আপনি বাজারে গিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা চাঁদের উত্তর ভাগের দাম জানতে চান না, এমনকী খুব সাধারণ মানুষ চিতলের পেটি বা এক কেজি ওজনের লবস্টার বা আড়াই কেজির পদ্মার ইলিশের দাম চান না, এটা সবাই জানেন। সব্বাই জানেন লাদাখের মানুষজন এয়ার কন্ডিশন মেশিনের দাম জিজ্ঞেস করেন না। কেন? কারণ হয় এগুলো তাঁদের সামর্থ্যের বাইরে, বা এগুলো তাঁদের প্রয়োজনই নেই। কিন্তু আমাদের সবে প্রাক্তন জাস্টিস অভিজিৎ গাঙ্গুলি প্রকাশ্য জনসভায় এক সত্তরোর্ধ মহিলার দাম জিজ্ঞেস করেন, যিনি আবার এই রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীও। উনি জনসভায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছেন আপনার দাম কত? ভাবতেই লজ্জা লাগে ইনি নাকি আমাদের উচ্চ আদালতের বিচারক ছিলেন। কোন মানসিকতার, কোন অশিক্ষার অন্ধকারে বেড়ে উঠলে এ ধরনের প্রশ্ন করা যায়? এবং দেশজুড়েই এ সব চলছে, একধারে নারীশক্তির কথা বলা হচ্ছে, অন্য ধারে বারোশো, দু’ হাজার টাকা দিয়ে ঠকিয়ে এক মহিলার সাদা কাগজের সই নিয়ে সেটাকে ধর্ষণের অভিযোগপত্র বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। রাজ্যের রাজ্যপাল যিনি প্রকারান্তরে রাজভবন থেকে বিজেপির দফতর চালাতেন তিনি একাধিক নারী লাঞ্ছনার, এমনকী ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত, বিজেপির নেত্রী হায়দরাবাদের মাধবীলতা মুসলমান মহিলাদের বোরখা খুলে দেখছেন, ক্যামেরার সামনে। তেলঙ্গানার নিজামাবাদের বিজেপি প্রার্থী ধরমপুরী অরবিন্দ বুথে ঢুকে মুসলিম মহিলাদের ধমকাচ্ছেন, কেন তাঁরা বোরখা পরে এসেছেন? আমাদের এই অসভ্য বিচারপতি কিছুদিন আগেই বিচারালয়ে বসতেন, পিছনে থাকত গান্ধীর ছবি, বিচারক পদ ছাড়ার ক’দিনের মধ্যেই তিনি এক প্রশ্নের উত্তরে গান্ধী না গডসে তার জবাব দিলেন না। গান্ধী এবং গডসের মধ্যে একজনকে বেছে উঠতে পারছেন না এ দেশের উচ্চ আদালতের প্রাক্তন বিচারপতি, বিজেপির প্রার্থী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, তিনিই প্রশ্ন করলেন আপনার দাম কত? কাকে? রাজ্যের নির্বাচিত মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে, প্রকাশ্য জনসভায়। স্বাভাবিকভাবেই সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, কত টাকা দিয়ে মহিলা কেনেন অভিজিৎ গাঙ্গুলি?
বিজেপির এই নারীশক্তি ইত্যাদির কথাগুলো যে ভুয়ো তা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে, কাঠুয়া থেকে উন্নাও, হাথরস থেকে মণিপুরের বৃত্তান্ত সেটাই প্রমাণ করে। আসলে এটা বিজেপির দর্শন, যা আসলে এক প্রবল পুরুষতান্ত্রিকতার লালন পালনের মধ্যেই বেড়ে উঠেছে। এক বিরাট সময়ে আরএসএস-এর কোনও মহিলা সংগঠনই ছিল না। শাখাতে মহিলাদের নেওয়া হত না। কারণ তাঁরা মনুবাদে বিশ্বাসী। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত মনে করেন, মহিলাদের স্থান রান্নাঘরে, সন্তান জন্ম দেওয়া আর তাদেরকে মানুষ করে তোলা।
আরও পড়ুন: Aajke | দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান
কোন মহিলা? সংস্কারী মহিলা, যাঁরা পতির সেবা করবেন, যাঁরা পুরুষ প্রধান সমাজের নির্দেশ মেনে চলবেন। সেই মনুবাদ কী বলে মহিলাদের সম্পর্কে? মনুসংহিতার নির্দেশে কেবল শূদ্রদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে তা নয়, সমস্ত বর্ণের মহিলাদের সম্পর্কে মনুর নির্দেশ অসভ্য, অমানবিক। মনুসংহিতাতে বলা হচ্ছে “যেহেতু শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুযায়ী মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমেই স্ত্রীজাতির জাতকর্ম সংস্কার পালিত হয় না তাই তাদের অন্তকরণ নির্মল হয় না। স্মৃতি শাস্ত্র ও বেদ প্রভৃতি ধর্ম শাস্ত্রের উপর স্ত্রীজাতির কোনও অধিকার নেই। তাই তারা ধর্মজ্ঞ হতে পারে না। এমনকী কোনও মন্ত্রের উপরেও স্ত্রীজাতির অধিকার না থাকায় তারা কোনও পাপ করলে মন্ত্রের সাহায্যে তা ক্ষালন করতে পারে না। তাই শাস্ত্রমতে স্ত্রিজাতি মিথ্যা অর্থাৎ অপদার্থ।” মানে হল, মহিলাদের পৈতে হয় না, তারা দ্বিজ নয়, অতএব তাদের শাস্ত্র পাঠের অনুমতি নেই। সেই কারণে তারা মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারে না। তাই তারা অপদার্থ। অভীষ্ট হিন্দুরাষ্ট্র তৈরির পর নারীর কাজ সন্তান উৎপাদন, এবং পতিসেবা। দেশের মাথায় যাঁরা মনুবাদকে চাপাতে চান, তাঁরা, তাঁদের মহান নেতা ক্ষণে ক্ষণে বলেন সবকা সাথ, সবকা বিকাশ! কিসের সবকা সাথ? মনুস্মৃতিতে সাফ বলা আছে, মাথায় থাকবে ব্রাহ্মণ আর রাজপুতেরা, ব্যবসা করবে বৈশ্যরা আর সেবা করবে শূদ্ররা, কীভাবে? তাদের ঘরের মেয়েদের আখের খেতে নিয়ে গিয়ে চিৎ করে পেড়ে ফেলা হবে, ধর্ষণ করা হবে, হত্যা করা হবে, তারপর পুলিশি পাহারায় জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। উচ্চবর্ণের সেই জানোয়াররা মিছিল করবে জাতীয় পতাকা হাতে, এটা দেশ না দেশপ্রেম? এই সরসংঘচালক গোলওয়ালকর তাঁর বাঞ্চ অফ থটস-এ লিখছেন, “জাতিভেদ প্রথা আসলে দেশের দুর্বলতা নয়, দেশের শক্তি, জাতিভেদ প্রথা না থাকলে আমাদের দেশ কবেই বহিরাগত শত্রুর কাছে নতিস্বীকার করত।” মানে এরা কেবল হিন্দুরাষ্ট্রই চায় না, এরা মনুবাদ চায়, চতুর্বণের প্রতিষ্ঠা চায়, এরা আমাদের সংবিধানে যে জাতিভেদ প্রথা তুলে জাতি ভাষা বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষের সমানাধিকার দেওয়া হয়েছে, তার অবসান চায়। সেই আরএসএস-বিজেপির নয়া দালাল অভিজিৎ গাঙ্গুলি প্রকাশ্য জনসভায় মাতৃসমা এক মহিলার দাম জিজ্ঞেস করবে, এটা তো স্বাভাবিক। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রকাশ্য জনসভায় তমলুকের বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ গাঙ্গুলি রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর দাম কত, সেটা জানতে চেয়েছেন, আপনাদের মতামত জানান।
অনেক সময় আমরা আমাদের অজান্তেই ছোটলোক, অশিক্ষিত কথাগুলো গরিব, প্রথাগত শিক্ষা না থাকা লোকজনদেরকে উদ্দেশ্য করেই বলে থাকি। কিন্তু মাঝেমধ্যেই এই অভিজিৎ গাঙ্গুলির মতো প্রকৃত ছোটলোক এবং অশিক্ষিত মানুষজন যখন আমাদের সামনে দাঁড়ায় তখন বুঝতে পারি, প্রথাগত শিক্ষা বা অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা মানুষকে বড় বা শিক্ষিত করে তুলবেই এমন কোনও গ্যারান্টি নেই, বরং মোদির গ্যারান্টিওলা এই প্রকৃত অশিক্ষিত ও ছোটলোক আরএসএস–বিজেপির পাঁকে অনায়াসে জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে। তাই আমাদের পাল্টা প্রশ্ন সবে প্রাক্তন জাস্টিস অভিজিৎ গাঙ্গুলিকে, আপনার কথায় খুব পরিষ্কার যে আপনি মহিলা কেনেন, কেবল জানতে চাই আপনি কত দামে কেনেন? কোথা থেকে কেনেন? কতদিন ধরে কেনেন?