দিল্লি: ঠিক ১০০ দিন আগে, আগস্টের ৫ তারিখে চরম নাটকীয় পরিস্থিতিতে যখন শেখ হাসিনা ভারতে পা রাখেন, তখন থেকে তিনি এই দেশের কোথায় বা কীভাবে আছেন, সেই বিষয়ে ভারত সরকার কোনও তথ্যই প্রকাশ করেনি। তবে তথ্য সামনে না এলেও এই প্রশ্নগুলি আজকের দিনে ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে যে, শেখ হাসিনাকে ভারতে কী ধরণের নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে এবং কেন দেওয়া হচ্ছে? এমনকি এই প্রশ্নটাও উঠছে যে এই চরম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ভারতে তিনি স্বাধীনভাবে কতটা কী করতে পারছেন?
গোপন সূত্রে যেমনটা জানা গিয়েছে, শেখ হাসিনাকে ভারতে সেটুকুই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, যেটুকু না দেওয়া হলেই নয়। একইসঙ্গে সাদা পোশাকের নিরাপত্তারক্ষীরাই তাঁর চারপাশে ঘিরে রয়েছেন। অর্থাৎ, শেখ হাসিনার চারপাশে কোনও কমান্ডো বা কোনও কড়া নিরাপত্তা বলয় নেই। আর গোটা বিষয়টার মধ্যে কোনও বাড়াবাড়ি করা হয়নি। মানে, কোনওরূপ ঢাকঢোল পিটিয়ে শেখ হাসিনার জন্য কিছু করা হচ্ছে না। গোটা জিনিষটাকে খুব নিচু তারে বেঁধে রাখা হয়েছে। গোপনীয়তাকেই তাঁর সুরক্ষার মোড়ক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই কারণে, তিনি কোথায় আছেন সেই বিষয়ে এখনও কোনও তথ্য প্রকাশ করা হয়নি বা এমন কোনও তথ্য কারও হাতেও আসেনি। এছাড়াও, শেখ হাসিনার সঙ্গে অন্য কারও দেখা করা বা তাঁকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া- এইসব মুভমেন্ট যতটা সম্ভব এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। অর্থাৎ, এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, শেখ হাসিনার নিরাপত্তাকে নিশ্ছিদ্র করার লক্ষ্যে তাঁর সম্পর্কে যে কোনও বিষয়কেই গোপনে করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে শেখ হাসিনার মুভমেন্ট যে পুরোপুরি বন্ধ নেই, তাঁর ইঙ্গিতও পাওয়া গিয়েছে গোপন সূত্র মারফত। হয়তো দিল্লির মর্নিং ওয়াকারদের সঙ্গে কোনও ইচ্ছেমতো তিনি হাঁটাহাঁটি করে যাচ্ছেন; আবার হয়তো কোনও শুক্রবার দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরবারে কাওয়ালি শুনতে আসছেন- এইসব জল্পনাও শেখ হাসিনাকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এমন জল্পনার কোনও সত্যতা আজও পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: ইজরায়েল-আমেরিকার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল অস্ট্রেলিয়া
গত ৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা দিল্লিতে এসে নামেন, তখন কংগ্রেসের মুখপাত্র শর্মিষ্ঠ মুখার্জি এক্স হ্যান্ডেলে একটি পোস্ট করে লেখেন, “Stay safe and strong Hasina aunty. Tomorrow is another day. My prayers are with you.” এই পোস্টে তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর একটি সদ্য এবং একটি পুরানো ছবি পোস্ট করেন এবং পোস্টে তিনি শেখ হাসিনাকে মেনশনও করেন। শেখ হাসিনাকে আন্টি বলে ডাকতে পারেন, শর্মিষ্ঠা ছাড়া দিল্লিতে এমন কেউ আছেন বলে তো মনে হয়না। আসলে শর্মিষ্ঠা মুখার্জির আরেকটা পরিচয় হল তিনি ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রয়াত প্রণব মুখার্জির কন্যা। খুব ছোট বেলায় শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে তাঁর যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা যে তিনি আজও ভুলতে পারেননি, তা তাঁর এই পোস্টের মাধ্যমেই বোঝা গিয়েছে। আসলে, ৭৫-এর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শেখ হাসিনাকে দিল্লিতে আশ্রয় দেওয়ার সময় তাঁর সমস্ত নিরাপত্তা ও দেখভালের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন তাঁর আস্থাভাজন বাঙালি কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখার্জির উপর। তখন থেকেই প্রণব মুখার্জির গোটা পরিবারের সঙ্গে শেখ হাসিনার একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ফলে দিল্লিতেও এমন কেউ কেউ আছেন, যাঁদের উপর শেখ হাসিনা সন আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়াই ভরসা করতে পারেন। আসলে, দিল্লিতে সেই সময় দীর্ঘদিন কাটানোর ফলে তাঁর একটা পরিচিতি বলয় তৈরি হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে এখনও কেউ কেউ জীবিত রয়েছেন। কিংবা দিল্লিতে আজও কেউ আছেন ভারতীয় সেনার প্রাক্তন কর্নেল অশোক তারার মতো কেউ, যিনি একাত্তরের ১৭ ই ডিসেম্বরের সকালে ধানমুন্ডিতে পাকিস্তানী সেনার পাহারায় থাকা শেখ হাসিনা সহ মুজিব পরিবারের সদস্যদের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। আজও অশোক তারা ও তাঁর স্ত্রী- দুজনের সঙ্গেই শেখ হাসিনার সম্পর্ক বেশ ভালো। এমনকি, ঢাকায় কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন, এমন অনেক ভারতীয় কর্মকর্তার সঙ্গেও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক রয়েছে। হয়ত, বিগত ১০০ দিনে এমন ঘনিষ্ঠ পরিজনের কেউ কেউ শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। এই ধরনের ভিসিটের সংখ্যা হাতে গোনা হতে পারে, কিন্তু ভারত সরকার হাসিনার এমন দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা যে করে দিতে পারে, তাও পুরোপুরি অনিশ্চিত নয়।
আরও পড়ুন: সুদানের যুদ্ধে, দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু
গত তিন মাসে শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর দলীয় কিছু নেতা কর্মীর ফোনালাপের বেশ কিছু অডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। এইসব অডিওতে একপক্ষের কণ্ঠস্বর হুবুহু শেখ হাসিনার মতই শোনাচ্ছে। যদিও ভারত সরকারের তরফে এইসব ভাইরাল অডিওর কোনও সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে একাধিক গোপন সূত্র মারফত জানা গিয়েছে যে এই ভাইরাল অডিওর কণ্ঠস্বর আদতেই শেখ হাসিনার। যদিও এই বিষয়টি পরিষ্কার যে শেখ হাসিনা যেহেতু ভারতের কোনও গৃহবন্দী বা রাজনৈতিক বন্দী নন, তাই তাঁর বিভিন্ন ঘনিষ্ঠ পরিজন বা দলীয় কর্মীদের সঙ্গে সশরীরে না হলেও ফোনে কথাবার্তা বলাটা আস্বাভাবিক কিছুই নয়। দিল্লিতে থাকা মেয়ে সাইবা ওয়াজেদ বা ভার্জিনিয়াতে থাকা ছেলে সজীব ওয়াজেদের সঙ্গে তাঁর যে রোজ যোগাযোগ হচ্ছে, সেই অনুমানও করা যাচ্ছে। এমনকি জানা গিয়েছে যে নিউজ চ্যানেল বা ইন্টারনেটে তাঁর সম্পূর্ণ অ্যাক্সেস রয়েছে। তবে তিনি যাতে এখনই নিজে থেকে কোনও রাজনৈতিক বিবৃতি না দেন, সেই বিষয়ে তাঁকে ভারতের পক্ষ থেকে অনুরোধ করতা হয়েছে বলে খবর। কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পুনর্বাসন কী আদৌ সম্ভব? ভারত এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও বিবৃতি দেয়নি। তবে ঢাকায় ভারতের প্রাক্তন হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী মনে করেন, এই কাজটি শুধুমাত্র কঠিন নয়, এটি খুবই কঠিন। এমনিতেই আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে। এছাড়াও এই দলের রাজনৈতিক অবস্থান খুব একটা যে ভালো নয়, তাও বোঝা যাচ্ছে বিভিন্ন পরিস্থিতি দেখেই। আজ থেকে ১০ বছর আগে এমন অভ্যুত্থান হলেও হাসিনার দেশে ফেরা সম্ভব ছিল, তবে এই মুহূর্তে সেটা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। কয়েকদিন আগে একটি ভাইরাল অডিওতে শেখ হাসিনার মত কণ্ঠস্বরে কাউকে বলতে শোনা গিয়েছে, “আমি বাংলাদেশের খুব কাছেই আছি, চট করে ঢুকে পড়ব।”
উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর আওয়ামি লিগের বহু নেতা ও কর্মী ভাবছেন, আগের নেত্রীর দেশে ফেরা শুধুই সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তবে, শেখ হাসিনা যে দেশের আতিথেয়তায় আছেন, তারা কিন্তু এখনই এমনটা ভাবতে রাজি নয়। আভাষ পাওয়া গিয়েছে যে, হাসিনাকে দেশে ফেরানোর জন্য ভারত মোটেও কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। বরং, ভারত চায়, শেখ হাসিনা নিজেও এই বিষয়ে কোনওরূপ তাড়াহুড়ো না করুন। হয়তো তাতেই হাসিনার মঙ্গল।
দেখুন ভিডিও: