জয়নগর: অপেক্ষা আর কয়েকটা দিনের উমা আসছে সপরিবারে বাপের বাড়িতে। আকাশে বাতাসে এখন শিউলির গন্ধ। শারদোৎসব বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতি তুঙ্গে বনেদি বাড়ি (Banedi Bari Durga Puja) থেকে বারোয়ারির পুজোগুলিতে। জয়নগরের মোয়া যেমন ঐতিহাসিক, তেমনই জয়নগর অঞ্চলের ইতিহাসও একইরকম ভাবে সুপ্রাচীন এবং ঐতিহ্যপূর্ণ। জয়নগরের কিছু ঐতিহাসিক বনেদি বাড়ি এখনও তাদের ইতিহাসকে আগলে ধরে বেঁচে রয়েছে। জয়নগরের দত্ত বাড়িতে দুর্গাপুজোয় (Jaynagar DuttaBari Durga Pujo)। এ বছর ৩৪৯ বছরের দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজো। যে পুজো এক সময় আলোকিত করতেন আসতেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বেশ কয়েকটি প্রাচীন বনেদি বাড়ি দুর্গাপূজার মধ্যে অন্যতম হল জয়নগরের দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজো। অনেকেই আবার এই দত্তবাড়ির দুর্গাপুজোকে সাদা দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজো বলে অনেকেই ডেকে থাকে। ১৬৭৫ সালে জমিদার রামচন্দ্র দত্ত কলিকাতা থেকে সুন্দরবনে এসে নিজের জমিদারি আধিপত্য স্থাপন করে। এরপর মা দুর্গার স্বপ্নাদেশে শুরু হয় দুর্গাপুজো। তৎকালীন রামচন্দ্র দত্ত তার জমিদারি আধিপত্য এতটাই বিস্তার ছিল যে ৯৪ টি মৌজা এবং ৬ টি থানার জুড়ে তার জমিদারি আধিপত্য ছিল। দশ দিন ধরে এই দত্তবাড়িতে মহাকর্মযজ্ঞের অনুষ্ঠান লেগে থাকত অতীতে। মহালয় এর পরের দিন প্রথমা থেকেই শুরু হত দেবীর বোধন। এরপর টানা ১০ দিন দেবীর পুজো শুরুর সময় গান ফায়ার করে করে পুজোয় বসতেন পুরোহিতরা। কালের নিয়মে জমিদারি প্রথা আর নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে পুরনো প্রথা। এখনও এই দত্তবাড়িতে টানা ১০ দিন ধরে দেবীর আরাধনা করা হয়। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতানুসারে এখানে পূজিত হয় দেবী দুর্গার।
আরও পড়ুন: বিসর্জনের পর আজও প্রথা মেনে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ান রায়চৌধুরীরা
পরিবারের সদস্যরা কর্মসূত্রে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে থাকলেও পুজোর সময় পরিবারের সকল সদস্যরা এসে উপস্থিত হয় এই দত্তবাড়িতে। অতীতের সেই জৌলস কিছুটা ভাটা পড়লেও এখনও পর্যন্ত সেই প্রাচীন রীতিনীতি মেনে চলছে দত্ত বাড়ির সদস্যরা। এখনো প্রথা মেনেই রথযাত্রার দিন কাঠামো পুজো হয়। বংশপরম্পরায় মৃৎশিল্পী, পুরোহিত ও বাদ্যকাররা এই বাড়িতে পূজোয় সামিল হন। বলিদান প্রথা এখনও রয়েছে এই দত্তবাড়িতে পুজোর শুরু হওয়ার আগে এখন আর বন্দুকের আওয়াজ হয় না বরং আতশবাজি জ্বালিয়ে পুজো শুরু করা হয়।
এই দত্তবাড়িতে বারুইপুরের ম্যাজিস্ট্রেট থাকা কালীন দত্তবাড়িতে আনাগোনা ছিল সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি দত্ত বাড়িতে প্রায় সময় এসে ছুটি কাটাতেন এবং দত্ত বাড়ির দুর্গা পুজোয় তিনি সামিল হতেন। জয়নগরের এই দত্তবাড়িতে বসে তিনি লিখেছিলেন বিষবৃক্ষ উপন্যাস। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বেশ কয়েকটি উপন্যাসে এই দত্ত বাড়ির উল্লেখ রয়েছে। এ বিষয়ে পরিবারের এক সদস্য শিবেন্দ্র নারায়ন দত্ত তিনি বলেন, কর্মসূত্রে কলকাতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় পরিবারের সদস্যরা থাকলেও পুজোর সময় তারা এই দত্ত বাড়িতে এসে উপস্থিত হন এবং প্রাচীন যে প্রথা সেই প্রথা মেনেই এখনও পর্যন্ত ১০ দিনের দূর্গাপুজো। এই পূজোর সঙ্গে বহু ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে তৎকালীন বারুইপুরের ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দত্ত বাড়ির ছেলে যোগেন্দ্র নারায়ন দত্তের বাল্যবন্ধু হওয়ার সুবাদে। দত্ত বাড়িতে তার আনাগোনা ছিল ছুটির দিনগুলিতে দত্ত বাড়িতেই আসতেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এমনকি দুর্গা পুজোতে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তিনি এই দত্তবাড়িতে এসে দুর্গাপুজো উপভোগ করতেন। এই দত্তবাড়ির সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র নিবিড় টান রয়েছে। দত্ত বাড়ি স্থানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র আত্মীয় আর সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক থাকাকালীন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু স্বাধীনতা আন্দোলনে বেশ কয়েকটি সভা এই দত্ত বাড়ির সামনে মাঠেই করেছে। এখনো পর্যন্ত নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের বাড়িতে দত্ত বাড়ির দুর্গাপুজোর প্রসাদ পাঠানো হয়। দত্ত বাড়ির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে বহু ইতিহাস। আগের মতো দুর্গাপূজার জৌলস অনেকটাই কমে গিয়েছে কিন্তু প্রাচীন সেই রীতিনীতি আমরা মেনে চলছি। বহু ইতিহাসের সাক্ষী রয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই দত্ত বাড়ি। পুজো কটা দিন দত্ত বাড়ি যেন আগের মহিমায় ফিরে আসে। চারিদিকে আত্মীয়-স্বজনের কোলাহল এবং উৎসবের আনন্দ আমরা দশ দিন হই হুল্লোড়ে কাটিয়ে দিয়ে।
অন্য খবর দেখুন
