‘গিরি এবার উমা এলে আর উমা পাঠাব না/বলে বলবে মন্দ লোকে, কারও কথা শুনব না।’ মা মেনকার এই আর্তি সত্ত্বেও কালের নিয়মে হিমালয়-সুতাকে যে কৈলাসে ফিরতেই হবে। তাই নবমীর দিনটা বাঙালির বিষাদের দিন। বুকের ভিতর কেমন যেন আনমনেই বেজে ওঠে বিজয়ার সুর। সকাল থেকেই মহানগরে যেন ভাঙা মেলার ছন্দ। অষ্টমীর হোল নাইটের ক্লান্তি জড়ানো চোখেমুখে তাও সাতসকালে মাংসের দোকানে পড়ল লম্বা লাইন। বাগুইআটি থেকে বাগমারি, মানিকতলা থেকে যাদবপুর বা গড়িয়া বাজারে সকাল গড়াতে গড়াতে লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। নবমী আর খাসির মাংস বাঙালির কাছে সমার্থক।
সকালে রাস্তায় বেরিয়ে দেখা গেল, কোথাও তেমন আর যুদ্ধং দেহি উত্তেজনা নেই। ঠাকুর দেখা প্রায় শেষ। তাও নবমী মানে নবরাত্রির শেষ। তাই এইদিনে ভিড় আর শিকল দিয়ে আটকে রাখা যায় না। তাও সকালে দেখা গেল ঝিমন্ত মহানগরীর রাজপথ। সারারাত ভূতের মতো খেটে যাওয়া খাবারের স্টল ও রেস্তরাঁগুলিতেও মাছি ভনভন করছে। কেউ কোত্থাও নেই। গুটিকয়েক বড় প্যান্ডেলে ফাঁকায় ফাঁকায় ঠাকুর দেখবেন বলে কয়েকজন ঘোরাঘুরি করলেন। কারণ, দুপুরে কচি পাঁঠার ট্যালটেলে ঝোলের সঙ্গে চাড্ডি ভাত মেরেই সামান্য দিবানিদ্রা দিয়েই মাঠে নামার পালা। টেনিস বলের মতো এ প্যান্ডেল থেকে ও প্যান্ডেলে লাফিয়ে বেড়ানো।
যে প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল মহালয়ার ভোরে, আজ রাতের তারাদের সঙ্গে সেই দীপ নিভে আসার পালা। দর্পণে ফুটে উঠবে মায়ের মুখচ্ছবি। তাই আজ সকলের বুকের ভিতরে যেন বাজছে শাক্তকবির সেই সুর— ওরে নবমীর রাত্রি না হইওরে অবসান। বিজয়া দশমীর বিষাদধ্বনি বেজে ওঠার আগেই তাই কবি একান্ত আকুতি গোটা বঙ্গদেশের হৃদয়ে বেজে ওঠে,
যেও না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে!
গেলে তুমি, দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!
…নয়নের মণি মোর, নয়ন হারাবে!
তাই নবমী হল আনন্দ ও বিষাদের এক ভরা সন্ধিক্ষণ। কাল সকালেই নীলকণ্ঠ পাখি রওনা দেবে কৈলাসের উদ্দেশে। হরের ঘরণী ফিরবেন স্বামীর ঘরে। কিন্তু, মা উমার বিজয়ার নিরঞ্জনে বাংলার ঘরে ঘরে এক এক করে নিভে যাবে দেউটি। নবমীর দিনে তাই বাঙালি কেন, দেবীরূপী প্রতিমার চোখও যেন ছলছলিয়ে ওঠে। এই এত আলো, এত উচ্ছ্বাস, এত সুর, এত আনন্দের পরিপূর্ণ কলস আজ নড়ে উঠবে। দর্পণে ফুটে উঠবে মাতৃমুখ।