শুভাশিস মৈত্র: তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে ফরওয়ার্ড ব্লকের একটা মিল আছে। দুটো দলই কংগ্রেস নেতৃত্বের উপর বিরক্ত হয়ে আলাদা শিবির গঠন করেছিল। ফব ১৯৩৯ সালে। তৃণমূল কংগ্রেস তার ৫৯ বছর পরে ১৯৯৮ সালে। ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতারা যে দাবিই করুন, বাস্তব হল, সুভাষ বসুর সেই ফরওয়ার্ড ব্লক বহু দিন আগেই হারিয়ে গিয়েছে। এখন যে দলকে আমরা দেখি, সেটা হল বামফ্রন্টের শরিক ফব। দলীয় সূত্রে খবর, আগামী ডিসেম্বরে দলের ন্যাশনাল কাউন্সিলের বৈঠকে, দল তাদের পতাকা থেকে কাস্তে-হাতুড়ি মুছে দিয়ে, পতাকার রং ইত্যাদি বদলে, ফরওয়ার্ড ব্লকের প্যাকেজিং-এ বড়ো রকমের পরিবর্তন আনতে চলেছে। তবে বাঘের ছবি থাকবে। বোঝাই যাচ্ছে কাস্তে-হাতুড়ির দুর্দিন। কলকাতার রাস্তায় একসময় বাঘমার্কা ডবল ডেকার দাপিয়ে বেড়াত। এখন আর দেখা যায় না। বাঘ রেখে পতাকা থেকে কাস্তে-হাতুড়ি মুছে দেওয়া, আসলে বাঘের গায়ের ডোরা মুছে দেওয়ারই সামিল। বাঘমার্কা ফব মার্কেটিংয়ের স্বার্থে তাদের প্যাকেজিং বদলে রাজনৈতিক বিপন্নতা আদৌ কাটাতে পারবে কি না, তা এখনই বলা খুব কঠিন। তবে এই সিদ্ধান্তে এটা স্পষ্ট, তারা বাম ফ্রন্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান।
আরও পড়ুন- কাস্তে-হাতুড়ি মুছে নেতাজির দেখানো তেরঙ্গায় ফিরছে ফরওয়ার্ড ব্লক
বঙ্গ রাজনীতিতে জ্যোতি বসুর অবদান কী? এই নিয়ে যদি কোনও প্রবন্ধ লিখতে হয়, তাহলেই প্রথমেই লিখতে হবে, দক্ষতার সঙ্গে দেশের সব থেকে দীর্ঘস্থায়ী বহুদলীয় ফ্রন্টকে রক্ষা করা এবং তার নেতৃত্ব দেওয়া। জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পরের বছর, ২০১১ সালে, বামফ্রন্ট তার ৩৪ বছরের দৌড় শেষ করে। তার পর দুটো লোকসভা, তিনটি বিধানসভা ভোট হয়ে গিয়েছে। ১৯৫২ সালে, স্বাধীনতার পর রাজ্যের প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে ২৬ আসন নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি যাত্রা শুরু করেছিল। সেই সময় থেকে ধরলে, প্রথমে সিপিআই, পরে সিপিএমের টানা ৬৪ বছর ধরে প্রধান শত্রু ছিল কংগ্রেস। ২০২১-এ এসে দেখা গেল, সেই প্রধান শত্রুর হাত ধরে নির্বাচনী রাজনীতিতে এই রাজ্যে, দুটো রাজনৈতিক শক্তিই একই সঙ্গে প্রায় মিলিয়ে গেল। কংগ্রেস এবং জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্তদের হাতে গড়া বামফ্রন্টের মিলিত আসন হল শূন্য। ব্যতিক্রম এই জোটের নতুন এক শরিকের একটি আসন প্রাপ্তি।
আরও পড়ুন- ভোটগুলি সব গেল কোথায়?
পরবর্তী বিধানসভা ভোট ২০২৬-এ বামফ্রন্ট থাকবে কি না, তা অনেকটাই নির্ভর করছে ২০২৪ সালের অষ্টদশ লোকসভা ভোটে বিরোধী জোট ক্ষমতায় আসবে না বিজেপি পুনরায় ক্ষমতায় আসবে, তার উপর। সিপিএমের তার দলের নিজের প্রার্থীদের জেতানোর ক্ষমতা আজ গুরুতর প্রশ্নের মুখে। ফলে শরিকদলগুলি আর সিপিএমের উপর ভরসা রাখতে পারছে না। এই দলগুলি সারা দেশেই কোনও একটা বড়ো দলের হাত ধরে এক আধটা আসন ম্যানেজ করে। এই দলগুলির বিজেপিতে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু সুযোগ পেলে, পরিস্থিতি সহায় হলে এই সব দলের কেউ কেউ তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলাতেই পারে। বড়ো দলের ছায়া ছাড়া এই দলগুলি একা টিকে থাকতে পারবে না। ফরওয়ার্ড ব্লক এই যে বহিরাঙ্গে কিছু পরিবর্তনের কথা ভাবছে, এই ভাবনা তাদের প্রায় তিন বছরের পুরোনো। এই বিষয় নিয়ে বরদারাজন কমিটি নামে তারা একটা কমিটিও করেছিল। এবারে মনে হয় এই পরিবর্তনগুলো ফরওয়ার্ড ব্লকে সত্যি সত্যি ঘটতে চলেছে। একটা দল নানা যুক্তি দিয়ে তাদের পতাকা থেকে যদি কাস্তে-হাতুড়ি মুছে দেয়, তা দিয়ে তারা আসলে কী বলতে চায়? কাস্তে-হাতুড়ি যে কৃষক আর শ্রমিকের প্রতীক এটা একটা শিশুও বোঝে। যদি শেষ পর্যন্ত তারা এই কাজ করেন, তারা আসলে দলের বামপন্থী পরিচয়টাই মুছে দিতে চাইছেন। বা মুছে দেওয়ার কাজে প্রথম ধাপ হবে এটা।
আরও পড়ুন- বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্র তালিবানের হাতে, চিন্তায় পুরাতত্ত্ববিদরা
সিপিএমও গুরুতর সংকটে পড়েছে। রাস্তা-ঘাট, হাসপাতাল, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষায়, ভুল ত্রুটির অভিযোগ যদি দু’একটা থাকেও, এই কাজে সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্টের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে গিয়েছে মমতার সরকার। সব মানুষের চাল-ডাল, দুয়ারে রেশন, স্বাস্থ্যসাথি, সাইকেল, স্টুডেন্ট ক্রডিট কার্ড সহ অন্যান্য অসংখ্য সুযোগ সুবিধার কথা ধরলে, জন-কল্যাণে তৃণমূল সরকার বামফ্রন্টের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে। ফলে সিপিএমকেও নতুন করে ভাবতে হবে, প্রথমে টিকে থাকার কথা, তারপর অগ্রগতির কথা। কিন্তু তারা যেহেতু কেরলে খুব শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে, ফলে এই রাজ্যে ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়ানোর কাজটা খুবই কঠিন, কিন্তু হয়তো অসম্ভব নয়। এই অবস্থায় সিপিএমের মানসিকতা, আপনি বাঁচলে ফব-র নাম। সেটা শরিকদলগুলিও বোঝে। ফলে আজ ফব অন্য পথের কথা ভাবছে। কাল অন্য শরিকরাও ভাবতে পারে। তবে ত্রিপুরা এবং উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর, অঙ্ক মেলাতে, ছোট-বড়ো অনেক রাজনৈতিক দলকেই অনেক কিছু নতুন করে ভাবতে হবে। ফরওয়ার্ড ব্লকের পরিবর্তনের ভাবনা হয়তো তার শুরু।