কলকাতা: মন্ত্রিত্ব কেড়ে নেওয়া হল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের৷ রাজ্যে তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে শিল্পমন্ত্রী করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ কিন্তু শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে ইডির হাতে গ্রেফতার এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে রাশি রাশি টাকা উদ্ধারের পর পার্থকে মন্ত্রিসভা থেকে সরানোর জোরালো দাবি ওঠে দলের অন্দরে৷ সেই মতো বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের কিছু পরেই রাজ্যের মুখ্যসচিবের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়ে দেওয়া হয়, আপাতত পার্থবাবুকে সমস্ত দায়িত্বভার থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হল৷ শিল্প দফতরের পাশাপাশি পার্থ চট্টোপাধ্যায় তথ্যপ্রযুক্তি এবং পরিষদীয় দফতরের মন্ত্রীও ছিলেন৷ তাঁর অপসারণের পর সেই সব দফতর আপাতত সামলাবেন মু্খ্যমন্ত্রী নিজেই৷ এমনটাই জানিয়েছেন খোদ মমতা বন্দোপাধ্যায়৷
তবে মুখ্যসচিবের বিজ্ঞপ্তিতে কোথাও পার্থকে সরানোর কথা বলা হয়নি৷ শুধু বলা হয়েছে, পার্থর হাতে থাকা দফতরগুলি এখন থেকে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে চলে যাচ্ছে৷ প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি পার্থ এখন দফতরবিহীন মন্ত্রী? সে ব্যাপারে অবশ্য নবান্নের তরফে কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি৷ যদিও বিজ্ঞপ্তির অনুলিপি রাজ্যপালকেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে৷
গত শনিবার ইডির হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই তৃণমূলের অন্দরে পার্থকে সরানোর দাবি উঠে যায়৷ পার্থ ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দুটি ফ্ল্যাট থেকে যে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা এবং সোনা-গয়না উদ্ধার হয়, তাতেই উদ্বেগ বাড়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের৷ পার্থ ধরা পড়ার পর ৭২ ঘণ্টা একেবারেই নীরব ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ প্রায় এক সপ্তাহ কাটতে চলল, পার্থ-কাণ্ডে নীরব দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও৷ তবে দলের মধ্যে যে ঝড় বইছে, তা টের পাচ্ছিলেন তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা৷ পার্থ-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী প্রথম মুখ খোলেন সোমবার বঙ্গ সম্মাননা অনুষ্ঠান মঞ্চে৷ সেখানে অবশ্য তিনি একবারও পার্থর নাম মুখে আনেননি৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি দেওয়া হবে৷ কিন্তু দেখতে হবে ঘটনা সত্যিই কি না৷’ তারপরই তিনি ইডি-সিবিআইকে একহাত নেন৷
সোমবারের পর গত চারদিনে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে৷ সূত্রের খবর, তৃণমূলের মধ্যেও পার্থকে দল এবং মন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর দাবি আরও জোরালো হয়৷ পার্থর সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে থাকে তৃণমূল৷ টালিগঞ্জের পর অর্পিতার বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাট থেকেও প্রায় ২৮ কোটি টাকা মেলায় আরও মুখ পোড়ে তৃণমূলের৷ বুধবার রাতেই দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ প্রশ্ন তোলেন, কেন এখনও পার্থ চট্টোপাধ্যায় মন্ত্রিত্ব আগলে রয়েছেন এবং প্রভাব খাটাচ্ছেন? বৃহস্পতিবার সকালেই কুণাল রীতিমতো টুইটে পার্থর অপসারণ দাবি করে বসেন৷ একই সঙ্গে মন্ত্রিসভা এবং দলের সমস্ত পদ থেকে তাঁকে সরাতে হবে বলে কুণালের দাবি৷ দলের ছাত্রনেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য ফেসবুকে মন্তব্য করেন, শরীরে ফোঁড়া হলে তা কেটে দেওয়াই ভালো৷ তা না হলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে৷ এরপরই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিকেলে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বসবে বলে জানিয়ে দেন৷ সেই বৈঠকের কথা ঘোষণার পর কুণাল ফের একটি টুইট করেন৷ তাতে তিনি লেখেন, এর আগের টুইটে আমি ব্যক্তিগত মতামত জানিয়েছিলাম৷ তারপর দল বিষয়টি হাতে নিয়েছে৷ অভিষেক বিকেলে বৈঠকও ডেকেছেন৷ তাতে আমাকেও থাকতে বলা হয়েছে৷ এই অবস্থায় আমি আগের টুইট ডিলিট করছি৷
বিকেলে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বৈঠকে পার্থকে দলের মহাসচিবের পদ থেকেও সরানোর সিদ্ধান্ত হয় কি না, সেটাই দেখার৷ সূত্রের খবর, ওই বৈঠকে সেই দাবিও জোরালো হয়ে উঠতে পারে৷ পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে দল পার্থকে একেবারে ঝেড়ে ফেলার পথেই হাঁটতে চলেছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল৷ ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল তৈরি হওয়ার কিছু সময় পর থেকেই মমতার ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়৷ বাম জমানায় তিনি ছিলেন বিরোধী দলনেতা৷ তখন থেকে দলের কাজও তিনিই অনেকটা সামলাতেন৷ ২০১১ সালে পালাবদলের পর পার্থকে শিল্পমন্ত্রী করেন মমতা৷ তখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ব্রাত্য বসু৷ ২০১৪ সালে ব্রাত্যকে সরিয়ে পার্থকে শিক্ষামন্ত্রী করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তখন থেকেই শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি শুরু হয় বলে অভিযোগ ওঠে৷ এমনকি ২০১২ সালে শিক্ষামন্ত্রী না হওয়া সত্ত্বেও টেট পরীক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগেও জড়িয়ে যায় তাঁর নাম৷ স্কুল সার্ভিস কমিশনের নবম-দশমে শিক্ষক নিয়োগ এবং গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি কর্মী নিয়োগেও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে৷ জল গড়ায় হাইকোর্ট পর্যন্ত৷ হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় দুর্নীতির উৎস খুঁজতে৷ সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার ডিভিশন বেঞ্চে গিয়েও সুবিধা করতে পারেনি৷ আদালতের নির্দেশেই সিবিআইয়ের মুখোমুখি হতে হয় পার্থকে৷ একই সঙ্গে তদন্তে নামে ইডি৷ গত শুক্রবার সকাল থেকে নাকতলায় পার্থর বাড়ি-সহ কলকাতা ও আশপাশে ১৪ জায়গায় একযোগে অভিযান চালায় ইডি৷ পার্থকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই উঠে আসে অর্পিতার নাম৷ বিকেলে অর্পিতার টালিগঞ্জের ফ্ল্যাট থেকে ২১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা উদ্ধার হয়৷ শনিবার গ্রেফতার হন পার্থ৷ একইদিনে গ্রেফতার করা হয় অর্পিতাকে৷ রাজনৈতিক মহল মনে করছে, মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়াটা সময়ের অপেক্ষা ছিল মাত্র৷ তবু তৃণমূলের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে, একেবারে শুরুতেই এই সিদ্ধান্ত নিলে দলকে এতটা অপদস্থ হতে হত না৷
