্ভব উনি ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছেন। বলেছিলেন, the activities of Monoranjan Roy is full of irregularities and he had intention to cheat the public, banks and creditors from the very beginning and his submission and activities are full of contradictions. কেবল সাধারণ মানুষ নয়, ব্যাঙ্ক সহ বিভিন্ন সংস্থাকে সে ঠকিয়েছে, তার কাজকর্ম গোলমেলে, তার বিভিন্ন সময়ে আবেদনে স্ববিরোধিতা আছে এবং সে এগুলো ইচ্ছে করেই করেছে। উচ্চ আদালত একজন মানুষের সম্পর্কে এই কথাগুলো বলেছে, এবং আমরা এইসব বিচারকের উপরে তো আস্থা রাখতেই পারি। এবার মজার ঘটনা হল, সেই মনোরঞ্জন রায় ২০২৩-এ হঠাৎই জানালেন তিনি কৌস্তুভ রায়কে টাকা দিয়েছেন। কীভাবে জানালেন? জেরাতে জানালেন, কেবল জানালেন না, তিনি একটা হিসেবের খাতার কিছু পাতাও ইমেল করলেন ইডির কাছে যেখানে দেখা যাচ্ছে কৌস্তুভ রায় ওই ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। জেল খাটছে এমন আসামি ইমেল করলেন? কোথা থেকে? জেল থেকে ইমেল করা যায়? কোন আইনে? তাঁর দফতরের সমস্ত কাগজ আগেই সিজ করেছে বিভিন্ন সংস্থা, তিনি এই হিসেবের খাতা পেলেন কোত্থেকে? কে জোগাল তাঁকে এই বুদ্ধি?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | হাওয়া ঘুরছে, মোদিজি টাল সামলাতে পারছেন না
সাজা পেয়ে জেল খাটছেন, তারপরেও তিনি এই তথ্য দিয়ে কার হাত শক্ত করছেন? কেন ২০২৩ সালে এই কাগজ উঠে এল? কারণ সামনে ২০২৪-এর নির্বাচন? কারণ কি ওই নির্বাচনের আগে কলকাতা টিভি চ্যানেলের সম্পাদককে জেলে পুরে রাখার নির্দেশ? যাকে বিচারকরা ভদ্রভাষাতে চিটিংবাজ বলেছেন, কেবলমাত্র তার দেওয়া এক উটকো তথ্যের ভিত্তিতে কলকাতা টিভি চ্যানেলের মালিক সম্পাদককে গ্রেফতার করল ইডি। এখন আদালতের অনুমোদন পেয়েই কৌস্তুভ রায় নিজেই এই মামলা লড়ছেন, মঙ্গলবার বিচারকের সামনে তিনি বললেন, ইডির দাবি অনুযায়ী আমি মনোরঞ্জনের কাছ থেকে ৪ কোটি ২৯ লোক ২৫ হাজার ৪৪৪ টাকা নিয়েছি। ইডি দাবি করেছে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে অথবা নগদে ওই টাকা আমি নিয়েছি। আমি আদালতের কাছে জানাচ্ছি আমি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ১ কোটি ৯২ লক্ষ টাকা এবং নগদে ৭২ লক্ষ টাকা পেয়েছি। আদালতের কাছে আমার অনুরোধ ইডি যে ৪ কোটি ২৯ লক্ষ ২৫ হাজার ৪৪৪ টাকা নেওয়ার অভিযোগ এনেছে তার উপযুক্ত নথি ও প্রমাণ আদালতে পেশ করুক। কিসের ভিত্তিতে ইডি এই আর্থিক লেনদেনের দাবি করছে তা আদালতের জানা প্রয়োজন। ২০২৩ সালের ৭ জুলাই মনোরঞ্জন রায়ের জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্টের বিষয়টি উঠে আসে। আমার দাবি ওই স্টেটমেন্ট আদালতে পেশ করুক তদন্তকারী সংস্থা। আমাকে যে মামলার নথি দেওয়া হয়েছে তাতে ওই ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট নেই। আমি আদালতের কাছে দাবি জানাচ্ছি যে পরিমাণ অর্থ ওই ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্টের ভিত্তিতে আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এসেছে বলে তদন্তকারী সংস্থা দাবি যে করছে, সেই পরিমাণ অর্থ কখনও আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আসেনি। বিচারপতি শুনতে পারতেন, ইডিকে তথ্য নিয়ে আসার নির্দেশ দিতে পারতেন, তার বদলে তিনি বললেন এই অভিযোগ তো ভয়ঙ্কর। তিনি ইডির আইনজীবীকে বললেন, এই স্টেটমেন্টের বিষয়টি আবেদনকারী যে প্রশ্ন তুলেছেন এটা তো ভয়ঙ্কর অভিযোগ। আবেদনকারী হয়তো না বুঝেই বলছেন। কিন্তু এটা তো তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অভিযোগ। এই বিষয়ে তদন্তকারী অফিসারকে আদালতকে সন্তুষ্ট করতে হবে।
মাথায় রাখুন প্রায় একই ভাষায় গতকাল সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি নিউজ ক্লিক সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থের মামলার রায় দিতে গিয়ে বলেছেন, বলেছেন এ তো চরম অন্যায়, কিসের ভিত্তিতে ওনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাও তো জানানো হয়নি, এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। মঙ্গলবার এরপরে কলকাতা টিভির সম্পাদক কৌস্তুভ রায় বলেন, গত বছর ১৭ জুলাই তদন্তকারী সংস্থা দাবি করে ১ কোটি ৯১ লক্ষ। ওই বছর ১৮ জুলাই মাসে তদন্তকারী সংস্থার দাবি ১ কোটি ৯২ লক্ষ। কিন্তু চার্জশিটে দেখা যাচ্ছে তদন্তকারী সংস্থা দাবি করছে ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা আমি নিয়েছি। কিন্তু মনোরঞ্জন রায়ের যে হিসাব বা লেজার পেশ করা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে অর্থের পরিমাণ ১ কোটি ৫৬ লক্ষ। তিনবার তিন রকম হিসেব। এখান থেকেই প্রশ্ন উঠছে যে তদন্তকারী সংস্থার হাতে ক’টি লেজার আছে। যদি তাদের কাছে তিনটি লেজার থাকে আমার কাছে পেশ করা হয়েছে একটি মাত্র লেজার। তাহলে বাকি দুটি লেজারও আদালতে পেশ করুক তদন্তকারী সংস্থা। অন্যদিকে তদন্তকারী সংস্থা দাবি করছে আমাদের বিজ্ঞাপন বাবদ চল্লিশটি বিলের মধ্যে ২৫টি বিল সঠিক বাকি ১৫টা বিল ভুয়ো। আদালতের কাছে প্রার্থনা তদন্তকারী সংস্থা আদালতকে জানাক কোন কোন বিলগুলি ভুয়ো। সেই বিলগুলি যদি আদালতের কাছে পেশ করা হয় তাহলে আমি প্রমাণ করে দেব সেই বিলগুলি ভুয়ো নয়। এই বক্তব্যের পরে বিচারক যা বলেছেন তা শুনলে অবাক হতে হবে। তিনি বলেছেন এই প্রশ্নগুলোর উপর ভিত্তি করেই সমস্ত তদন্তটি দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে আমরা যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি, সম্পূর্ণভাবে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার পর্যায়। তাই আমি আশা করব তদন্তকারী সংস্থা এই নথিগুলি আদালতে পেশ করবেন। না হলে বিচার প্রক্রিয়া ইডি কিসের ভিত্তিতে চালাবে। পিএমএল আইনের ধারা অনুযায়ী গ্রেফতারি বৈধ কি না আমায় আগে দেখতে হবে। কারণ কোন কোন প্রামাণ্য নথি আপনাদের কাছে আছে সেটা আমায় দেখতে হবে। তার উপরে ভিত্তি করেই তো তদন্তের ভিত এবং গ্রেফতারি। সেই বিষয়টা সন্তুষ্ট হলেই পিএমএল আইনের ৪৫ ধারার প্রশ্ন আসবে। এই মামলা থেকে আমার মনে আরও একটি প্রশ্ন উঠছে। মনোরঞ্জন রায় কিন্তু কোনও সাক্ষী নন, তিনি একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। পিনকন মামলায় তিনি মূল অভিযুক্ত। সুতরাং তাঁর স্টেটমেন্টের উপর ভিত্তি করে কাউকে গ্রেফতার করতে গেলে উপযুক্ত নথি এবং প্রমাণ অবশ্যই তদন্তকারী সংস্থার কাছে থাকতে হবে। এছাড়াও ২০২১ সালে তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত শুরু করেছে। প্রায় তিন বছর পর কৌস্তুভ রায়ের নাম এল। তার আগে মনোরঞ্জন রায় যে মামলায় সাজা পেয়েছেন সেই মামলায় কৌস্তুভ রায়ের নাম আসেনি। হঠাৎ তিন বছর পর কৌস্তুভ রায়ের নামে এল কেন ? কোন কোন নথির ভিত্তিতে এল? অবশ্যই বর্তমান অবস্থায় তদন্তকারী সংস্থাকে আদালতের কাছে এগুলি পেশ করতে হবে।
উনি এরপরে আবার ১৮ তারিখে শুনানির দিন দিয়েছেন, ইডিকে এইসব নথি হাজির করার কথাও বলেছেন, কিন্তু এসব নথি পেশ করার আগেই কৌস্তুভ রায়ের জেল খাটা হয়ে গ্যালো ৩০৫ দিন। মাথায় রাখুন ২০২৩-এর ৩ অক্টোবর নিউজক্লিক সম্পাদককে জেলে পোরা হয়েছিল, তিনি জেল খেটেছেন প্রায় ৭ মাস, আর কাশ্মীরের আসিফ সুলতান জেলেই ছিলেন ৭২ দিন, গৌতম নওলাখা জেল আর গৃহবন্দি ছিলেন ৫ বছরেরও বেশি। হাওয়া ঘুরছে, কোনও রক্তচক্ষু আর কাজ করছে না, আগল ভাঙছে। জেলের কপাটও। এবং মানুষ, দেশের গণতান্ত্রিক মানুষ কী চায়? খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর সুবিচার। আমরাও তো তাই চাই। আমরা নিশ্চিত এই ক্ষেত্রেও বিচারক এই ষড়যন্ত্রের কথা বুঝবেন, বুঝবেন যে কেবল রাজনৈতিক কারণে বিরোধিতাকে থামানোর জন্য, বিরোধী স্বরকে চুপ করানোর জন্যই আমাদের চ্যানেল সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা সেই সুবিচারের অপেক্ষায় আছি।