Wednesday, July 2, 2025
HomeScrollFourth Pillar | বাংলায় কথা বলো? বাংলাদেশে যাও
Fourth Pillar

Fourth Pillar | বাংলায় কথা বলো? বাংলাদেশে যাও

অসমের ইতিহাসেই আছে ‘বিদেশি বিতাড়ন’ নিয়ে আন্দোলন

Follow Us :

আগুন নিয়ে খেলা চলছে অসমে। হিন্দু জনসংখ্যার হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া চলছে। এক নতুন দাঙ্গা লাগানোর পরিকল্পনা নিয়ে আগামী নির্বাচনের আগে মাঠে নেমেছেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। মাত্র এক বছরও হয়নি, মণিপুরে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর জাতিগত হিংসা দেশজুড়ে তোলপাড় ফেলেছিল। দাঙ্গা, ধর্ষণ, লুঠ, আগুন, হত্যা— এই সব কিছুর মধ্যেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নির্বিকার হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন, আর কেন্দ্রীয় সরকার চোখ বুজে দেখছিল আগুন কতটা ছড়ায়। সেই শাসকদলেরই আর এক মুখ্যমন্ত্রী, হিমন্ত বিশ্বশর্মা, এবার অসমে যেন একই ধরনের আগুন জ্বালাতে চাইছেন। পার্থক্য একটাই— এবার এই আগুন শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং ১০০ শতাংশ ইচ্ছাকৃতভাবে উসকে দেওয়া রাজনৈতিক কৌশল। অনেক সাংবাদিক বলেন, মাঝেমধ্যে আমরাও বলি, বিজেপির আছে এক টোয়েন্টি ইন্টু ফোর ইলেকশন মেশিনারি, তারা দেশজুড়ে নয় এমনকী বিদেশেও প্রশংসা পায় তাদের ভোট মেশিনারি ও প্রস্তুতির জন্য। কিন্তু এর পিছনে যে কী ভয়ঙ্কর খেলা চলে, তা হয়তো সাধারণ মানুষ জানেন না, টের পান না। অসমে ২০২৬-র ভোটে জেতার জন্য বিজেপি যে পথে হাঁটছে, তাতে একদিকে ‘বিদেশি’ বিতাড়নের নামে মুসলিমদের নিশানা করা হচ্ছে, আর অন্যদিকে ‘আদিবাসী’দের অস্ত্র হাতে তুলে দিয়ে এক বিভাজিত সমাজ তৈরি করা হচ্ছে, যা এক ভবিষ্যত গৃহযুদ্ধের জমি তৈরি করছে। ছড়িয়ে গেছে স্লোগান, ‘বিদেশি’ মানেই মুসলমান: এক পুরনো ভয়, নতুন মোড়কে আবার হাজির।

অসমের ইতিহাসেই আছে ‘বিদেশি বিতাড়ন’ নিয়ে আন্দোলন। কিন্তু সেই আন্দোলনে সব ধর্মের মানুষদের বিরুদ্ধে এক জাতীয়তাবাদী বয়ান ছিল। মানে সে আন্দোলনে ধর্ম মাপকাঠি ছিল না, এখন সেটাকে হিন্দুত্বের ছাঁচে ঢেলে শুধু মুসলিম জনসংখ্যার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের জুন মাসে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বিধানসভায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন— ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পরে যারা এসেছে এবং যাদের বিরুদ্ধে কোনও মামলাও নেই, তাদের সরাসরি বিতাড়ন করা হবে। এবং সেটা হবে কোনও ফরেনার্স ট্রাইবুনাল (FT) ছাড়াই, শুধুমাত্র জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্তে। মানে জেলাশাসক সিদ্ধান্ত নেবে কারা নাগরিক, কারা নাগরিক নয়। শুধু কি তাই নাকি? তিনি খুব স্পষ্ট করেই বলেন, হিন্দু মানুষজনেরা এই আইনের আওতায় পড়বেনই না, কারণ তাঁরা ‘ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার’। ফলে এই বিতাড়ন সম্পূর্ণ ধর্মীয় ভিত্তিতে আলাদা করে দেখা হচ্ছে, যা সংবিধানের মৌলিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে। অবশ্য বিজেপি আর ধর্মনিপেক্ষতা আজ এক পরস্পর বিরোধী শব্দ। কাজেই আমরা গৃহহীন মানুষ দেখছি, যাঁদের আশ্রয় ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ, তাঁদের কোথাও কোনও দেশ নেই! মে মাসে প্রকাশ্যে এসেছিল এক ভিডিও, যেখানে দেখা যাচ্ছে ১৪ জন মানুষ সীমান্তে আটকে পড়ে আছেন। তাঁদের আদালতের মামলাও চলছে, কিন্তু পুলিশ তাঁদের তুলে সীমান্তে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশ তাঁদের ঢুকতে দেয়নি, তাঁরা খোলা আকাশের নীচে, তাঁরা পড়ে থাকলেন মাঝপথে, ধানখেতে, রোদে পুড়ে। তাঁদের এক জন, খায়রুল ইসলাম পেশায় শিক্ষক জানান, তিনি সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন, তবুও তাঁকে পাঠানো হয়েছে নো ম্যান্স ল্যান্ডে, সরকারি ভাষায়, পুশব্যাক চলছে। জানাজানি হওয়ার পরে সরকার কয়েকজনকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল— যাদের পরিবার এগিয়ে আসতে পারেনি, যাদের ভিডিও ভাইরাল হয়নি, তাঁদের কী হল? তাঁরা কোথায়? আমরা কেউ জানি না, তাঁরা উবে গেলেন?

আসলে বিচার ব্যবস্থা, আদালতকে পাশ কাটিয়ে প্রশাসনিক হুকুমে বিচারের এক প্রহসন চলছে। হিমন্ত শর্মা নিজেই জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে রাজ্য সরকার ‘অসাধারণ ক্ষমতা’ পেয়েছে, যা ব্যবহার করে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটরাই এই পুশব্যাকের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। অথচ এই দাবির সত্যতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। আইনজীবী ও সংবিধান বিশারদরা বলছেন, এটা আইন লঙ্ঘনেরই নামান্তর। মানুষকে নাগরিকত্ব প্রমাণের সুযোগ না দিয়েই বিতাড়ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনেরও পরিপন্থী। রাজ্যের বিরোধী নেতা দেবব্রত শইকিয়া কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রীকে চিঠি লিখে এই পুশব্যাক নীতিকে ‘অমানবিক’ ও ‘অসাংবিধানিক’ বলেছেন, তাঁর মতে, “ভারত নিজেই যদি নিজের নাগরিকদের বিচারের সুযোগ না দিয়ে ঠেলে দেয়, তাহলে সে দেশ কার জন্য সংবিধান বানিয়েছে?” এবং অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে, অস্ত্র হাতে ‘আদিবাসী’রা ঘুরছেন, কী উদ্দেশ্য? কেন? ২০২৫ সালের মে মাসে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, আদিবাসী ও মৌলিক ভারতীয় নাগরিকদের অস্ত্র দেওয়া হবে। সরকারের যুক্তি, এই সব অঞ্চলগুলোয় মুসলিমরা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই সেখানকার আদিবাসীরা নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না। ধুবড়ি, বরপেটা, মরিগাঁও, নওগাঁ—এই সব জেলার কথা বলা হয়, অথচ বাস্তবে ইতিহাস ঘাঁটলে, জনগণনার পুরনো রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, এই মুসলিমরা বহু প্রজন্ম ধরে এই জেলাগুলোতে থাকছেন, অহমিয়া ভাষায় কথা বলেন, তাঁদের সন্তানরা সরকারি স্কুলে পড়ে। তাঁরা আদতে অসমের অংশ। তাঁরা অহমিয়া। কিন্তু সরকারই যখন তাঁদের ‘অন্য’ হিসেবে, অনুপ্রবেশকারী হিসেবে তুলে ধরে, তখন সমাজে বিভাজন চরমে পৌঁছয়।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ভারতকে এক হিন্দুরাষ্ট্র করে তোলার প্ল্যান কিন্তু রেডি

অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দিলে সেই বিভাজন রক্তাক্ত রূপ নেবে— এ কথা ইতিহাস নিজেই বলে। এবং অস্ত্র তুলে দিয়ে আর এক মণিপুর তৈরি করা হচ্ছে, যা নিয়ে দেশে রাজনৈতিক মহলে কোনও হেলদোল নেই। এবং আগামী ভোটের আগেই হিংসার সব উপাদান প্রস্তুত? কেবল অস্ত্র দিলে তো হবে না, একটা ইন্ধন জোগানো দরকার, সেটার জন্যই ধর্মীয় উসকানি আরও এক ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। জুন ২০২৫-এ ধুবড়িতে ইদের দিন হিন্দু মন্দিরের সামনে গরুর মাথা পাওয়া যায়। মুখ্যমন্ত্রী শর্মা সেখানে গিয়ে বলেন, “যদি কেউ গরুর মাংস রাখে, আপনারা শুয়োরের মাংস রাখুন।” এক মুখ্যমন্ত্রীর মুখে এমন বক্তব্য শুধু অনভিপ্রেত নয়, তা দণ্ডনীয়ও হওয়া উচিত। লক্ষ্মীপুরে নামঘরের পাশে গরুর খুলি পড়ে থাকতে দেখা গেলে আবার কয়েকজন মুসলিম যুবককে গ্রেফতার করা হয়। কোনও প্রমাণ নেই, কোনও বিচার নেই, কে ফেলেছে, কেন ফেলেছে, তদন্ত না করেই অভিযোগ চলে গেল এক বিশেষ সম্প্রদায়ের দিকে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন— “সত্র জমি দখল করছে সংখ্যালঘুরা, মসজিদ বানিয়ে স্থানীয় মানুষদের উৎখাত করছে।” তিনি বলেন, এক স্থায়ী ‘সত্র কমিশন’ গঠন করা হবে, যাতে এই জমিগুলো রক্ষা করা যায়। এইসব বক্তব্যে বারবার ‘সংখ্যালঘু মানেই মুসলমান’—এই বয়ানই প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যা স্পষ্টত হিংসার ডেকচিতে ঘি ঢালার কাজ করছে। আবার সেই ১৯৬০-র দশকের পুনরাবৃত্তি? আরেকটা মণিপুর? এই পুশব্যাক বা বিতাড়ন কৌশল নতুন নয়। ১৯৬১-৬৪ সালে কংগ্রেস সরকার প্রায় ১.৭৮ লক্ষ মানুষকে বিতাড়িত করেছিল পূর্ব পাকিস্তানে। তখনও প্রতিবাদ হয়েছিল, পাকিস্তান রাষ্ট্রপুঞ্জে অভিযোগ জানিয়েছিল।

তবে এখন সময় আলাদা। এখন আছে মানবাধিকার আইন, বিচারব্যবস্থা, মিডিয়া, মোবাইল ক্যামেরা। তবুও সরকার সেই পুরনো পথেই হাঁটছে, আর এবারে মিডিয়া ও প্রশাসন সরকারের ধামাধরা, কোনও প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ দুর্বল। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল— অসমের বেশিরভাগ, ৯৯ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাঁদের অনেকেই ১৯০৫ সালের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে অসমে স্থায়ী হয়েছেন। তাঁরা কৃষক, মজুর, শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী। কিন্তু আপাতত তাঁদের পরিচয় শুধু একটাই— বাংলাদেশি। এক চরম বর্ণবৈষম্যমূলক রাজনীতি। ধর্ম, ভাষা, বংশ, বা পোশাকের ভিত্তিতে কারও নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা একটি জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপরিচয়ের উপর আঘাত। হিন্দু হৃদয় সম্রাট নরেন্দ্র মোদির দেশে হিমন্ত শর্মা এক হিন্দুত্ববাদী অধিপতি হয়ে উঠেছেন। একদা কংগ্রেসি, রাহুল গান্ধীর বন্ধু হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এখন বিজেপির অন্যতম আগ্রাসী মুখ্যমন্ত্রী। যোগী আদিত্যনাথের পরেই তাঁর নাম। তিনি একাধারে হিন্দুত্বের মুখ, আবার অসমিয়া জাতীয়তাবাদের পতাকা নিয়ে চলছেন। তাঁর বহু বক্তব্যই আদৌ কোনও বক্তব্যই নয়, প্লেন ‘হেট স্পিচ’। সংবিধান কার্যকর থাকলে ওনার জেলে থাকার কথা। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন “অসমিয়া জাতিকে রক্ষা করতে হলে আপস করা চলবে না।” এই কথা বুঝিয়ে দেয়, যে মুসলিম সম্প্রদায় বহু প্রজন্ম ধরে এখানে বাস করে, তাঁদের অস্তিত্ব আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে। আজ আমরা দেখছি সংবিধানের মৃত্যু: ধর্মনিরপেক্ষতার অন্ত্যেষ্টি।

ভারত রাষ্ট্র হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু অসমে যা চলছে, তা একেবারেই রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতা। আর এই সাম্প্রদায়িকতা শুধু ভোট জেতার জন্য নয়, সমাজকে এক দীর্ঘমেয়াদী হিংসার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ধর্মীয় আইডেন্টিটি আর ভূখণ্ডের মালিকানার প্রশ্ন একসঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে সরকার বলছে— “এই দেশ তোমার নয়।” আর সেই বয়ান তৈরি করতে তারা আদালতের রায়কে ভুলভাবে এনে হাজির করছে, মানুষকে বিভক্ত করছে, আর অস্ত্রের জোরে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছো। ভোট আসবে, যাবে। কিন্তু রাজ্যের সামাজিক কাঠামো যদি এইভাবে টুকরো টুকরো হয়, তাহলে কে থাকবে এই রাজ্যে? কে বলবে, “আমি অসমের নাগরিক?” আমি অহমিয়া? যদি আজ রাষ্ট্র নিজেই নিজের নাগরিকদের চিহ্নিত করতে না পারে, যদি ধর্মের ভিত্তিতে অস্তিত্ব নির্ধারণ হয়, তাহলে তা শুধু অসমের নয়, ভারতবর্ষের ভবিষ্যতের উপরেই এক অন্ধকার ছায়া ফেলবে। মানুষ চাইছে নিরাপত্তা, শান্তি, উন্নয়ন। সরকার দিচ্ছে সন্দেহ, বিভাজন আর বন্দুক। অসমে এখন সময় দাঁড়িয়ে আছে এক ফাটলের কিনারে। সময় থাকতে যদি এই রাজনৈতিক আগুনকে নিভানো না যায়, তাহলে মণিপুরের মতো আগুন অসমের শরীরকেও গ্রাস করবে। শুধু অসম নয়, সারা দেশেই তার আঁচ লাগবে, সেটা বুঝতে কি খুব অসুবিধে হচ্ছে?

RELATED ARTICLES

Most Popular


Deprecated: Automatic conversion of false to array is deprecated in /var/www/ktv/wp-content/themes/techinfer-child/functions.php on line 39