দেশের প্রধানমন্ত্রীর গলায় হঠাৎই এক অন্য সুর শোনা গেল, তিনি যিশুখ্রিস্টের কথা বললেন, শান্তি, অহিংসা, সহিষ্ণুতার কথা বললেন। আবার ক’দিন আগেই হাসপাতালে গিয়ে অমিত শাহ দেখা করলেন প্রতাপ চন্দ্র সারেংগির সঙ্গে, ওড়িশায় এমপি, সংসদ ভবনের সামনে ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছেন। এই সেই বজরং দলের নেতা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ফাদার গ্রাহাম স্ট্রেনকে ১৯৯৯-এর ২২ জানুয়ারি তাঁর দুই সন্তান সমেত জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার, তিনি নাকি ধর্মান্তরণের কাজ চালাচ্ছিলেন, এটাই ছিল অভিযোগ।
প্রধানমন্ত্রী নিজে হাসপাতালে যাননি, কিন্তু খোঁজ নিয়েছেন। এই প্রধানমন্ত্রীর আমলেই চার্চ ভাঙা হয়েছে, ফাদার স্ট্যান স্বামীকে জেলে পচিয়ে মারা হয়েছে, সেই তিনি আজ যিশুর অহিংসা, সহিষ্ণুতার কথা বলছেন। আরও কিছুদিন বলবেন কারণ বছর খানেক পরেই কেরালাতে ভোট, সেখানে এই খ্রিস্টান ভোটের প্রয়োজন আছে। আর তারচেয়েও বড় কথা হল তাঁর সঙ্গে দহরম মহরম যে দেশ বিদেশের নেতাদের, তাঁদের বেশিরভাগই ক্যাথলিক খ্রিস্টান, অতএব এদেশে খ্রিস্টান কমিউনিটির বিরুদ্ধে এরকম ঘটনা ঘটতে থাকলে তাদের ধমকানি শুনতে হবে, কাজেই খ্রিস্টানদের উপরে সরাসরি অত্যাচারে একটু হলেও ভাটা পড়েছে। কিন্তু তাহলে স্বাভাবিক প্রশ্ন হল উনি তো বহু ইসলামিক দেশেও যাচ্ছেন, তাঁদের দেশের শেখ সাহেবদের সঙ্গেও তো তাঁর ভালই দহরম মহরম, যেমন ধরুন সৌদি আরব। আসলে এই সৌদি আরব বা কাতার বা মধ্য এশিয়ার এই ধনী ইসলামিক দেশগুলো কথা বলবে, প্রতিবাদ করবে তখনই যখন আপনি ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলবেন।
এদেশে বা প্যালেস্তাইন বা অন্য কোনও জায়গাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন মারা গেলে তাঁরা চুপ করেই থাকেন, হ্যাঁ একেবারে শরিয়তে হাত পড়লে তাঁদের কাছ থেকে প্রতিবাদ আসবে। খেয়াল করে দেখুন সেগুলো কমেছে, আর বেড়েছে পিটিয়ে মারা, বল জয় শ্রীরাম, না বললে পেটাব, হিন্দু বিয়ে করেছিস, ঘর জ্বালিয়ে দেব, গরুর মাংস রেখেছিস, জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেব। আর সেসব ঘটনায় বিচলিত নন সৌদি আমিরেরা, এসব নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। আর মাঝে মধ্যে মুখে এই সম্প্রীতি শান্তির কথা বলেই যাবেন আমাদের মোদিজি। এক হাতে ছুরি, অন্য হাতে গোলাপ, পুরনো থিওরি। আমার ছোটকা, ছোটকাকা বলে তার যখন বয়স ১৫ কি ১৬, তখন একটা বই সবসময় তার ব্যাগে থাকত, সবসময়। পুজোর সময় মামাবাড়িতে গেলেও ব্যাগে থাকত ওই বই, গরমের ছুটিতে মা বাবার সঙ্গে সিমলা, কিন্তু ব্যাগে সেই বই আছে, ইস্পাত, হাউ দ্য স্টিল ওয়াজ টেম্পার্ড, নিকোলাইচ অস্ত্রিওভিস্কির লেখা বই, ছোটকা সে বইয়ের নায়ক পাভেল হতে চাইত, বন্ধুরা, পরে পাড়ার সবাই, তারও পরে বাড়ির লোকজনও ছোটকাকে পাভেল বলেই ডাকা শুরু করে। আমার সেই পাভেল কাকা, ছোটকার মুখেই শুনেছি তখন সোভিয়েত প্রকাশনার বই আসত, কুমারী মাটির ঘুম ভাঙছে, ধীরে বহে ডন, চিং চিং মাইয়ের বিপ্লবের গান এল আরও পরে। ছোটকার মুখেই শোনা, সারা দেশের মানুষ গান্ধী বাবার ভক্তও ছিল, বহু মানুষ গান্ধী বিরোধীও ছিল, কিন্তু নেতাজিকে এগিয়ে রাখলেও তারা মনে করত, গান্ধী, নেহরু, আজাদ, প্যাটেল দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবা, চে গ্যেভারা তখন চেনা শব্দ, চেনা নাম, আমাদের ছোটবেলা থেকে সে সব নামে ভাটা পড়তে থাকে।
আমাদের ছোটবেলায় রাদুগা প্রকাশনীর বই পাওয়া যেত না, ছিল না সস্তার সোভিয়েত বই, বরং জ্ঞান হওয়া পরেই দেখলাম সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, স্তালিনের দেশ জর্জিয়াতে স্তালিনের মূর্তিটা থেকে গেল বটে, লেনিনের মূর্তি ওপড়ানো হল, তো সেসব জটিল রাজনৈতিক ব্যাপার বলেই জানতাম। কিন্তু আমাদের কলেজ জীবনে লিবারাল, উদার গণতন্ত্র বেশ একটা জায়গা করে নিয়েছিল, ফেসবুকে স্ট্যাটাস, লিবারাল লেফট, লিবারাল ডেমোক্রাট। সেকুলার হওয়াটাই ছিল আধুনিকতা, আমি সেকুলার বলত অনেকেই, গর্ব করেই বলত। হঠাৎ সব ধারণা পালটে দিয়ে নতুন কিছু কথা শোনা যেতে লাগল, বছর পাঁচ ছয় ধরে সে সব কথাবার্তা অনেকের মুখে, লিবারালদের ব্যঙ্গ করে বলা হল লিবেড়াল, যেন লিবারাল হওয়াটা খুব খারাপ, সেকুলার-এর বদলে শব্দ এল সিকুলার, ফেসবুকে চে গ্যেভারা উধাও, এসেছে বিবেকানন্দ, ট্যাগ লাইন, গর্বের সঙ্গে বলো আমি হিন্দু। শোনা গেল দেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে গান্ধী, নেহরু, আজাদের ভূমিকা নেই, বল্লভ ভাই প্যাটেলকে ঠকিয়ে নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশকে ডুবিয়েছেন, স্বাধীনতার পর থেকে দেশ পাকিস্তানের দাদাগিরির কাছে, চীনের দাদাগিরির কাছে মাথা নিচু করে ছিল, দেশে উন্নয়ন তো হয়ইনি, দেশে এক পরিবারের শাসন চলেছে, নেহরু আসলে মুসলমান, দেশটা ইতালির কাছে বেচে দেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। মুসলমানরা জনসংখ্যায় এমন বাড়ছে যে, ২০৩০ কি ২০৪০ এর মধ্যে তারাই ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াবে, নতুন তথ্যে ভরে গেল হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক, স্যোশাল মিডিয়া। কেবল মন্তব্য নয়, বড় বড় লেখা, জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ আসতে শুরু করল, বাম হয়ে গেল ভাম। লিবারাল হল লিবেড়াল, সেকুলার হল সিকুলার। মুসলমান হয়ে দাঁড়াল টেররিস্ট, মাদ্রাসাতে টেররিস্ট তৈরি হচ্ছে, মাদ্রাসায় জেহাদি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, আমরা শুনলাম। মাই নেম ইজ খান, অ্যান্ড আই অ্যাম নট এ টেররিস্ট, সিনেমা হবার পর শাহরুখ খানকেই ট্রোল করা শুরু হয়ে গেল, অযোধ্যা রামমন্দিরের ভূমিপুজো হল, দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস, কারা বলছেন এসব? কিছুদিন আগে যাদের গলায় বামপন্থার কথা শোনা গেছে, কিছুদিন আগে যে অভিনেতা হাসুলি বাঁকের উপকথা নিয়ে মঞ্চে নেমেছিলেন, যিনি বিশ্ব যুব সম্মেলনে গান গাইতে গিয়েছিলেন, যিনি তরুণ মজুমদারের তৈরি করা নির্বাচনী প্রচার সিনেমায় নায়িকা ছিলেন, তাঁদের গলায় শোনা গেল এসব কথা।
আগুনখেকো এক বিপ্লবী কাম শিল্পপতি, যিনি ক’বছর আগে বাম সরকারের সাধের ন্যানো কারখানা বন্ধ করার জন্য, মমতাকে দক্ষিণপন্থী বলে ১২০০ শব্দ খরচ করলেন, তিনি ভিক্টোরিয়ায় গিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সেলফি তুলে আপ্লুত হলেন, ফেসবুকে পোস্ট করলেন। আমাদের আশেপাশে ঘটে গেল এক প্যারাডাইম শিফট, আমূল পরিবর্তন। সারা দেশ জুড়ে দেখলাম, আমাদের বাংলাতেও। কেউ কখনও ভেবেছিল? এই বাংলায় ভোট চাওয়া হবে প্রকাশ্যে ধর্মের নামে? প্রার্থী ঠিক করা হবে জাতের হিসেব করে? ভেবেছিল কেউ, বাংলায় ভোটের প্রচারে ইস্যু হবে লাভ জেহাদ? মমতা দুর্গাপুজোতে বাধা দেয়, এটা ইস্যু হবে, প্রচার হবে কেউ ভেবেছিল? আমরা ভাবিনি, কিন্তু ঘটনা ঘটেছে, এরকম তীব্র সাম্প্রদায়িক নির্বাচনী প্রচার গোবলয় দেখেছে, বাংলাতেও তা হল। তীব্র বিষ। তার বিরুদ্ধে লড়েছেন বামপন্থীরা, বাজে, পচা ভূল অস্ত্র নিয়ে, তাদের আব্বাস প্রেম ব্যুমেরাং হয়েছে, তৃণমূল লড়েছে, লড়েছে অন্যান্যবাম সংগঠন, বামপন্থী মানুষ লড়েছেন তাদের মত করে। কিছুটা বিজেপির ভুলে, অনেকটা তৃণমূলের নির্বাচনী প্রচারে উন্নয়ন, তাদের তৈরি করা বিরাট ডাইরেক্ট বেনিফিসিয়ারি তৈরি হবার কারণে, বিজেপির বিরুদ্ধে প্রায় সব ভোট তৃণমূলের দিকে যাওয়ার কারণে তৃণমূল জিতেছে, কিন্তু বিরাট সংখ্যক ভোটারও কিন্তু ওই সাম্প্রদায়িক প্রচারে সায় দিয়েছে, তারা মনে করে মুসলমানরা বিপদ, দেশবিরোধী। তারা হিন্দুরাষ্ট্রের অদ্ভুত পরিকল্পনায় সায় দিয়েছে, তারা শুভেন্দু অধিকারী বা দিলীপ ঘোষ যে বিষ উগরিয়েছেন তা ধারণ করেছেন, তাঁরা মনে করেন নরেন্দ্র মোদিই হলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি দেশের উন্নয়নের কথা বলছেন, আগের সবাই ছিল নেহাতই চোর চোট্টা। তারা মনে করে দেশের থেকে মুসলমানদের তাড়াতে হবে, তারা মনে করে জওহরলাল একজন মুসলমান, গান্ধী একজন মুসলমান প্রেমী, তারা মনে করে অপরাধী দেখলেই গুলি করে মারা উচিত, ওসব আইন টাইন দিয়ে কিছু হবে না, মনে করেন মানবাধিকার, সেকুলারিজম এসব বাজে কথা। তারা মনে করে নরেন্দ্র মোদির জন্যই পাকিস্তান এখনও ভারত আক্রমণ করার সাহস পাচ্ছে না। তারা মনে করে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব ইত্যাদি অর্থনৈতিক ইস্যুর থেকে অনেক বেশি জরুরি এক হিন্দু রাষ্ট্র, হ্যাঁ ওই বিরাট সংখ্যক মানুষের সিংহভাগ কিন্তু এটাই মনে করে, এবং সেটাই এক বিরাট সমস্যা। বা বলা ভালো সেটাই আমাদের রাজ্যে, গণতান্ত্রিক, উদার, অসাম্প্রদায়িক মানুষের সামনে সবথেকে বড় সমস্যা। কারণ এ এক অদ্ভুত প্রচার যা শুরু হল ২০১৪/১৫/১৬ নাগাদ, হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল সারা রাজ্যে, আগেই ছড়িয়েছে গোটা গোবলয়ে।
বিজেপি হেরেছে, রাজ্য সরকার কাজ করছে, বহু প্রকল্প হবে, ত্রুটি বিচ্যুতি থাকবে, কিছু দুর্নীতি থাকবে, কোথাও মানুষ খুশি হবেন, কোথাও অখুশি, এসব চলতেই থাকবে। কিন্তু সরকারের কাজ দিয়ে ওই সব মানুষকে ফেরানো যাবে না, যে মানুষেরা আরএসএস–বিজেপির এই প্রচারে সায় দিয়েছেন, যে মানুষেরা সত্যি করেই বিশ্বাস করেন দেশের সব সমস্যার জন্য মুসলমানরা দায়ী, তাদের ফেরানো যাবে না। তাকিয়ে দেখুন না এক বিরাট মতুয়া জনগোষ্ঠীর দিকে, তাঁরা দেশের নাগরিক, তাঁরা নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন, এবারেও দিয়েছেন, যে অধিকার কেবলমাত্র নাগরিকদেরই আছে, কিন্তু তাঁরা মনে করেন বিজেপি সরকার, ইউনিয়ন সরকার, ভারত সরকার, নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহ তাঁদের নাগরিকত্ব দেবে, হ্যাঁ এটাই ওই অঞ্চলে বিজেপির প্রচার ছিল, সেই মানুষেরা কেবল রাজ্য সরকারের কাজ দেখে ফিরবে না। তাহলে? আমাদের কাজ, এটা আমাদেরই কাজ, এই বিষ নির্মূল করা, যে মানুষেরা বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে বলেছিলেন, তাঁদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, যে বামপন্থীরা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, যে গণতান্ত্রিক, উদার, অসাম্প্রদায়িক মানুষজন বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, তাঁদের দায়িত্ব, যে বামপন্থীরা শূন্য পেয়েছেন, তাঁদের দায়িত্ব, যে বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, কবি, সাহিত্যিক সমাজে এগিয়ে থাকা মানুষজন নির্বাচনের সময় বিজেপির বিরোধিতা করেছিলেন, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে, তাঁদের প্রত্যেকের দায়িত্ব, শাসক দল তৃণমূলের তো বটেই।
প্রত্যেকটা মানুষকে বলতে হবে রবীন্দ্রনাথের কথা, নজরুলের কথা, বলতে হবে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির কথা, কবির, নানক, চৈতন্যের কথা, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রামমোহন, রবিঠাকুরের কথা। এ বিষ নির্মূল না করতে পারলে এরপর এ বিষ মাথায় চড়বে, ফ্যাসিস্টদের কেবল নির্বাচনে হারানোটাই যথেষ্ট নয়, ফ্যাসিবাদ একটা দর্শন, তার বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াইটাও খুব জরুরি। আমরা বাংলার মানুষ তো জানিই, বর্গিরা বহুবার পিছিয়েছে, আবার এসেছে নতুন শক্তি সঞ্চয় করে, আবার লড়েছে বাংলার মানুষ, নির্বাচনে ফ্যাসিস্ট বর্গিরা কেবল পিছু হটেছে, ওদের নির্মূল করার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের।