ঝালদা: ২০ কিংবা ৩০ নয় প্রায় ১২০০ ধরে চলে আসছে হেঁসলা রাজবাড়ির দুর্গাপুজো (Hensla Rajbari Durga puja)। কে সেই রাজা কি বা তাঁর পরিচয়, কেনই বা এই জঙ্গলে রাজপ্রাসাদ তৈরি করে রাজত্ব করা। এর কারণ খুঁজতে আমাদের কলকাতা টিভির ক্যামেরা পৌঁছে গিয়েছিল ঝালদার দুর্গম গ্রাম হেঁসলাতে।
চারিদিকে উঁচু নিচু পাহাড় জঙ্গল দুর্গম রাস্তা, ভালুক চিতা নেকড়ে কিংবা হাতির ভয় তারই মাঝে বৃহৎ রাজপ্রাসাদ। এখানে সেই প্রাচীনকাল থেকেই দেবী দুর্গার পুজো হয়ে আসছে। সে সময় মোঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বেশীর ভাগ হিন্দু রাজাই আত্মগোপন করেছিলেন। নিজের প্রাণ ও পরিবারের মহিলাদের সম্মান বাঁচাতেই আত্মগোপনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন ছোটো বড় অনেক রাজাই। পাড়ি দিয়েছিলেন পশ্চিম থেকে পূর্ব ভারতের গভীর অরণ্যের আদিবাসী উপত্যকায়। বেশ কয়েকশত বছর পূর্বে রাজস্থানের বারাণসী থেকে এমনি এক হিন্দুধর্মের রাজপুত রাজা এসেছিলেন পুরুলিয়ার ঝালদা থানার এক দুর্গম অঞ্চলের হেঁসলা গ্রামে। এই গ্রামের চারিদিকে অসংখ্য ছোটো বড় পাহাড় ও গভীর জঙ্গল। সে সময় এই হেঁসলা গ্রামে ডোকার তেমন কোনো পথ ছিল না। তাই মোঘলদের হাতে পরাজিত সেই রাজা দ্বিগ্বীজয় প্রতাপসিংহদেরও আশ্রয় নিয়েছিলেন এই গ্রামে। এবং এই রাজা এলাকার আদিবাসী ও জঙ্গলজীবি আদিম জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের মন জয় করেন খব অল্প সময়েই। এরপর পাহাড় জঙ্গল কেটে তৈরি করেন রাজপ্রাসাদ।
এলাকায় রাজত্ব বিস্তারের জন্যে পার্শবর্তী অঞ্চলের ছোটো ছোটো আদিবাসী রাজাদের সঙ্গে শুরু হয় সংঘাত। ঐ সমস্ত আদিবাসী রাজারা পরাজিত হয়ে রাজা দ্বিগ্বীজয় সিংহের আনুগত্য স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। এ রকম মোট ২২ টি মৌজার দখলদারী নেন রাজা দ্বিগ্বীজয়। তৈরি করেন কাছারি,বাগানবাড়ি,নাটমন্দির,ঠাকুরদালান,ও বারটি সুবৃহৎ পুকুর। সেই বছরেই রাজা দ্বিগ্বীজয় সিংহ তাঁর নতুন ঠাকুরদালানে শক্তির দেবীরূপে মা দূর্গার পুজো শুরু করেন একটি খড়গকে সামনে রেখে। পরবর্তী সময়ে পুরুলিয়ার প্রাচীনতম সংস্কৃতি ছৌ নাচকে অনুকরন করে দেবী দূর্গার মূর্তি তৈরি করে পুজো শুরু হয়। এই গ্রামের পাশে বয়ে যাওয়া পাহাড়ী হেঁসলা নদীর ঝর্ণা থেকে দেবী দূর্গার ঘটে বারি আনা হয়। ঘটা করে ডাক বাদ্যশঙ্খের সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের গুলি চালিয়ে হেঁসলা নদীতে ডুব দিয়ে রাজা নিজে বারি আনতেন। এখনো সেই প্রথানুসরণ করেই বারি আনা হয় তবে বন্দুকের পরিরর্তে শব্দ বাজী ফাটিয়ে । ষষ্টি থেকে দশমী চলতো ছাগ ও মোষ বলি। বর্তমানে বলি হয় না। এখনও দেবী দূর্গার পুজো সেই প্রাচীন বৈদিক রিতী মেনেই হয়ে থাকে। তবে সম্পূর্ণ বৈষ্ণব মতে এই পুজো।
আরও পড়ুন: কালিয়াগঞ্জ মেতেছে জমিদার আমলের পুজোয়
সেইদিনের সেই রাজা কিংবা তাঁর রাজত্ব রাজতন্ত্র বর্তমানে কোনটাই আর নেই। শুধু পড়ে আছে জরাজীর্ণ রাজপ্রাসাদ,কাছারিবাড়ি ,নাটমন্দির ,ঠাকুরমন্দির ও পুকুর। এই রাজবাড়ির বর্তমান প্রজন্ম রাজা কুন্দর্পনারায়ণ সিংহ দেও এখন পুজো পরিচালনা করেন । ও জরাজীর্ণ রাজ সাম্রাজ্য দেখভাল করেন। একদা মাওবাদী উপদ্রুত ঝালদার প্রত্যন্ত দুর্গম এই হেঁসলা গ্রামে এখনো স্বমহিমায় দেবী দুর্গার পুজো হয়।
পুজোর সময় ছয় দিনের জন্যে আবার নতুন করে সেজে ওঠে এই রাজপ্রাসাদ। ওই জরাজীর্ণ রাজপ্রাসাদটি যেন ফিরে পায় সেই পুরনো রাজ ঐতিহ্য। যদিও বর্তমানে এলাকায় আরও অনেক গ্রামেই দুর্গাপুজো হয় তবু মানুষের ভীড় জমায়েত এই রাজ বাড়ির পুজোয়। কারণ প্রাচীনতম পুজো হিসেবে সকলেই এখানেই পুজো দিতে আসেন। রাজ বংশধরেরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকলেও দুর্গাপুজোর সময়কালে সকলেই এখানে এসে উপস্থিত হন। মহাসমারহে ও ধুমধাম করে চলে পুজো পাট। এলাকার সকল মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিলে বর্তমান রাজবংশধরেরা পুজোর আনন্দ উপোভোগ করেন। পুজোর কয়েক দিনেই এই রাজপ্রাসাদে অগনিত মানুষের জন্যে খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা থাকে।
আবার পুজোর শেষে বংশধরেরা নিজের যায়গায় ফিরে যান। ফাঁকা হয়ে পড়ে থাকে এই রাজপ্রাসাদ। হেঁসলা পাহাড়ের কোলে পোড়া ভূতুড়ে বাড়ির মতো চেহারা নিয়ে এই রাজপ্রাসাদ অপেক্ষা করতে থাকে আরো একটি বছরের জন্যে। বর্তমান রাজা কুন্দর্পনরায়ণ সিং দেও জানান বারাসত বছর ধরে চলে আসছে এই পুজো।
আরও অন্য খবর দেখুন