করোনার প্রভাবে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের অবস্থা সব থেকে খারাপ। থিয়েটারের পরিচালক ও অভিনেতারা তবুও অন্যান্য মাধ্যমে কাজ করে সার্ভাইভ করছেন, তবে একান্ত থিয়েটারের উপর নির্ভর যাঁরা, তাঁদের অবস্থা সব থেকে খারাপ। অনেক ক্ষেত্রেই বহু শিল্পী বিকল্প কাজের সন্ধান করছে। সারা জীবন থিয়েটারের সঙ্গে থেকে হঠাৎ করে অন্যধরণের কাজ করে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না। অনেকেই বিকল্প পেশা হিসেবে বাজারে মাছ বিক্রি করার চেষ্টা করছে , কেউ আবার ধূপ বিক্রি করছে। কোভিড এর কারণে সব ধরনের পেশাতেই মন্দা। তাই অনেকেরই নুন আনতে পান্তা ফুরাচ্ছে। কেউ আবার অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে থিয়েটারের ভবিষ্যৎ কী? কী ভাবেই বা থিয়েটার নির্ভর শিল্পীরা বেঁচে থাকবে।
এই বিষয়ে বেশকিছু থিয়েটার শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে বেশকিছু দিক উঠে এসেছে।
‘চেতনা’ নাট্যগোষ্ঠির পরিচালক ও অভিনেতা সুজন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, প্রথম বারের লকডাউনের সময় ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশকিছু ফান্ড রাইস করে কিছু সাহায্য করেছিলেন। সেই সময় সবাই ভেবেছিলেন এই বিষয়টা আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু এখন পরিস্থিতি খুব খারাপ। অনেক সময় খবর পাই শিল্পীরা নিরুপায় হয়ে বিকল্প পেশায় চলে যাচ্ছেন। সেখানে তাঁদের অবস্থা খুব খারাপ। থিয়েটারের পরিচালক বা অভিনেতারা তবে অন্য মাধ্যমে কাজ করতে পারছেন। কিন্ত যাঁরা থিয়েটারের লাইট করেন, আবহ সঙ্গীত করেন তাদের হাতে কাজ নেই, থিয়েটারের পাশাপাশি মঞ্চকে কেন্দ্র করে যেসব অনুষ্ঠান সবই এখন বন্ধ। অবস্থার উন্নতি করার কোন উপায় এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছিনা। আমার অনেক বন্ধুরা ডিজিটাল থিয়েটার চেষ্টা করছেন তবে তার জন্য যে বাজেট দরকার, সেটাইতো নেই। তাই থিয়েটারের উপর যারা নির্ভরশীল তাঁদের অবস্থা খুব খারাপ। করোনা না যাওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা সম্ভব নয়।
এই বিষয়ে নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত অভিনেতা পরিচালকরা নিজেদের মতো করে কিছু উপার্জন করছে। অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যম এই সময়েও কাজ করছে। সে টেলিভিশন হোক বা ওটিটি কাজ হয়ে চলেছে। তবে থিয়েটারের ক্ষেত্রে এই রকম কোন উপায় নেই। সিনেমা, সিরিয়ালের গতবছর সমস্যার সময় ফেডারেশনের তরফ থেকে কলাকুশলীদের সাহায্য দিয়েছিল। তবে থিয়েটারের এমন কোন ফেডারেশন নেই। যদিও সরকারের নাট্য আকাডেমি রয়েছে। কিন্তু সরকারি সাহায্য সেইভাবে পাওয়া যায়নি। আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু সাহায্য করছি, তবে সেটা তো খুব ক্ষুদ্র। সরকারের উচিত এই বিষয়টা একটু ভেবে দেখা, আকাডেমি তো রয়েছে, কোন দলকে নয় সরকারি আধিকারিকদের দিয়ে যদি একটি তালিকা করে দুঃস্থ শিল্পীদের সাহায্য করলে থিয়েটারের শিল্পীদের কিছুটা সমস্যা লাঘব হয়। বর্তমানে থিয়েটার নিয়ে কিছু ডিজিটাল উপস্থাপনের চেষ্টা করলেও তাতেও বাজেট পাওয়া যায়না। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সরকারের কাছে একবার সাহায্য চেয়ে আবেদন করা হয়েছিল, তখন কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যদি কিছু ভাবনা চিন্তা করেন। “
তবে থিয়েটার পরিচালক ও অভিনেতা শেখর সমাদ্দার কথায়, পেশাদার থিয়েটার বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন যেটা আছে তা হল গ্রুপ থিয়েটার। এটা থেকে রেভেনিউ কোন দিন আসেনি তবে মনের খিদে মেটাতে সাহায্য করে। সেখানে কেউ যদি এটাকে পেশা করে নেন তাহলে সমস্যা হবেই। আর এখনতো সব জীবিকাতেই সমস্যা রয়েছে, কাজ চলে যাচ্ছে, মাইনে হচ্ছেনা। সেখানে থিয়েটারের কর্মীরা অসংগঠিতই থেকে গেছে। তাই সরকারও সেই ভাবে গুরুত্ব দেয় না। দিল্লি থেকে কিছু অনুদান আসতো , এখনতো সেটাও অনিয়মিত। তবে এবার ভাবতে হবে , ছোট ছোট দল না করে নির্দিষ্ট কিছু নাট্য গোষ্ঠী করে নথিভুক্ত করতে হবে সকলকে। নতুন করে নাট্য জগতের সকলকে লড়াই করতে হবে। তাহলে থিয়েটারের কিছু সুদিন আসার সম্ভবনা থাকতেও পারে।”
বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের উপর। থিয়েটারের কর্মীদের একত্রিত হয়ে নিজেদের সংগঠিত করলে হয়তো বাংলা থিয়েটারের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে। না হলে বহু নাট্য কর্মী নিজেদের বাঁচার লড়াই করতে থিয়েটার ছেড়ে ভিন্ন পেশায় চলে যেতে বাধ্য হবে।