Sunday, June 29, 2025
Homeচতুর্থ স্তম্ভবেজেছে তোমার আলোর বেণু, এসেছে গোখরো সাপ

বেজেছে তোমার আলোর বেণু, এসেছে গোখরো সাপ

Follow Us :

বাজল তোমার আলোর বেণু, পুজো এসেই গেল। এবার গত বছরের থেকে পুজোর, উৎসবের মেজাজ সপ্তকে। গত বছরের আগের দু’ বছরের পুজো ছিল ম্লান, প্যান্ডেলে ছিল না মানুষ, ছিল না প্যান্ডেলের পাশেই ফুচকা ঘুগনিওয়ালা। মা সবার মঙ্গল চান বটে কিন্তু সেই দু’ বছরে দেশে আদানি আম্বানি এবং হাতে গোনা কিছু মানুষ ছাড়া কেউ তো ভালো ছিল না। কেউ না। গড়িয়াহাটের ফুটে ইমিটেশন গয়না নিয়ে হাপিত্যেশ করে বসে থাকা যুবকটি দিনের শেষে একটাও খদ্দের না পেয়েই ঘরে ফিরেছে। হাতিবাগানে কিছু পশরা ঝুলিয়ে বসেছিল যে দোকানি, তার দুটো বাল্বের জন্য যে ইলেক্ট্রিক বিল আসে তার খরচও তুলতে পারেনি। ফি বছর হাসতে হাসতে অন্তত শ’ দুয়েক মানুষকে সিকিম, গোয়া, কন্যাকুমারী বা চারধাম তীর্থে পাঠায় যে ট্যুর অপারেটর তার অফিসের ঝাঁপ ছিল বন্ধ। সেই ছবি কেমন ছিল? যখন আচমকা লকডাউনের পর মানুষ হাঁটছিল? মাইলের পর মাইল হেঁটেছিল ভারতবর্ষ।

জ্যোমাটো আমাদের খাবার এনে দেয়,
ঠিক যেমনটা চাই, গরম, প্যাকেটে মোড়া,
সঙ্গে পেপার ন্যাপকিন
টিপস দিই আমরা, ৫, ১০, ১৫। লেখাই থাকে।
রেস্তরাঁ বন্ধ, রেস্তরাঁর যে ছেলেটা খাবার দিত,
তন্দুরে এক লপ্তে পুরে দিত রুটি, যে ছেলেটা
এক টানে গোল ক্রিস্পি দোসা যে বানাত
তারা সবাই রাস্তায়, তারা হাঁটছে।
ঝুঠা হি সহি, যে গয়না বানাত,
এক প্যাকেটে ১০টা কানের দুল
একদিনে ৫০ প্যাকেটের মাল, মজুরি ৮ টাকা।
যে সেই মালগুলোকে প্যাকেটে মুড়ে বাক্সবন্দি করত
দিনে ১০০টা বাক্স, মজুরি ৪ টাকা বাক্স প্রতি
সকাল আটটায় ছাতু পেঁয়াজ লঙ্কা মাখা।
মাসের শেষে বাবাকে ফোন
“পয়সা মিলি তো দওয়া খরিদ লেনা”
রাতে ওই ফ্যাক্টরির বাক্সপ্যাঁটরা সরিয়ে ঘুম।
তারা সবাই রাস্তায়, তারা হাঁটছে।
বাবা জায়গাটা দখল করেছিল, মছলি বাজারের পাশে
এক চিলতে জায়গায় ভাত রোটি সবজি চিকেন অন্ডা
বাপ দম্মা কে বিমারি নিয়ে গ্রামে
দু’ ভাই চালায় ‘হোটেল শর্মাজি কা’, তার বাপ ছিল ডোম
জানত শর্মাজির দোকানে শর্মাজিও খাবে ডোমও খাবে।
পুলিশ সাতসকালেই নিয়ে যায় ৫০ টাকা,
দুজনের খাবার ফ্রি
এই কড়ারে শর্মাজি কা হোটেল চলছিল।
হনুমান ডোম, তার ভাই রঘুবীর ডোম রাস্তায়, তারা হাঁটছে
দানিশের মতো তরতর করে বেয়ে উঠতে পারে না কেউ
হার্নেস লাগে না, দড়ির ফাঁস গলিয়ে দেয় ১০টা ইঁটে
হাসান সিমেন্ট বালু পাথরের ভাগ চোখে মাপতে পারে,
ঠিকাদারের কথামতো ৫০ সিএফটি ঢালাইয়ে
দু’ বস্তা সিমেন্ট বাঁচায়
ভারা তো বাঁধে সিরাজুদ্দিন,
বেলদা থানা, সাকিন জোরপুর
ঠিকাদার বলেছিল, এরা বের হবে না
এলাকার লোক বলেছিল, আনহাইজেনিক,
শাটডাউন, লকডাউন
দানিশ, হাসান, সিরাজ সবাই রাস্তায়, ওরা হাঁটছে।

কতজনের চাকরিই চলে গেছে, কতজনের মাইনে কমেছে। আর যারা মরেই গেল, তারা কেবল মরল না, অবহেলায় সারিবদ্ধ পুড়ে গেল ধাপার মাঠে, নাকি অন্য কোনও জায়গায়। শেষযাত্রায় এল না বন্ধু, আত্মীয় স্বজন। মজার কথা হল সে বছরও বেজেছিল আলোর বেণু, শেষে বেজেছিল, শান্তি দিলে ভরি।
দুখরজনী গেল তিমির হরি।
প্রেমমধুর গীতি
বাজুক হৃদে নিতি নিতি মা।
প্রাণে সুধা ঢালো
মরি গো মরি।
কিন্তু শান্তি তো আসেনি।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বদলাতে থাকা ভারতের রাজনীতিই ২০২৪-এ বিজেপিকে হারাবে?

আজ তিন বছর পর গড়িয়াহাট থেকে হাতিবাগান জমজমাট। এবার সে দোকানি তার পাশের দোকান থেকে দু’ প্লেট চিকেন বিরিয়ানি নিয়ে ফিরেছে। বিরিয়ানির দোকানদার মেয়ের জন্য ফ্রক আর ছেলের জন্য বন্দুক আর রোল ক্যাপ কিনেছে। তিন বছর পর আবার হাওড়া পাঁচলা থেকে জরির কাজ করা কাপড়, শোলার মুকুট এসেছে। মুর্শিদাবাদ থেকে, বীরভূম থেকে ঢাকিরা আসা শুরু করেছে। ৭-৮ দিন এই কলকেতায়, তারপর ঢাক বাজানোর টাকা, বাবুদের বখশিস, আর পুজো কমিটির দেওয়া মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ফিরবে। সব্বার পুজো শেষ হলে গ্রাম বাংলায় আরেক উৎসব, আমার বাবা ফিরেছে। ওদিকে তাজুদ্দিনের ঘাড়ে এবার ঠাকুর পছন্দ আর বায়না করার দায়, চাঁদা উঠেছে ৩৪ হাজার, সরকারের ৬০ হাজার। এবারের প্রতিমা একটু বড়ই আনবে, সক্কলকে বলে এসেছে তাজউদ্দিন, নিলু আর সুবোধকে নিয়ে সে এখন কুমোরটুলিতে। নিতাই আর অনুজ ঘরামি, বাঁশের চাল আর খড়ের ছাদ বেঁধেই দিন কাটত, বছর দশেক আগে খোঁজ পেয়েছিল তারা, এক শিল্পীর ডাকে তারা প্রতিবছর আসে কলকাতায়। চড় চড় করে চিরে ফেলে বাঁশ, সেই বাতা বেঁধে কত রকমের কারুকার্য। কলকাতায় ষষ্ঠীটা কাটিয়েই সপ্তমীতে ফিরে যেত গ্রামে, কোঁচড় ভর্তি টাকা, মেজাজ ফুরফুরে। হ্যাঁ, পেট্রলের দাম ১০০ পেরিয়েছে কবেই, ডিজেল পার করল বলে। হ্যাঁ, জিনিসের দাম বেড়েছে, আনাজপাতি থেকে চাল, ডাল, চিনি তেল, নুন কিনতে নাজেহাল দেশের মানুষ। বাংলার মানুষ, হ্যাঁ, যাদের চাকরি গেছে অতিমারিতে, তারা সবাই চাকরি ফিরে পেয়েছে এমনও নয়, যারা চাকরি চায় তারা এখনও অসহায়। এদিকে রাশি রাশি টাকার স্তূপ পার্থর বান্ধবীর বাড়িতে ছিল, অপবাদ গরুচোর, অনুব্রত জেলে। বীরভূমে এখন কাজল শেখ। রোজই আসিতেছে আসিতেছে ইডি, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স। চোখ রাঙাচ্ছে অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদি মিথ্যে স্তোক দিয়েই চলেছে, ডিএ না পেয়ে হতাশ রাজ্য সরকারি কর্মচারী। আনিস এখনও পায়নি ইনসাফ।
হ্যাঁ, এসবই সত্যি কিন্তু তবুও ফুটেছে কাশফুল, তবুও কাজল কাজল মেঘেরা সরে গিয়ে সোনা রোদ মাঠে ঘাটে, প্যান্ডেল বাঁধা শেষ। কোথাও কোথাও তো পুজো শুরু, ঢাক বাজছে, ঢাক বাজছে। আমি আছি, তুমি আছো তাই, গান বাজছে। এভাবে কান্না হাসির দোল দোলানো দুনিয়ায় একটু হাসি হেসে নেয় আমজনতা। এখানেই ধর্ম বয়ে আনে উৎসব, উৎসবে শামিল জাগো বাংলা থেকে গণশক্তি, কালান্তর। লাল শালুর প্যান্ডেলে বসে যে ছেলেটা বিক্রি করবে দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন, সেও ঢাকের বোলে পা নাচায়, আড় চোখে দেখে নেয় পাড়ার দুর্গার ডাকের সাজের রকমসকম। আর যাদের বিপ্লবী হবার বালাই নেই, তারা তো এই ক’দিন চালাও পানসি বেলঘরিয়া। দুগগা পুজোই বলুন, আর শারদোৎসব, বিমান বসু থেকে মমতা বন্দ্যোপাধায়, সামিরুল থেকে মদন টুডু, আমজনতার, খাস মানুষজনের কিছু না কিছু ভূমিকা তো থাকেই। আর সেই আবহে আবার চেনা পুজো ফিরে এসেছে। অচেনাটা কী? আগে আসতেন অ্যাপিয়ারেন্স ফি নিয়ে, আসবেন কেউ কেউ রাজনীতির চুলোতে রুটি সেঁকে নিতে। অ্যাপিয়ারেন্স ফি না নিয়েই সাফ রাজনীতি করতেই চলে এলেন অমিত শাহ। প্যান্ডেলের থিম রামমন্দিরের, ধর্ম আর মেরুকরণের রাজনীতি। অথচ মোলায়েম গলায় বললেন আজ রাজনীতির কথা বলব না। সঙ্গে নতুন সাকরেদ কাঁথির টাচ মি নট খোকাবাবু। গুষ্টিসুদ্ধু মন্ত্রী সান্ত্রি হয়েও আরও বড় খোয়াব দেখা শুরু করেছেন। ওনার মুখ্যমন্ত্রীর গদি চাই তাই এ বাংলায় তিনি পদ্মফুলের চাষে নেমেছেন।
সেই কবেই কবীর সুমন বলেছিলেন
রাই জাগো রাই জাগো
রাই জাগো রাই জাগো
ঘরে ঢুকছে কেউটে সাপ,
তোমার ঘুমের সুযোগ নিল
রাম, রুটি, ইনসাফ।

যে শারদোৎসব আমাদের সম্প্রীতির পরিচয়, যে দুগগা পুজোয় হিন্দু, মুসলমান মানুষ একইভাবে মেতে ওঠে পুজো নিয়ে, আমাদের সমস্ত ভেদাভেদকে দূরে সরিয়ে যে উৎসব আনে ভাইচারার ঐতিহ্য, সেই উৎসবের দিনে শুভেন্দু বাঙালিকে নবরাত্রির জ্ঞান দিচ্ছেন। নিরামিষ খাওয়ার জ্ঞান দিচ্ছেন। আমাদের বাংলার মাটি, জলাশয় এই পদ্মফুল চাষের অযোগ্য। আমাদের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় নজরুল, আমাদের মননে জীবনানন্দ। আমাদের উঠোন জুড়ে জায়নমাজের উদার জমির পাশেই তুলসীতলা। সেই আবহেই আমাদের আকাশের মেঘ কেটে যায় হঠাৎই, কাশফুলের রং হয়ে ওঠে ধবধবে সাদা, শিউলি ঝরে টুপটাপ, ঢাক বাজে। আমরা বলি বলো দুগগা মাইকি, সে অনুষঙ্গে উৎসব ধর্মের চেয়ে অনেক বড় হয়ে ওঠে, ধর্ম থাকে ব্যক্তির মনে, আর উৎসব হয়ে ওঠে এক সমষ্টির উদযাপন। আমরা ভুলে যেতে চাই বছর তিনেক আগের সেই অভিশপ্ত দিনগুলো। মনে রেখে দিই সেই দিনগুলোতে কারা ছিলেন মানুষের বিরুদ্ধে, এগিয়ে চলি, মন্ত্র বুকে অসুরবধের। যে গোখরো সাপের দল এই উৎসবের আবহে ফাঁকফোকর খুঁজে নিজেদের বিষ ঢালতে চাইছে, তাদের চিহ্নিত করুন। আমাদের বাঁচার অধিকার, আমাদের উৎসবের অধিকার যারা কেড়ে নিতে চায়, ধর্মের নামে যারা বিভেদের জাল বুনতে চায়, তাদের চিহ্নিত করুন। এবারের দুর্গাপুজো সত্যিই হয়ে উঠুক এই মানবিকতা বিরোধী, ধর্মের নামে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ যারা তৈরি করে, সেই বিষাক্ত গোখরো সাপেদের সঙ্গে, সেই অসুরদের সঙ্গে এক শেষ লড়াই আর জয়ের উৎসব।

RELATED ARTICLES

Most Popular

Video thumbnail
Madan Mitra | TMC | বিগ ব্রেকিং, কসবা কাণ্ডে বিতর্কিত মন্তব্য, মদন মিত্রকে শোকজ তৃণমূলের
00:00
Video thumbnail
Kasba Incident | কসবা ল কলেজে পুলিশের সঙ্গে বচসায় জাতীয় মহিলা কমিশন, দেখুন ভিডিও
00:00
Video thumbnail
Madan Mitra | TMC | বিগ ব্রেকিং, কসবা কাণ্ডে বিতর্কিত মন্তব্য, মদন মিত্রকে শোকজ তৃণমূলের
09:41
Video thumbnail
Iran-Israel | America | ইরানকে কী কী কারণে ভ/য় পাচ্ছে আমেরিকা-ইজরায়েল?
06:02:55
Video thumbnail
জনতা যা জানতে চায় | মোদির বিদেশ সফরের নির্যাস কী? কী ফল পেল দেশবাসী?
03:20:00
Video thumbnail
Kasba Incident | কসবা ল কলেজে পুলিশের সঙ্গে বচসায় জাতীয় মহিলা কমিশন, দেখুন ভিডিও
06:44
Video thumbnail
জনতা যা জানতে চায় | Anik Chatterjee | ভারতের বিদেশনীতিতে নেহেরুর জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন
02:05
Video thumbnail
Narendra Modi | Shubhanshu Shukla | মহাকাশ থেকে শুভাংশুর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কী কথা হল? দেখুন LIVE
02:15:21
Video thumbnail
জনতা যা জানতে চায় | Jayanta Ghosal | ভারতের দালাইলামার আসা বিদেশ নীতিতে কী পরিবর্তন করেছে?
01:40
Video thumbnail
জনতা যা জানতে চায় | Rajagopal Dhar Chakraborty | বিদেশনীতির ক্ষেত্রে রোমান্টিসিজম কতটা এফেক্টিভ?
01:37

Deprecated: Automatic conversion of false to array is deprecated in /var/www/ktv/wp-content/themes/techinfer-child/functions.php on line 39