তিষ্য দাশগুপ্ত: অবশেষে সে আসিল। শঙ্খ বাজিল, কাড়া নাকাড়া ঢাক ঢোল সহযোগে সে আসিল। রাজবাহাদুর সু-উচ্চ মঞ্চে উপবেশন করিয়া সদম্ভে তাঁর আগমনবার্তা ঘোষণা করিয়া আবারও দেশ ও দশের নাম উজ্জ্বল করিলেন। কী ভাবছেন? প্রলাপ বকছি? আসলে আপনার আমার মতো সে বেচারারাও খুব ঘেঁটে রয়েছে। আজ ১৭ সেপ্টেম্বর, ভারতবর্ষের “মসিহা” র ৭২ তম জন্মদিনে সুদূর নামিবিয়া থেকে উড়ে এল আটটি চিতা।
এ কাহিনীর গোড়ার কথা সেই ১৯৫০ সালের, যখন সরগুজার মহারাজা সদম্ভে ভারতবর্ষের বুক থেকে শেষ চিতাটিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেললেন। তার আগে অবশ্য সেই মোঘল রাজাবাদশাদের আমল থেকেই রাজকীয় আমোদের অন্যতম প্রধান খেলনা এই নিরীহ বেড়ালটি। গেম হান্টিং বা শিকার করার উপকরণ হিসেবে যত্রতত্র ব্যবহার হত চিতা। ফলত কমতে কমতে শেষে ১৯৫০ সালে ভারতভূম থেকে চিরতরে বিদায় নিল এশিয়াটিক চিতা, পৃথিবীর দ্রুততম প্রাণীটি।
আরও পড়ুন: বাংলায় তৃণমূলকে ২০২৪ সালে শিক্ষা দেওয়া হবে, হুঁশিয়ারি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের
অতঃপর স্বাধীন দেশে সেই ইন্দিরা গান্ধীর আমল থেকেই চিতাকে ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় শুরু, যা বিশেষভাবে অগ্রগতি লাভ করে ২০০৯ সালে – জয়রাম রমেশের উদ্যোগে। কিন্তু সে গুড়ে বালি, ইরানের দাবি ছিল ছয়টি চিতার পরিবর্তে ছয়টি সিংহ। গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর সাধের লায়ন ট্যুরিজমের(lion tourism) অংশীদারিত্ব পাশের রাজ্যকেই দিতে রাজি নন তো ইরান কোন ছাড়। ফলে পাখির চোখ এবার আফ্রিকা(Africa)। আইইউসিএন(International Union for Conservation of Nature) এর নির্দেশিকা অনুযায়ী যে কোনও ইনভেসিভ স্পিসিস(invasive species) এর আগমনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিধিনিষেধ রয়েছে, এবং তা যুক্তিগ্রাহ্য। ঠিক সেই কারণেই ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টের(Supreme Court) নির্দেশে চিতা প্রজেক্ট এর ‘রি ইন্ট্রোডাকশন'(re-introduction) শব্দটি থেকে ‘রি’ কথাটা বাদ যায়। এর প্রধান কারণ আফ্রিকান(African) ও ইরানিয়ান(Iranian) চিতা একই বেরাদরের হলেও আফ্রিকান চিতা কস্মিনকালেও এ দেশে ছিল না, ফলে তারা এসে কতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে সে কথা সকলেরই অজানা। এ ছাড়াও লেপার্ড চিতা কনফ্লিক্ট, মানুষ চিতা কনফ্লিক্ট, সুদীর্ঘ ঘাসজমির অপ্রতুলতা সব মিলে সমস্যা হাজারও।
আরও পড়ুন: ফের পোস্টার বয় শুভেন্দু, বাংলার বড় চোর লেখা পোস্টার কাঁথি জুড়ে
সে যাই হোক, তবে ভারতের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের দিকে তাকালে এই প্রজেক্টের গুরুত্ব অপরিসীম এবং এই প্রকল্পের প্রাণপুরুষ এম কে রঞ্জিত সিং(MK Ranjit Singh),ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার(Wildlife institute of India) প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী ডক্টর ওয়াই ভি ঝালা(Dr Y V Jhala) সহ অসংখ্য গবেষক দিনরাত এক করে মধ্যপ্রদেশের কুনো পালপুর অভয়ারণ্যকে করে তুললেন চিতার বসবাসের উপযোগী। এখানেই নাটকের দ্বিতীয় আখ্যান আরম্ভ। যে ‘বেনিয়া’ সরকার প্রায় প্রতিদিন এক একটি ফরেস্ট ল্যান্ডের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে চলেছে, যাদের বন-বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কিছুই যায় আসে না তারা হঠাৎ কোনও এক জাদুবলে এই প্ৰজেক্ট নিয়ে চূড়ান্ত উৎসাহিত হয়ে উঠল।
২০২১ সালেই চিতার আসার কথা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে, কিন্তু নানান সমস্যা ও কার্যকারণের ফলে সেই প্রকল্প রূপায়িত হয় না। বরং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নামিবিয়া এবং চিতা কনজার্ভেশন ফান্ড। খুব সঙ্গত কারণেই ভারতের তথাকথিত ‘আচ্ছে দিনের’ মার্গ দর্শক ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি ফুলিয়ে এমন একটা ‘গালা ইভেন্টের’ লাইমলাইট নিজের দিকে না টেনে থাকবেন, একথা ভাবাই যায় না। অতএব যা হওয়ার, তাই হল। অসংখ্য বিজ্ঞানীর রক্ত জল করা পরিশ্রমের মুকুট মাথায় পরে রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক এলেন, হাত নাড়লেন, ছবি তুললেন তাঁর জন্মদিনে। ভাবতে লজ্জা হয় এই ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাসে’ বিজ্ঞানীদের এবং তাঁদের সহকারীদের নামটুকু পর্যন্ত উচ্চারিত হলো না সরকারি অনুষ্ঠানে, অথচ আগামিকাল থেকে এই অবলা প্রাণীদের দেখাশোনা, বাঁচা-মরা প্রভৃতির সমস্ত দায় তাঁদের। মহামান্য সরকার বাহাদুর আর ফিরেও তাকাবে না এই দিকে।
আরও পড়ুন: পুজোয় শহরের পথে নামছে ১০০ বাস
২০২৪ এর ইলেকটোরাল এজেন্ডা(electoral agenda) সম্পূর্ণ,গদগদ মুখে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান মোদিজির জন্মদিনে কপালে গেরুয়া টিপ পরিয়ে নিয়ে এলেন চিতা। ঔদ্ধত্য ও আত্মপ্রচারের আস্ফালনে ব্রাত্য হয়ে থাকলেন বিজ্ঞানীরা যাঁরা একাধিকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে বর্ষাকাল কখনওই এই কাজের উপযুক্ত সময় হতে পারে না, কিন্তু কী আর করা। জন্মদিন তো আর বদল হয় না!
অতএব ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলকানিতে আর তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে তাঁর বাহাত্তর তম জন্মদিনে আসমুদ্রহিমাচলের মহামহিম দেশকে দিলেন এক গর্ব করার মতো উপহার। পিছনে পড়ে রইলেন কিছু কনফিউজড বিজ্ঞানসাধক আর আটখানি অসহায় বিড়াল, যারা জানে না তাদের কপালে কী ভবিতব্য লেখা রয়েছে।