১টা এক্সট্রা দিন নিয়ে গোটা ৩৬৬ দিনের ২০২৪ শেষ। যে বছর দেখেছে লোকসভা ভোট, আরজি কর নিয়ে রাজপথ কাঁপানো নাগরিক আন্দোলন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর— বঙ্গ রাজনীতিতে ১২ মাসে ঘটনার কমতি ছিল না। বছরের শেষে সেইসব ঘটনার দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাচ্ছে আন্দোলন, বিরোধিতা, সমালোচনার সব ‘ধাক্কা’ সামলে নিয়েছে দিদিমণির তৃণমূল। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ক্ষোভ আছে, তা যেমন সত্য, তেমনই বাস্তব যে, উপনির্বাচনে তৃণমূলের কোনও ক্ষয় হয়নি। বরং ভালো হয়েছে। এইসব আন্দোলন ইত্যাদির পরে মাত্র ছ’টি আসনের ফলাফলও অন্য হিসেব এনে দাঁড় করাতেই পারত, তা হয়নি। উল্টো দিকে, বছরের শুরু থেকে যে গর্জন শুরু করেছিল রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি, সম্বৎসর তাতে গর্জনই সার, বর্ষণ হয়নি। বছরের শেষে দেখা যাচ্ছে বাংলায় আগের থেকেও খারাপ পরিস্থিতিতে পদ্মশিবির, টার্গেটের ৫০ শতাংশ সদস্যও তারা করে উঠতে পারল না। বাম-কংগ্রেসের অবস্থা ‘অপরিবর্তনীয়’, তারা এখনও বঙ্গ রাজনীতিতে ‘প্রান্তিক শক্তি’ই কেবল নয়, তাদের ক্ষয়ে কোনও ভাটা পড়েছে কি? আগামী নির্বাচনে বামেরা ৪ শতাংশতে চলে যাবে না তো? হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই আর কংগ্রেস আপাতত দিদিমণির দিকে তাকিয়ে, যদি তাঁর নেতৃত্ব মেনে ইন্ডিয়া জোট গড়ে ওঠে তো ভালো, গোটা ৭-৮-৯ বিধায়ক পাবে কংগ্রেস দল, না হলে কত? এক কি দুই, শুভঙ্কর সরকার আমাদের চেয়ে এটা বেশি ভালো করে জানেন। আর সেটাই এই বছর শেষে বিষয় আজকে, বছরটা শুভেন্দু সেলিমের ফাটল, মমতার কেমন কাটল?
বছরের শেষে মমতা গেলেন সন্দেশখালি, এটা হচ্ছে মমতার মোডাস অপারেন্ডি, উনি এভাবেই কাজ করে থাকেন। বৃত্তের একটু বাইরে থেকে গোটা বিষয়টাকে ৫-৬-৭-৮টা দিক থেকে সামাল দিতে থাকেন, আর কন্ট্রোলে এসে যাওয়ার পরে নিজেই মাঠে নামেন, বল ঠেলে দেন, দুটো বারপোস্টের মধ্য দিয়ে সোজা গোল। সেটা সন্দেশখালি হোক বা আরজি কর। উনি চলে এলেন ডাক্তারদের মঞ্চে, তোমরা কাজে এসো, জুনিয়র ডাক্তারদের অপদার্থ নেতারা ভাবলেন উনি ভয় পেয়ে মঞ্চে এসেছেন, উনি আসলে গ্যালারির দিকে তাকিয়েছিলেন, রাজ্যের মানুষকে বোঝাচ্ছিলেন যে দেখো আমি ওদের কথা শুনতে কোনও ইগো ইত্যাদির তোয়াক্কা না করেই ওদের মঞ্চে চলে এসেছি।
আরও পড়ুন: Aajke। সিপিএমের গণশক্তি আরজি কর মামলা নিয়ে ১০০ শতাংশ মিথ্যে বলছে
যতবার বৈঠক ডাকা হয়েছে, উনি ক্যামেরা সামনে নিয়ে, টিম সঙ্গে রেখে বসে থেকেছেন, রাজ্যবাসীকে জানিয়েছেন আমরা তো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চাই। আর এক্কেবারে শেষে তিনি রাজি এমনকী লাইভ স্ট্রিমিংয়ে, কারণ ততদিনে নিয়ন্ত্রণ ওনার হাতে। উনি রাজ্যের মানুষদের জানাতে চান, এই ডাক্তারেরা কর্মবিরতির নাম করে টাকা কামিয়েছে, বৈঠকে বসেই জানালেন সে কথা, নন্দ মাহাতো হালদারদের মুখে কথা নেই। এই ২০২৪-এর শুরুতেই সংবাদ শিরোনামে চলে আসে সন্দেশখালি। রেশন দুর্নীতি মামলায় ৫ জানুয়ারি সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে হানা দিয়েছিল ইডি-র দল। কিন্তু ‘শাহজাহান বাহিনী’র ঝাড় খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে ফিরতে হয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকদের। তার পর থেকে সন্দেশখালির নানান ঘটনা ফ্রন্টপেজে আসতে থাকে। ধারাবাহিক ভাবে অভিযোগ উঠতে থাকে, ওই শেখ শাহজাহান আর তার তৃণমূলের বাহিনী মহিলাদের ‘সম্ভ্রম’ বলে কিছু রাখেনি। তৃণমূলের পার্টি অফিসে মহিলাদের পিঠে তৈরি করার জন্য ডাকা হয়। কোমর বেঁধে নামে বিজেপি। জাতীয় মহিলা কমিশন, বিজেপির নেতানেত্রী, সিপিএমের নেতানেত্রীরা যেতে থাকেন ওই সন্দেশখালিতে। টানা প্রায় আড়াই মাস ধরে সন্দেশখালি ঘিরে তৃণমূল-বিরোধী ভাষ্য যখন ‘বিশ্বাসযোগ্য’ পর্যায়ে যেতে শুরু করেছে, তখন পাল্টা এক গোপন ক্যামেরা অভিযান এসে গেল ময়দানে, ব্যস, মানুষের কাছে লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার মেসেজ, প্রচুর অর্থব্যয় করে, মদের জোগান দিয়ে বিজেপি সন্দেশখালির ‘চিত্রনাট্য’ সাজিয়েছিল। স্থানীয় বিজেপি নেতাকে সে সব বলতেও শোনা যায় ভিডিওতে। তার পরেই সন্দেশখালি আর ‘একপেশে’ থাকেনি। নির্বাচনে বিরাট জয় এসেছে, কিন্তু সেই জয়ের পরেও মমতা আরও ঘুঁটি সাজিয়েছেন, এবারে তিনি গেলেন সেই সন্দেশখালিতে, মানুষের ভিড়, মহিলাদের ভিড়। পিঠে উৎসব যাকে বলে। এইভাবেই ২০২৪-এর জোড়া ধাক্কা সামলে মমতা যতখানি উজ্জ্বল, ততখানিই মলিন আমাদের কাঁথির খোকাবাবু, তাঁর নিজের দুর্গ ভাঙছে, ২০২৬-এ মিলিয়ে নেবেন মমতা ওই নন্দীগ্রাম থেকেই দাঁড়াবেন, জিতবেন। তার ঘুঁটি সাজানো চলছে। ২০২৫-হল ২০২৬-এর কুরুক্ষেত্রর প্রস্তুতি পর্ব। ১৫ বছরের একটানা শাসনের পরে মমতার বিপক্ষে অ্যান্টি ইনকবান্সি, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তো থাকবেই, কিন্তু এখনও তার ছিটেফোঁটাও মাটিতে দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বামেরা যাকে বলে কর্পূর হয়ে উঠেছেন, নিজেরাই উবে যাচ্ছেন, বাতাসে গন্ধ থেকে যাচ্ছে কেবল, কমরেড সেলিম জেলায় জেলায় নানান প্রশ্নের মুখে, হারের দায় চাপছে ঘাড়ে, কমরেড সুজনকে দেখলে ক্লান্ত নাবিক মনে হচ্ছে, কমরেড বিমান বসু ফসিল। ওদিকে তিন ঘোড়ায় যুদ্ধ থামেনি, দিলীপ, সুকান্ত, শুভেন্দু লড়ে যাচ্ছেন, ইন্টেলেকচুয়াল শমীক রাজ্যসভা পেয়েই খুশি, বিজেপির র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইলের বড় অংশ আবার তৃণমূল মুখী। তো আমরা আমাদের দর্শকদেরও ওই প্রশ্নই করেছিলাম, বছরটা শুভেন্দু সেলিমের ফাটল, মমতার কেমন কাটল? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
এক বাম নেতার সঙ্গে মুখোমুখি কথা হচ্ছিল, ওয়ান ইস্টু ওয়ান কথা হলে ওনাদের গলাতে কেবল হতাশার সুর বাজে। তো উনি বলছিলেন, আর কী করব বলুন তো? এত বিরোধিতা, এত মানুষের রাস্তায় নেমে আসা, তারপরেও মানুষের ভোট তো পাচ্ছি না। আর কীভাবে আন্দোলন করব? তো আমি তাঁকে বলেছিলাম, চোখটা বুজুন, মনে করুন কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা কমরেড সেলিম মুখ্যমন্ত্রী, আর বিরোধী নেতা মমতা ব্যানার্জি। এবার ভাবুন সেই সময়ে আরজি করে এই ঘটনাটাই ঘটল। তারপরে ভাবুন মমতা ব্যানার্জি কী করবেন। ঠিক সেটাই আপনারা করতে পারছেন না। উনি চোখ বুজে ছিলেন, চোখ খুলে বললেন, উরিব্বাস, ভাবলেও হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে। হবে না, হবে না, আমাদের দলে মমতা নেই। নিন বুঝুন সমস্যাটা।